<p>নতুন বইয়ের গন্ধ! সদ্যঃপ্রকাশিত বইটির মলাট ওল্টাতেই যেন নাসারন্ধ্রে সুবাস ছড়ায় একেবারে ভিন্ন ধরনের সেই ঘ্রাণ। লেখক তো বটেই, বইটির প্রকাশক-পাঠককেও আন্দোলিত করে তা। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ আঙিনায় হালকা হিমেল বাতাসে গতকাল বৃহস্পতিবার ভেসে বেড়াচ্ছিল নতুন বইয়ের উতলা গন্ধ। নতুন বইয়ের টানে আগতরা স্টলে স্টলে ঘুরে সদ্যঃপ্রকাশিত বইটি দেখছে; কিনছে প্রিয় লেখকের বই। বই কেনার ফাঁকে মেতে উঠছে আড্ডায়। শুধু বই ঘিরে মানুষের এক বিরল সম্মিলন। বলা বাহুল্য, এই দৃশ্য বাঙালির প্রাণের উৎসব অমর একুশে বইমেলার।</p> <p>বইমেলার দুই ভেন্যু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রথম দিনেই মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছে পাঠকরা। লেখক, প্রকাশক, আয়োজক—সবার আনন্দমুখর সংযোগ ঘটিয়ে যাত্রা শুরু করল মাসব্যাপী একুশের বইমেলা। আজ শুক্রবার মেলার দ্বিতীয় দিন। এদিন মেলার দ্বার খুলবে সকাল ১১টায়। নিরবচ্ছিন্নভাবে চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। প্রথম শুক্রবারই শিশুপ্রহর ঘোষণা করেছে বাংলা একাডেমি। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিশুপ্রহরে অভিভাবকদের হাত ধরে মেলায় ভিড় জমাবে শিশুরা।</p> <p>বইমেলার প্রথম দিন গতকাল পাঠকের ভিড় সেভাবে চোখে পড়েনি। তাই বলে ম্রিয়মাণ হয়নি চেতনার সাক্ষ্যবহ এই মেলা। শীতের বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই অসংখ্য বইপ্রেমীর আগমনে সরব হয়েছে মেলা প্রাঙ্গণ। আর সন্ধ্যায় পূর্ণিমা পক্ষের আলোয় মেলা পেয়েছে স্নিগ্ধ রূপ। প্রাণ ও মননের মেলার সঙ্গে আত্মসংযোগ ঘটিয়েছে বই অনুরাগীরা। ঝকঝকে মলাটের সদ্য বেরোনো বইয়ের সন্ধানে তারা ঘুরেছে স্টলে স্টলে। খুঁজেছে পছন্দের লেখকের গল্প, কবিতা কিংবা উপন্যাস।</p> <p><strong>চালু হয়নি অর্ধশতাধিক স্টল :</strong> গতকাল মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, অর্ধশতাধিক স্টল এখনো পরিপূর্ণভাবে চালু হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে বাঁধন পাবলিশার্স, প্রতিভা প্রকাশ, মধ্যমা, রাতুল গ্রন্থপ্রকাশ, টুম্পা প্রকাশনী, সিঁড়ি প্রকাশন, রেয়ার বুকস, জ্যোতিপ্রকাশ, আলীগড় লাইব্রেরি, আলোর ভুবন, কামরুল বুক হাউজ, তরফদার প্রকাশনী। কিছু স্টলে চলছে রঙের কাজ। এ ছাড়া মেলা প্রাঙ্গণে ইতিউতি ছড়িয়ে আছে স্টলসজ্জায় ব্যবহৃত নানা সরঞ্জাম। ক্রেতা-দর্শনার্থীদের জন্য চালু হয়নি টয়লেট। পাশাপাশি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বহেড়াতলায় লিটলম্যাগ চত্বরেও চালু হয়নি কোনো স্টল।</p> <p>মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমেদ বলেন, ‘মেলার নীতিমালা অনুযায়ী ৩০ জানুয়ারির মধ্যে মেলার স্টলসজ্জার কাজ শেষ করার কথা। আজ শুক্রবারের মধ্যে স্টল চালু না করলে নীতিমালা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব। আর লিটলম্যাগ চত্বরটি প্রথমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিল। পরে এর স্বত্বাধিকারীদের দাবির মুখে সেটি বহেড়াতলায় স্থানান্তর করা হয়। তবে শুক্রবারের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে।’</p> <p>প্রথম দিনের মেলা নিয়ে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘কিছুটা অগোছালো রয়েছে মেলা। তবে স্টলের বিন্যাস ও আলোর ব্যবস্থা সুন্দর হয়েছে। আশা করছি, সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান হবে।’</p> <p>প্রথম দিনেই মেলায় এসেছিলেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। অনন্যার প্যাভিলিয়নে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভক্ত-অনুরাগীদের অটোগ্রাফ দেন তিনি। পরে মেলা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসলে প্রথম দিনেই বোঝা কঠিন মেলার প্রকৃত রূপটি। কারণ এখনো অনেক স্টলই গোছানো হয়নি। তার পরও প্রথম দিন মেলায় এসে মনে হচ্ছে এবারের মেলা বিগত বছরের তুলনায় আরো ভালো হবে। কারণ এবার মেলার পরিসর বেড়েছে। দিন যত যাচ্ছে মেলার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।’</p> <p><strong>মেলার টুকিটাকি তথ্য :</strong> এবার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাঁচ লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বইমেলা। ২৪টি প্যাভিলিয়নে সজ্জিত হয়েছে বাংলা একাডেমির ২৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে ৪৫৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭১৯টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একাডেমির বহেরাতলায় ১৩৬টি লিটল ম্যাগাজিনকে লিটল ম্যাগাজিন কর্নারে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ২৫ শতাংশ মূল্যছাড়ে বই বিক্রি করবে।</p> <p><strong>প্রথম দিনের নতুন বই :</strong> মেলার তথ্যকেন্দ্র উন্মুক্ত না হওয়ায় একাডেমির সমন্বয় ও জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে প্রথম দিনে প্রকাশিত নতুন বইয়ের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন স্টল ঘুরে বেশ কিছু নতুন বইয়ের খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে রয়েছে—কথাপ্রকাশ থেকে যতীন সরকারের ‘মুক্তিযুদ্ধের চড়াই উতরাই’ ও ইমতিয়ার শামীমের ‘কাল অকাল’, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ থেকে হাসান আজিজুল হকের ‘আমার ইলিয়াস’, ঐতিহ্য থেকে নূরুল আনোয়ারের ‘মেজর জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড : দুর্যোধনটি কে?’, তাম্রলিপি থেকে বুলবুল সারওয়ারের ‘মহাভারতের পথে : এক’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘সাইক্লোন’, গুলতেকিন খানের ‘চৌকাঠ’ ও আহসান হাবীবের ‘সত্যি অ্যাডভেঞ্চার’; অবসর থেকে হুমায়ূন আহমেদের ‘সেরা সাত মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস’, কাকলী প্রকাশনী থেকে সুমন্ত আসলামের ‘তুমি আছো তাই’, অনিন্দ্য থেকে আহমদ রফিকের ‘কবিতার বিভিন্ন ভাষা’, প্রথম থেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘পিতার হুকুম’ ও মোহাম্মদ গোলাম রব্বানীর ‘বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল : অবরুদ্ধ ৬৮ বছর’, আগামী থেকে হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘সময় অসময়’ এবং অনন্যা থেকে বেরিয়েছে ইমদাদুল হক মিলনের ‘একটি রহস্য উপন্যাস’। প্রথম দিনে প্রকাশিত চারটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের তথ্য-পরিচিতি তুলে ধরা হলো।</p> <p><strong>উৎকট তন্দ্রার নিচে :</strong> সৈয়দ শামসুল হকের শেষ কবিতার বই। পঞ্চাশের দশক থেকে হাতে গোনা যে কয়েকজন সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব এ দেশের সাহিত্যকে মহিমান্বিত করেছেন, তাঁদের অন্যতম একজন তিনি। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকসহ নানা মাধ্যমে তাঁর ছিল ঈর্ষণীয় সাফল্য। উপন্যাসে খ্যাতি অর্জন করলেও কবি হিসেবে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। জীবনের শেষ সময়ে লেখা তাঁর কবিতা নিয়ে এ বইটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ।</p> <p>ক্যান্সার আক্রান্ত কবি জীবনের অন্তিম সময়ে পৌঁছে নিয়মিত কবিতা লিখতেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় লেখা তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে জীবনের অনন্য বোধ ও দার্শনিক প্রজ্ঞার কথা। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির দাম ১৫০ টাকা।</p> <p><strong>নিসর্গকথা :</strong> বইটির লেখক সদ্যপ্রয়াত নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা। বিশ্বে প্রকৃতিপ্রেমী আছেন অনেকেই। কিন্তু তাঁর মতো জীবনভর প্রকৃতি নিয়ে মেতে থাকা মানুষ বিরল। শুধু প্রকৃতি নিয়ে মেতে থাকা নয়, আমৃত্যু লিখেছেন প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে। পুষ্প-বৃক্ষ আর লতাপাতা নিয়ে, প্রকৃতিকেন্দ্রিক সাহিত্য নিয়ে অনবদ্য বইটি মেলায় এনেছে অনিন্দ্যপ্রকাশ।</p> <p>বইটির পরতে পরতে উঠে এসেছে বৃক্ষের প্রতি এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বের অনুপম ভালোবাসার কথা। দ্বিজেন শর্মা আমৃত্যু ভালোবেসেছিলেন বৃক্ষের সবুজ সজীবতাকে। চেয়েছিলেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থান। বইটিতে উঠে এসেছে সেই মর্মকথা। বইটির সঙ্গে আছে সংশ্লিষ্ট রঙিন ছবি। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। ১৬৮ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ৩০০ টাকা।</p> <p><strong>একটি রহস্য উপন্যাস :</strong> শিরোনামেই বোঝা যায় এটি রহস্য উপন্যাস। লেখক কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় এই লেখক গল্প, উপন্যাসসহ নানা শাখায় উপহার দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু রচনা। বইটি প্রকাশ করেছে অনন্যা।</p> <p>উপন্যাসটি এতিমখানায় বড় হওয়া যুবক রবিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। তাতে উঠে এসেছে রোমাঞ্চকর এক আখ্যান। রবিকে একদিন এতিমখানা থেকে বের হয়ে যেতে হয়। কোথায় যাবে সে? কার কাছে যাবে? তারপর রহস্যময় এক গ্রামে পৌঁছে যায় সে। ঘটতে থাকে রহস্যময় নানা ঘটনা। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। ১৯২ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ৩০০ টাকা।</p> <p><strong>পৃথিবীর পথে হেঁটে :</strong> শহর ঢাকাতেই জন্মেছিলেন ভারতের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অলকনন্দা প্যাটেল। সে সুবাদে বাংলাদেশেই কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। সেই মধুর স্মৃতি আজও তাড়িত করে তাঁকে। বিশ্বময় ঘুরে বেড়ানো মানুষটি লিখেছেন স্মৃতিমথিত গ্রন্থ ‘পৃথিবীর পথে হেঁটে’। বইটিতে উঠে এসেছে ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে তাঁর পারিবারিক পরিমণ্ডলের কথা। ফুটে উঠেছে তৎকালীন বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির আবহ। বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স।</p> <p>বইটির ভূমিকা লিখেছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী রফিকুন নবী। ৪৪০ পৃষ্ঠার এ বইটির মূল্য ৬৫০ টাকা।</p> <p><strong>আজকের আয়োজন :</strong> আজ মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায়। চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় মেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘শহীদ নূতনচন্দ্র সিংহ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সজিব কুমার ঘোষ। আবদুল মান্নানের সভাপতিত্বে আলোচনা করবেন মহীবুল আজিজ, প্রফুল্লচন্দ্র সিংহ ও রাশেদ রউফ। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।</p>