<p>বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের ১৫ কর্মকর্তাকে সন্দেহের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে সন্দেহের তালিকায় থাকা অন্তত ১০ জনের দুই ধরনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলেও রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার প্রমাণ মেলেনি। সম্পৃক্ততা দুটি হলো দায়িত্বে অবহেলা ও ঊর্ধ্বতনদের অবগত না করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ অন্তত ১২০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং বেশ কিছু আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষা করে তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সংঘবদ্ধ অপরাধ দল। তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।</p> <p>সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্তকাজ প্রায় ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগামী মে মাসের আগেই অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিলের চেষ্টা চলছে। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় এ পর্যন্ত ফিলিপাইনের ৩০ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে; যাঁরা ফিলিপাইনের বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা ও ভুয়া হিসাবধারী। রিজার্ভ চুরির মামলায় তাঁদের কয়েকজনকে সাক্ষী করা হবে। অন্যদের আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। এ ছাড়া হংকং, ম্যাকাওয়ের ২৩ জন জুয়াড়িসহ চীন, জাপান ও শ্রীলঙ্কার বেশ কয়েকজনের নাম-পরিচয় পেয়েছে সিআইডি। বাংলাদেশের সন্দেহভাজনদের ব্যাপারে যাচাই-বাছাইয়ের পাশাপাশি দেশের বাইরেও শেষ সময়ের তদন্ত চালাচ্ছে সিআইডি। তদন্তের প্রয়োজনে এই ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) মোল্লা নজরুল ইসলাম ও তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান বর্তমানে ফিলিপাইনে অবস্থান করছেন।</p> <p>এমন পরিস্থিতিতে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ রবিবার। ‘সুইফট  মেসেজ হ্যাকিংয়ের’ মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৮৮০ কোটি টাকা) চুরি হয়। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৬ সালের ৪ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। তবে ঘটনাটি জানাজানি হয়েছে এক মাস পর। রিজার্ভ চুরির এই অর্থের মধ্যে ২০ মিলিয়ন ডলার চলে যায় শ্রীলঙ্কায়, যা পরে বাংলাদেশকে ফেরত দেওয়া হয়। বাকি ৮১ মিলিয়ন ডলার চলে যায় ফিলিপাইনে। সেখানে রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) মাধ্যমে এই অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তর করে জুয়ার টেবিল হয়ে বের করে নিয়ে যায় হ্যাকাররা। ওই অর্থের মধ্যে দেড় কোটি (১৫ মিলিয়ন) ডলার ফেরত দিয়েছে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জুয়ার এক ক্যাসিনো মালিক তদন্তের চাপে পড়ে তা ফেরত দেন।</p> <p>ঘটনা জানাজানি হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ও বাজেট শাখার যুগ্ম পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা মতিঝিল থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ (সংশোধনী ২০১৫)-এর ৪-সহ তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৪ ধারায় ও বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ৩৭৯ ধারায় একটি মামলা করেন। এতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। বহুল আলোচিত সংবেদনশীল এই মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় সিআইডিকে।</p> <p>২৯ জানুয়ারি ফিলিপাইনে যাওয়ার আগে গত ২৭ জানুয়ারি এসএস মোল্লা নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রিজার্ভ চুরির মামলা তদন্তে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এটি একটি ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম। এ মামলার অনেক পার্ট রয়েছে। এগুলো এক সুতায় মেলাতে অনেক সময় লাগছে।’</p> <p>সিআইডির আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘দুই বছরে মামলার ৮০ শতাংশ তদন্ত শেষ হয়েছে। আগামী মে মাসের আগেই চার্জশিট দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সুইফট শাখাসহ বিভিন্ন শাখার উদ্ধার করা আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়েছে। সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ ১২০ জন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। চার্জশিটে দেশি ও বিদেশিদের তিন ভূমিকার কারণে অভিযুক্ত করা হবে। দায়িত্বে অবহেলা ও ঊর্ধ্বতনদের অবগত না করার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত ১০ জনকে অভিযুক্ত করা হতে পারে। জালিয়াতির সঙ্গে তাঁরা সরাসরি জড়িত কি না, তা-ও যাচাই করে দেখা হচ্ছে।’</p> <p>জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, সঠিকভাবে তদন্ত ও প্রমাণের জন্য অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তবে চার্জশিট চূড়ান্ত হলে কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলেও জানান তিনি।</p> <p>সূত্র মতে, সন্দেহভাজনদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক একজন উপপরিচালক (ডিডি), একজন সহকারী পরিচালক (এডি), একজন ডিজিএম, ব্যাক অফিস অব দ্য ডিলিং রুমের এক নারী কর্মকর্তাসহ ছয়জন, পেমেন্ট অফিসের একজন কর্মকর্তা, অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেট শাখার সাবেক এক কর্মকর্তা, বাজেট শাখার সহকারী পরিচালক পদের একজন কর্মকর্তা এবং গভর্নরের সচিবালয়ের তিন কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে ১০ জনের সম্পৃক্তা পাওয়া গেছে।</p> <p>এদিকে এ ঘটনায় চীন, জাপান ও শ্রীলঙ্কার সন্দেহভাজন কয়েকজনের নাম-পরিচয়ও পেয়েছে সিআইডি। রিজার্ভ চুরির কোনো না কোনো পর্যায়ে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা ছিল। তাঁদের পূর্ণাঙ্গ নাম ও ছবিসহ তথ্য সরবরাহ করতে ওই দেশগুলোকে তদন্তে সহায়তার অনুরোধ করা হয়েছে। অভিযুক্তরা হচ্ছেন জাপানের নাগরিক সাসাকিম তাকাশি ও জয়দেবা, আরসিবিসি ব্যাংকের জুপিটার শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতো, ফিলিপাইনের ক্যাসিনো ইস্টার্ন হাওয়াই লেইসার কম্পানির মালিক চীনের নাগরিক কিম ওং, চার হ্যাকার মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগোরাস, আলফ্রেড ভারগারা ও এনরিকো তায়েদ্রো ভাসকুয়েজ।</p> <p>তালিকায় রয়েছেন রেমিট্যান্স আহরণকারী কম্পানি ফিলরিমের  প্রেসিডেন্ট স্লুইড বাতিস্তা, ফিলিপাইনের ব্যবসায়ী উইলিয়াম গো সো, শ্রীলঙ্কার এনজিও শালিকা ফাউন্ডেশনের পরিচালক গামাজ শালিকা পেরেরা, সানজেবা টিসা বান্দরা, শিরানি ধাম্মিকা ফার্নান্দো, ডন প্রসাদ রোহিতা, নিশান্থা নালাকা ও ওয়ালাকুরুয়ারাচ্চি।</p> <p>এদিকে সম্প্রতি মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির রিজার্ভ চুরি প্রসঙ্গে বলেন, “বিষয়টি বিভিন্ন ধাপে বিচারাধীন। এ পর্যন্ত আমরা ফেরত পেয়েছি এক কোটি ৪৪ লাখ ডলার। এ ছাড়া আরো ১২ লাখ ডলার ফিলিপাইন সরকার ‘অ্যাসেট প্রিজারভেশন’ অর্ডার দিয়েছে। ওই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংককে ফেরত দেওয়ার জন্য প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া আরো ৬০ লাখ ডলার উদ্ধারের বিষয়ে অগ্রগতি আছে। আর সিআইডির যে প্রতিনিধিদলটি ফিলিপাইনে রয়েছে, আশা করছি তারা কিছু অগ্রগতির খবর নিয়ে আসবে।”</p>