<p>শিল্পোন্নয়নেই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। বর্তমানে এ খাত থেকে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাত্র ২০ শতাংশ আসছে (পোশাকশিল্প বাদে)। ২০১০ সালের শিল্পনীতিতে তাই এ খাতের অবদান ২০২১ সাল নাগাদ ৪০ শতাংশে উন্নীত করার আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে। তবে এটা শুধু বেসরকারি খাতের ওপর ভরসা করে অর্জন করা সম্ভব নয়। সরকারি খাতকেও এ প্রক্রিয়ায় শক্তভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। অবশ্য শিল্পনীতিতে সরকারি খাতের ওপরও সমান গুরুত্ব আরোপের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে কিন্তু তার প্রতিফলন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। সরকারি খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তার দ্রুত সমাধান করতে হবে। আধুনিকায়ন করতে হবে। যেখানে প্রয়োজন আরো বেশি উৎপাদনশীল যন্ত্রপাতি বসাতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অব্যবহৃত জমি, পুকুর ইত্যাদির অর্থনৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পণ্যের গুণগতমান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি নিয়োগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের হস্তক্ষেপ চিরতরে বন্ধ করতে হবে। সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দস্তুরমতো প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে।</p> <p>বঙ্গবন্ধুর আমলে আমদানি বিকল্প শিল্পনীতি করা হয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো অন্য অনেক কিছুর মতো এটাকে নির্বাসনে পাঠায়, যা আমাদের শিল্পোন্নয়নের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল বলা যায়। সাম্রাজ্যবাদীদের পরামর্শে আমদানি বিকল্প শিল্পনীতি বাদ দিয়ে তারা রপ্তানিতাড়িত শিল্পনীতি অনুসরণ করে। ফলে আমাদের দেশ আমদানিনির্ভর দেশে পরিণত হয়। রপ্তানি মূলত তৈরি পোশাকনির্ভর ছিল, যার প্রায় সব কিছুই (মেশিনপত্র, জিপার, বোতাম, সুতা, কাপড়, এমনকি অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তি) আমদানি করতে হতো। তার মানে এ ক্ষেত্রে খুব সামান্যই মূল্য সংযোজন হতো (২০ শতাংশের মতো)। পোশাকশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিনপত্র ও কাঁচামাল আমদানির বিল পরিশোধে এর রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যয় হয়ে যেত। ১৯৭৮ সালে পোশাকশিল্পের যাত্রা শুরু। অথচ ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এর ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ নিয়ে কোনো চিন্তাই করেনি এ সময়ের সরকারগুলো। নেওয়া হয়নি প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার কোনো পদক্ষেপ। ২০০৯-১৪ সময়ে তো পুরোদস্তুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। এ পদক্ষেপগুলোর ফলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো অনেক কিছু করতে হবে। এখানেই বঙ্গবন্ধুর আমদানি বিকল্প শিল্পনীতি আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়, পথ দেখায়। পোশাকশিল্পের যন্ত্রপাতি, মেশিনপত্রসহ সব ধরনের ভারী মৌলিক শিল্পজাত পণ্য আমরা এখনো প্রায় পুরোটাই আমদানি করছি। এমনকি কম্পিউটারসহ যাবতীয় আইসিটি ও মোবাইল প্রযুক্তিজাত পণ্যও আমরা আমদানি করে চলেছি। আমাদের এখন যুগোপযোগী করে নতুন শিল্পনীতি রচনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে।</p> <p>সরকারি ও বেসরকারি খাতকে অবশ্যই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে তৎকালীন সরকারগুলোর ঢালাও বাজার অর্থনীতি তথা বেসরকারি খাতের বিকাশের অবাধ নীতির সুযোগে আমাদের দেশের তথাকথিত পুঁজিপতিরা সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বিচারে এক লুণ্ঠনযজ্ঞ চালায়। সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি, উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগও তেমন একটা করেনি। সরকারি ব্যাংকের ঋণ নিয়ে সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান কিনে নিয়েছে পানির দামে। সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান কিনে নিয়ে তারা সেগুলো লাভজনকভাবে চালানোর কোনো উদ্যোগ তো নেয়ইনি; বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলোর জমি, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি স্থায়ী সম্পদ উচ্চ দামে বিক্রি করে দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং ২০০৯-১৪ সময়ে বর্তমান মহাজোট সরকার অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান পুনরায় সরকারি খাতে ফেরত নিয়েছে। বন্ধ ও চলমান সব সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে চীনের অভিজ্ঞতার আলোকে লাভজনকভাবে চালানোর জন্য যা যা করণীয় তা অতি দ্রুতই সুপরিকল্পিতভাবে করতে হবে।</p> <p>আমরা গড়ে তুলেছি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল। আর চীনারা গড়ে তুলেছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এই দুইয়ের মধ্যে পরিমাণগত ও গুণগত পার্থক্য রয়েছে। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে শুধু রপ্তানির জন্য উৎপাদন করা হতো। প্রথম দিকে এখানে উৎপাদিত পণ্য অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি করা নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অভ্যন্তরীণ বাজারে অন্তত ৪০ শতাংশ পণ্য বিক্রি করা যাবে মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়। করমুক্তি, শুল্ক রেয়াত ইত্যাদি সুবিধা এখানে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়। এত এত রেয়াত দেওয়া সত্ত্বেও আমরা কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ পাইনি একমাত্র প্লটসহ যাবতীয় সেবা প্রদানে দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্নীতির কারণে (ঘুষ ছাড়া কোনো সার্ভিস না পাওয়া)। আশির দশকের গোড়ার দিকে চীনারা উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের অঞ্চলগুলোতে মোট ১৪টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলে। এগুলো সফল হলে তারা নব্বইয়ের দশকে মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে তা ছড়িয়ে দেয়। চীনের আদলে আধুনিক অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা গড়ে তুলতে হবে এবং ‘ওয়ান স্টপ’ সেবা চালু করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়াকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হবে।</p> <p>পোশাকশিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ নয়। হাইটেক প্রোডাক্ট হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ মূল্য সংযোজনের সুযোগ বেশি—এ ধরনের শিল্পায়নে আমাদের যেতেই হবে। সরকারি ও ব্যক্তিগত এ দুই খাতেই ক্ষুদ্র ও ভারী যন্ত্রপাতি, গাড়ি-বাস, লোকোমোটিভ ওয়াগন, কম্পিউটার-ল্যাপটপ, ফোনসেট-মোবাইল ইত্যাদি শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি টেকসই শিল্পোন্নয়নের জন্য অবশ্যই শিক্ষার সঙ্গে উৎপাদনের সরাসরি সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যা চীনারা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছে। চীনারা দেশব্যাপী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর খোলনলচে পাল্টে ফেলেছে, গড়ে তুলেছে অসংখ্য বিশ্বমানের গবেষণাগার। আর এ কারণেই তারা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে নিজ ব্র্যান্ডের পণ্য নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করছে। মেধাস্বত্ব ও পেটেন্টের ক্ষেত্রে চীনারা বিশ্বে এখনই তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে। শিল্পায়নে গবেষণার ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে উৎপাদনের সঙ্গে শিক্ষার সরাসরি সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। নিজস্ব ব্র্যান্ডের পণ্য নিয়ে দেশি ও বিদেশি বাজারে প্রবেশ করতে হবে। আমাদের স্লোগান এ ক্ষেত্রে হবে, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ও ‘ডিজাইন্ড ইন বাংলাদেশ’।</p> <p>সরকারি খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই সহযোগিতা দিতে হবে। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কেনাকাটার ক্ষেত্রে সরকারি খাতের শিল্পজাত পণ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে। খাদ্যশস্যসহ বেশ কিছু পণ্য মোড়কীকরণের ক্ষেত্রে সরকার ইতিমধ্যেই পাটজাত ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে বটে, তবে এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এটা বাস্তবায়নে অবশ্যই সরকারকে আন্তরিক এবং আরো তৎপর হতে হবে। পরিবেশ ও পাট খাতের স্বার্থে সরকারকে অবশ্যই এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টি নিয়ে সরকার ভাববে কি?</p> <p>লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>moazzem_hossainkhan@yahoo.com</p>