<p>‘যশোরের যশ খেজুরের রস’ প্রবাদ বাক্যটি বহুল প্রচলিত। তা ছাড়া ‘বউ ঠিলে ধুয়ে দে, গাছ কাটতি যাবো/সন্ধ্যি রস পাইড়ে আইনে জাউ রাইন্দে খাবো’—এমন কথার গান শীত এলেই যশোরের গ্রামাঞ্চলের মাঠেঘাটে শোনা যায়।</p> <p>শত শত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে খেজুরের রস, গুড় ও পাটালি। এই ইতিহাসকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন যশোর ব্র্যান্ডিংয়ের স্লোগান নির্বাচন করেছে, ‘নানা রঙের ফুলের মেলা, খেজুর গুড়ের যশোর জেলা।’</p> <p>যশোরে এখন গাছি খেজুর গাছ কাটা নিয়ে দিনভর ব্যস্ত। রসের ভাঁড় কাঁধে নিয়ে ছুটে চলছে দুরন্ত কিশোর। মাঘের হাড়কাঁপানো শীতে নলেন পাটালির সৌরভে ম ম করছে যশোরের হাটবাজার, গৃহস্থ বাড়ির উঠান। আত্মীয়-স্বজনের জন্য রস পিঠা, পাকান, ভাপা পিঠা বানানোর ধুম পড়েছে। যশোর থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে শত শত কেজি গুড় দেশ-বিদেশে যাচ্ছে। যশোর শহরের এইচএমএম রোডজুড়ে পাটালি গুড়ের পসরা সাজিয়ে যেন মেলা বসিয়েছে গৃহস্থরা। ১৩০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা কেজি নলেন পাটালি বিক্রি হচ্ছে।</p> <p>সরেজমিনে যশোর সদর উপজেলার মনোহরপুর মাঠে গিয়ে দেখা যায়, কুয়াশা ভেঙে গাছি খেজুর গাছ থেকে রস নামিয়ে আনছে। প্রবীণ গাছি আবু খায়ের বিশ্বাসের ৪০টি গাছ রয়েছে। তিনি গড়ে প্রতিদিন ২০টি গাছ কেটে রস নামান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটছি। রসও বিক্রি করি, গুড়ও বিক্রি করি। তবে এখন আর আগের মতো লাভ নেই। জ্বালানির খুব সংকট। এ জন্য পাটালি তৈরি করে পড়তা হয় না।’</p> <p>এনায়েতপুর গ্রামের ইউপি সদস্য ইনছার আলী বলেন, ‘শীতে রসের জাউ, রস পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে। আমরা খেজুর গুড় দিয়ে তৈরি পিঠা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি পাঠাই।’ </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/Print- 2018/01 January/29-01-2018/Kalerkantho_18-01-29-08.jpg" style="float:right; height:789px; margin:8px; width:300px" />যশোর শহরের সোনাপট্টিতে পাটালি বিক্রির সময় কথা হয় এনায়েতপুর গ্রামের গাছি আকবর আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শীতে বাড়তি আয়ের জন্য আমরা গাছ কাটি। ভোর থেকে রস জাল দিয়ে পাটালি তৈরি করি। দুপুরের পর গুড় বিক্রির জন্য যশোর শহরে নিয়ে যাই। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ কেজি পাটালি বিক্রি করে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা লাভ হয়।’</p> <p>ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ‘১৯০০-১৯০১ সালে পূর্ববঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ মণ। এর মধ্যে শুধু যশোরেই তৈরি হয়েছে ১৭ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ মণ। ১৮৬১ সালে উপজেলার কপোতাক্ষ নদের পারে তাহিরপুরে প্রথম খেজুরের গুড় উৎপাদনের যান্ত্রিক কারাখানা গড়ে তোলা হয়। ওই কারখানার উৎপাদিত গুড় তখন ইউরোপে রপ্তানি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যশোরের বিভিন্ন গ্রামে ১১৭টি কারখানা গড়ে ওঠে। সময়ের পরিক্রমায় সাদা চিনির কাছে লালচে রঙের এই গুড় পরাজিত হয়। ১৯০০ সালের দিকে এই গুড় দিয়ে কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টির দোকান ভীমনাগ সন্দেশ তৈরি করা শুরু করে। যশোরের নলেন গুড়ের সেই সন্দেশ এখনো কলকাতা মাত করে রেখেছে।</p> <p>গাছি ও জ্বালানি সংকটে যশোরের ঐতিহ্যবাহী সেই খেজুর গুড় হারিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অসৎ ব্যবসায়ীরা খেজুর গুড়ে চিনি মেশানোর কারণে চিরচেনা সেই মিষ্টি স্বাদও আর থাকছে না।</p> <p>কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, যশোরে সাত লাখ ৯১ হাজার ৫১৪টি খেজুর গাছ রয়েছে। এসব গাছ থেকে প্রতিবছর চার হাজার ৬৪০ মেট্রিক টন গুড় ও ৪০ মেট্রিক টন রস উৎপাদিত হয়। এখন যশোরের খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য রক্ষায় বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাড়াও জেলা প্রশাসন এগিয়ে এসেছে। গত দুই বছর ধরে যশোরের চারুপীঠে খেজুর গুড়ের মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেলার আয়োজক মাহবুব জামাল শামীম বলেন, ‘আমরা মনে করি, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় যশোরের গুড় হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।’</p> <p>যশোরের জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘ফুল আর খেজুর গুড় দিয়ে আমরা জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের স্লোগান নির্বাচন করেছি। যশোরের ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড়ের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’</p>