কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে না পারায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রতিষ্ঠান ‘বিনিময়’-এর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব কিছু ঠিক থাকলে মার্চের মধ্যেই বিদেশি একটি কম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংক এবং এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটরে টাকা পাঠানোর এই সেবা দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র।
দেশের প্রথম ইন্টার অপারেবল ডিজিটাল ট্রানজেকশন প্ল্যাটফর্ম বিনিময়। ভারতের ইউনাইটেড পেমেন্ট ইন্টারফেসের (ইউপিআই) আদলে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠান এখন বন্ধ হওয়ার পথে। সরাসরি মালিকানায় না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্যোক্তা সজীব ওয়াজেদ জয়। কারিগরি ত্রুটির অজুহাতে চালু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানটিকে আর টানতে চাচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ জন্য চুক্তি বাতিলের আইনি জটিলতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সূত্র বলছে, যদি জটিলতা না থাকে, দ্রুত সময়ের মধ্যেই বাতিল হবে বিনিময়ের সঙ্গে হওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চুক্তি। তবে কোন মাসে এটা বাতিল হবে তা বলা যাবে না। ইন্টার অপারেবল ডিজিটাল ট্রানজেকশনের জন্য নতুন ফরম্যাটে নতুন চিন্তা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কিন্তু সেটি কী ফরম্যাটে হবে বা এনপিএসবির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকবে কি না, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এদিকে গত ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, “মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) আন্ত লেনদেন পরিচালনার জন্য বিনিময় নামের যে প্ল্যাটফর্ম করা হয়েছিল, সেটি ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের শেল কম্পানি। এমএফএসে আন্ত লেনদেনব্যবস্থা এগোতে না পারার একটা বড় কারণ, এটি আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেওয়া হয়েছিল।’
২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় বিনিময় অ্যাপের, যার মাধ্যমে বিকাশ, রকেটসহ ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আন্ত লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে এখন। কিন্তু এই অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ এখনো আশানুরূপ নয়।
কারণ মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেসের (এমএফএস) মাধ্যমে যেখানে প্রতিদিন পাঁচ হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে, সেখানে বিনিময়ে দৈনিক লেনদেন ৩০ লাখ টাকার মধ্যে। খরচ কম হলেও গত দুই বছরের বেশি সময়ে খুব বেশি এগোয়নি উদ্যোগটি।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ জুন ৭৫৩টি লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে বিনিময়ের মাধ্যমে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ছিল ৩০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই হিসাবে পুরো মাসের লেনদেন দাঁড়াবে ৯ কোটি ১৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, এমএফএসের এক অ্যাপ থেকে অন্য অ্যাপে টাকা স্থানান্তর করা যায় না। অথচ বিষয়টি খুবই জরুরি। এখন বিনিময়ের মাধ্যমে বিকাশ থেকে রকেটে বা রকেট থেকে বিকাশে টাকা পাঠানো যায়। শুধু তা-ই নয়, বিকাশ বা বিভিন্ন এমএফএস সেবা থেকে বিভিন্ন ব্যাংকেও টাকা পাঠানো যায়। তার পরও আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ দেশের সব ব্যাংক ও এমএফএস এখনো বিনিময়ের ছাতার আওতায় আসেনি। তা ছাড়া বিনিময় অ্যাপ দিয়ে ব্যাংক ও এমএফএস থেকে অন্য এমএফএসে টাকা স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি জটিল, সময়সাপেক্ষ ও দীর্ঘ। তা ছাড়া মাঝেমধ্যেই পড়তে হয় সার্ভার সমস্যায়।
২০২০ সালের অক্টোবরে এক প্রজ্ঞাপনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছিল, সফলভাবে পাইলট টেস্টিং সম্পন্নকারী ব্যাংক ও এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ওই বছরের ২৭ অক্টোবর থেকে ইন্টার-অপারেবিলিটি বা পারস্পরিক লেনদেনসুবিধা চালু করা হবে। তবে তখন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে এ সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এতে খরচ হয় প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ (আইডিয়া) প্রকল্প বিনিময় সেবা তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংককে বুঝিয়ে দেয়। তবে এতে লেনদেন তেমন হচ্ছে না। কারণ সেবাগ্রহীতা সবাইকে পৃথকভাবে বিনিময়ে নিবন্ধন করতে হয়। পাশাপাশি এতে মাশুলও দিতে হয়। বিনিময় অ্যাপের কাজের সঙ্গে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ছেলে জারেফ হামিদ যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘নগদ টাকা সরবরাহে প্রতিবছর সরকারকে কয়েক শ কোটি টাকা খরচ করতে হয়। আবার টাকার মাধ্যমে বিভিন্ন জীবাণুও ছড়িয়ে পড়ে। এ জন্য আমাদের ধীরে ধীরে অনলাইন লেনদেনের দিকেই যেতে হবে। ইন্টার-অপারেবিলিটি আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা সেই সুবিধাটা ঠিকঠাকমতো পাচ্ছি না।’
তথ্য বলছে, সব ব্যাংক, মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেস এবং পেমেন্ট সার্ভিস প্রভাইডারসহ (পিএসপি) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লেনদেনে ইন্টার-অপারেবিলিটি নিশ্চিত করতে বিনিময় চালু করা হয়েছিল। গ্রাহকরা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন করে ভার্চুয়াল আইডি তৈরি করে সহজেই অর্থ লেনদেন করতে পারত। এই অ্যাপে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিন স্তরের সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে।
ভারতের ইউপিআইয়ের আদলে গড়ে ওঠা প্ল্যাটফর্মটির সঙ্গে প্রাথমিকভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল ১১টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আটটি ব্যাংক ও তিনটি এমএফএস। মূলত চারটি প্রতিষ্ঠান এই প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ করে। প্রতিষ্ঠান চারটি হলো ওরিয়ন ইনফরমেটিকস লিমিটেড, মাইক্রোসফট বাংলাদেশ লিমিটেড, ফিনটেক সল্যুশন লিমিটেড ও সেইন ভেঞ্চারার্স লিমিটেড।