প্রতিটি ঐতিহাসিক কালেরই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। কোনো কোনো ঐতিহাসিককালে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঙালি উন্নত মানসিকতার ও অসাধারণ সৃষ্টিশক্তিরও পরিচয় দিয়েছে। বাঙালি চরিত্রে অনেক প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যও আছে। প্রগতির জন্য ভালো দিকগুলোতেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার এবং মহৎ সম্ভাবনা খোঁজ করা দরকার।
বাংলা ভাষার লেখকরা এবং হিন্দু-মুসলমান সমাজ-সংস্কারকরা জনসাধারণের ওপর গভীর আস্থা নিয়ে লিখতেন এবং কাজ করতেন। মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্র, বেগম রোকেয়া, কাজী আবদুল ওদুদ, নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন বাংলার মানুষের অন্তহীন শক্তি ও সম্ভাবনায় আস্থাশীল ছিলেন বলেই সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন বিস্ময়কর রকম সুন্দর ও কল্যাণকর সাহিত্য। বাংলার মানুষের সরলতা ও শুভবুদ্ধিতে তাঁরা মুগ্ধ ছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার জনসাধারণের শক্তি ও সম্ভাবনার ওপর সম্পূর্ণ আস্থাশীল ছিলেন। জনগণের সমর্থন তাঁরা লাভ করেছিলেন। জনজীবনে তাঁরা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবও বিস্তার করে গেছেন। অবশ্য তাঁরা কেউ স্বজ্ঞানে বাঙালি জাতির মূল রাজনৈতিক প্রবণতার ও জাতীয় চরিত্রের পরিবর্তন সাধনের কথা ভাবেননি। তবে তাঁদের নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় চরিত্রের ঘনীভূত প্রকাশ ঘটেছে। জাতীয় চরিত্র গঠনে তাঁদের প্রত্যেকেরই অসাধারণ প্রভাব আছে।
বাঙালি চরিত্র নিয়ে যাঁরা গভীরভাবে চিন্তা করেছেন, তাঁদের অনেকেই বলেছেন : সাধারণ বাঙালি দল গঠনে ও নেতৃত্ব সৃষ্টিতে অনীহ, তারা স্বভাবত আত্মকেন্দ্রিক, ব্যক্তিতান্ত্রিক, egocentric, egoistic তাদের সামাজিক চেতনা ও সামাজিক গুণাবলি কম, তারা নিজেরা নিজেদের মধ্য থেকে নিজেদের জন্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারে না, তাদের মধ্যে যারা যোগ্য, তারা কেউ কাউকে মানতে চায় না। আমরা দেখতে পাই, উত্তেজনার সময় সভা-সমাবেশে শামিল হওয়ার, আর এক দলের পক্ষে ও অন্য দলের বিপক্ষে সরব হওয়ার বাইরে সাধারণত অন্য কোনো প্রকার রাজনৈতিক দায়িত্বের কথা এ দেশের লোকে ভাবতে চায় না। লোকে হীন স্বার্থান্বেষী ধূর্ত লোকদের তৈরি করা হুজুগে সহজে মাতে। নেতৃত্ব সৃষ্টিতে সাধারণ মানুষেরও যে দায়িত্ব আছে, এই কথাটাও কেউ চিন্তা করতে চায় না। রাজনীতিকে নিরাপদ ভাবতে না পেরে সবাই রাজনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ থেকে দূরে থাকাকেই শ্রেয় জ্ঞান করে। কেবল হীন স্বার্থান্বেষীরা রাজনীতিতে এগিয়ে যায়। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক পর্যায়ে অবস্থা অন্য রকমও দেখা গিয়েছে, এবং তখন বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে। সভ্য জগতে বাঙালি টিকে আছে এবং তার উন্নতির সম্ভাবনা আছে।
ভালো অর্থে সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার ঐতিহ্য নেই বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে। ভুলত্রুটি স্বীকার করার ও সংশোধন করার প্রবণতা এ দেশের রাজনীতিতে এখন দুর্লভ। সামরিক শাসনের জন্য রাজনীতিবিদরা, শাসক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা এবং সাধারণ লোকও কেবল সেনাপতিদের ক্ষমতালিপ্সাকেই দায়ী করেন, রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ও রাজনীতির দুর্বলতাকে বিবেচনায়ই ধরেন না।
১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকে সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলো রাজনীতিবিদদের দুর্বলতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অনুচিত কাজের সুযোগ নিয়ে সব ধরনের রাজনীতির ও সব ধরনের সরকারি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে সাধারণভাবে রাজনীতির প্রতিই জনসাধারণের মনকে বিষিয়ে দিয়েছে। এ কাজে বিবিসি রেডিও অত্যন্ত সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, সিএনএন, স্কাই নিউজ, আলজাজিরা—এসব প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশের স্বার্থে নয়, পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের বিশ্বগ্রাসী কার্যক্রমের সাফল্যের জন্য কাজ করে। এ কাজের জন্য দেশে-বিদেশে তাদের সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র ও গবেষণাপত্রও আছে।
আর অন্তর্বর্তীকালীন অরাজনৈতিক, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, তার সূত্র ধরে বাংলাদেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়ে ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদীরা। সংবিধানের সংশোধন (২০১১) দ্বারা অন্তর্বর্তীকালীন অরাজনৈতিক নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার পরেও আগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি শক্তি সক্রিয় আছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতির ভেতরে রাজনীতি শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং রাষ্ট্রের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে জনমনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সরকার ও আওয়ামী লীগ, বিএনপি প্রভৃতি রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদের নির্বাচন করার সামর্থ্যও রাখে না। এ অবস্থায় ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদীরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সব ব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কর্তৃত্ব বিস্তারের এই কার্যক্রমে ভারতও এখন তত্পর হয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে যে রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বাধীনতা ও উন্নতি ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না।
বাঙালি চরিত্রকে উন্নত করতে হলে বৈদিক যুগের আর্য ঋষিদের থেকে একালের চিন্তাশীলদের পর্যন্ত, দেশি-বিদেশি যে মনীষীরা বাঙালি চরিত্র সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন, তাঁঁদের সবার মতামতকেই যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে, এবং বিচার-বিবেচনা করে উন্নত নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির উপযোগী নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন কর্মসূচি, নতুন কর্মনীতি ও কার্যক্রম অবলম্বন করতে হবে। ইতিহাসের শিক্ষাকে যথোচিত গুরুত্ব না দিয়ে কখনো উন্নতির ধারায় উত্তীর্ণ হওয়া যাবে না। Neoliberalism-এর কার্যধারাকে পর্যায়ক্রমে পরিহার করতে হবে এবং স্বাধীনতা ও প্রগতির অনুকূল নীতিমালা ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
ইতিহাসে দেখা যায়, এ দেশে স্থানীয়ভাবে কিংবা জাতীয়ভাবে যখন মানুষ খুব বিপদে পড়েছে তখন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে কিংবা অভ্যুত্থানে ফেটে পড়েছে। অবস্থার চাপে বাধ্য হয়ে সাময়িকভাবে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু অবস্থার প্রবল চাপ যখন থাকেনি, তখনই ঐক্যের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে কলহ-কোন্দল, ঈর্ষা-বিদ্বেষ, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, অনৈক্য, বিভে`| Live and let other & live, Love and be loved, peaceful co-existence—এসব বোধ বাঙালি জীবনে অল্পই দেখা গেছে। গণবিক্ষোভ ও গণ-অভ্যুত্থানের প্রকৃতির সঙ্গে নেতৃত্বের প্রকৃতি বিচার করলে তাতেও রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনীতির দুর্বলতারই পরিচয় পাওয়া যায়। বিপ্লববাদী আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, মার্ক্সবাদী আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ও আন্দোলনগুলোর মতো বিরাট সব ঘটনার ও সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের চরিত্র বিচার করলে মূলত এটাই বোঝা যায়। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, বন্যা ইত্যাদির মধ্যে জনচরিত্রের যে পরিচয় প্রকাশ পায়, তাতে জনচরিত্রের সামান্য অংশই বোঝা যায়। জনচরিত্রকে বোঝার জন্য আপত্কালীন আচরণের চেয়ে সাধারণ অবস্থার আচরণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের মানুষ সঙ্গশক্তি গড়ে তোলায় নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ও রাষ্ট্র গঠনে দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে আসছে। এই দেশটাকে মধ্যযুগে শাসন করেছে তুর্কি-পাঠান-মোগলরা; আধুনিক যুগে ইংরেজরা; সবাই বিদেশি, বিভাষী, বিজাতি, বিধর্মী, বিজয়ী। পাকিস্তান আমলেও বাঙালিদের ওপর কৃর্তত্ব করেছে পাঞ্জাবিরা। বাংলাদেশকালে কী দেখা যাচ্ছে? রাজনীতিকে করে তোলা হয়েছে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোর অভিমুখী। এ দেশের মানুষ নিজেরা, নিজেদের থেকে, নিজেদের জন্য কল্যাণকর নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারছে না। এ রকম রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে কোনো রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতি অসম্ভব। উন্নত রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। তার জন্য নতুন চিন্তা ও নতুন আয়োজন লাগবে।
যাঁরা এখন ক্ষমতায় আছেন, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে তাঁদের যথেষ্ট সন্তুষ্ট দেখা যায়। যেসব দল এখন জাতীয় সংসদে নেই, তাদের মধ্যে চলমান রাজনীতি নিয়ে অসন্তোষ দেখা যায়। তারা পরিবর্তন চায়। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক আচরণে কেবল দুর্বলতাই প্রকটিত হয়। দুর্বলরা প্রবলদের সঙ্গে পারে না। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অধিকাংশই এনজিও ও সিএসওতে সক্রিয়। তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তায় ও রাজনৈতিক তত্পরতায় বাংলাদেশ নিঃরাজনীতিকৃত হয়। নিঃরাষ্ট্রকরণের (anarchism) কার্যক্রম চালাচ্ছে বিশ্বায়নবাদীরা। বিশ্বায়ন তো সাম্রাজ্যবাদেরই উচ্চতর স্তর। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ন্যাটো, জি-সেভেন, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়—এগুলোই তো বিশ্বায়নের কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা চলছে, তাতে রাজনীতির উন্নতি গতানুগতিক চিন্তা ও গতানুগতিক কাজ দিয়ে হবে না।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়