<p>শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন সকালে স্কুলে পৌঁছেই তাদের ডিজিটাল আইডি কার্ড নির্ধারিত মেশিনে পুশ করে হাজিরা নিশ্চিত করে। হাজিরা নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকের মোবাইল ফোনে চলে যায় এসংক্রান্ত খুদে বার্তা। এতে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর নিয়মিত উপস্থিতি থাকে শতভাগ। একই পদ্ধতি বিদ্যালয় ত্যাগের ক্ষেত্রে। স্কুলটিতে রয়েছে একটি সততার দোকান। যেখানে দোকানদার ছাড়াই শিশুরা পণ্য কিনে মূল্য পরিশোধ করে সততার পরীক্ষা দেয়। পাশাপাশি মহানুভবতার দেয়াল নামের একটি বোর্ডে সচ্ছল শিক্ষার্থীরা ব্যবহার উপযোগী নতুন-পুরনো পোশাক টাঙিয়ে রাখে, যা দরিদ্র শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা করলেই বাড়ি নিয়ে ব্যবহার করতে পারে। গেট দিয়ে স্কুলে ঢুকতেই অভিভাবকদের জন্য রয়েছে ‘আনন্দ পাঠাগার’। শিশুদের জন্য অপেক্ষার সময় মায়েরা শিশুবিষয়ক গল্পের বইসহ বিভিন্ন বই পড়েন এই পাঠাগারে। বাড়িতে গিয়ে মায়েরা সেসব গল্প সন্তানদের শোনান, যা শিশুদের মেধা বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে।</p> <p>এসব শুধুই কথার কথা বা কাগজে-কলমে পরিকল্পনা নয়। বাস্তবেই এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেটি হলো মাগুরার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২৩টি উদ্ভাবনী শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে সত্যিকারের ডিজিটাল স্কুল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বিদ্যালয়টি। শিশুশিক্ষার উপযোগী ভালো শিখনের প্রয়োগ ও চর্চার ফলে এখানে মানসম্মত শিক্ষা যেমন নিশ্চিত হচ্ছে তেমনি শিক্ষার্থীদের মেধার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটছে ব্যাপকভাবে।</p> <p>স্কুলের শিক্ষার্থী আফজাল হোসেন, তন্ময় চক্রবর্তী, আবুল কালাম, সুমাইয়া ইয়াসমিন, দিপ্ত চক্রবর্তীসহ আরো বেশ কয়েকজন জানায়, তাদের প্রধান শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার নানা ধরনের আধুনিক পদ্ধতিতে এখানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এর মধ্যে ডিজিটাল হাজিরা, মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে ক্লাস, বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণের ব্যবহার অন্যতম। এগুলো তাদের শিক্ষা গ্রহণে ব্যাপকভাবে সহায়ক হচ্ছে।</p> <p>প্রধান শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার বলেন, ‘বর্তমান সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে আমাদের স্কুলে ২৩টি উদ্ভাবনী শিক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করছি। এটা বিদ্যালয়ের শিশুদের সামাজিক মূল্যবোধ, শারীরিক ও মানসিক মেধা বিকশিত হয়ে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।’</p> <p>ইয়াসমিন আক্তার জানান, আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১১ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর ২০১৪ সালে এলাকাবাসী ও প্রশাসনের সহযোগিতায় তিনি এসব কর্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু করেন। বিদ্যালয়ে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৭০২ জন ছাত্র-ছাত্রীকে এসব উদ্ভাবনী ও বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৫ জন শিক্ষক শিক্ষাদান করছেন। পাশাপাশি শিশুদের অভিভাবক ও বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন। বিদ্যালয়টি ২০১৫ সালে খুলনা বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায়। এ ছাড়া ২০১৭ সালের বিভাগীয় কমিশনারের ক্রেস্ট পেয়েছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে প্রতিবছরই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার থাকে শতভাগ।</p> <p>প্রধান শিক্ষক তাঁর উদ্যোগ সম্পর্কে জানান, বিদ্যালয়ে যেসব উদ্ভাবনী শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে সেগুলো হলো—স্কুল ডিজিটাল সার্ভিস পয়েন্ট স্থাপন, মাল্টিডাইমেনশনাল এসএমএস সার্ভিস, অনলাইন ভর্তি, ডিজিটাল হাজিরা ও ম্যাসেজিং সিস্টেম, ‘এই দিনে’ নামে দৈনন্দিন পাঠক্রমের তথ্য বোর্ড, সিসি ক্যামেরায় শ্রেণি পাঠদান পর্যবেক্ষণ, সততার দোকান, মহানুভবতার দেয়াল, অভিভাবক আনন্দ পাঠাগার, গুণীজন গ্যালারি, আলোকিত আচরণ সংগ্রহশালা, বিখ্যাত ব্যক্তি ও স্থাপনার নামে শ্রেণিকক্ষ ও শাখার নামকরণ, শিশুদের দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা, মিড ডে মিল, শিক্ষকদের ড্রেস কোড, বিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইট, স্কুল ডিজিটাল সার্ভিস পয়েন্ট, দেশপ্রেমের আয়না, ডিজিটাল ঘণ্টা, টিফিনের টাকা সঞ্চয় বক্স, যা দিয়ে কল্যাণকর কাজ করা হয়।</p> <p>স্কুলের শিক্ষক দীপংকর কুমার বিশ্বাস ও মিঠু রানী ব্যানার্জি জানান, ‘আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বছরের শুরুতেই দুর্বল শিশু শনাক্ত করে তাদের জন্য বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ছাড়া শপথ পাঠ, সামাজিক সবজিক্ষেত, প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিতি ঘটাতে বাস্তবভিত্তিক পাঠদান, সরকার নির্ধারিত সহশিক্ষা কার্যক্রম, কুইজ ক্লাব, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, উপকরণ কর্নার, গণিত ল্যাব, প্রতীকী চিড়িয়াখানাসহ দৈনিক সমাবেশে একটি করে নীতিবাক্য শেখানো হয়। শিক্ষার্থীদের ভারী ব্যাগ বহনে নিরুৎসাহিত করাসহ তিন কেজি ওজনের ব্যাগ বহনে নিষেধাজ্ঞা ও নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রাথমিক চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।</p> <p>বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মরশেদুল আলম জানান, আলোকিত মানুষ গঠনে শিশুদের জন্য নেওয়া উদ্ভাবনী এসব কর্যক্রম ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে।</p> <p>শালিখা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অরুণ চন্দ্র ঢালী বলেন, ‘উদ্ভাবনী সব কার্যক্রমের সুবাদে বিদ্যালয়টি আজ স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। এখানে এলাকাবাসী, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক, উপজেলা শিক্ষা অফিস, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে আসছেন। বিদ্যালয়টির সার্বিক উন্নতি কামনা করছি।’</p> <p>জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রুহুল আমীন বলেন, ‘শালিখা উপজেলার আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্যতিক্রমী কার্যক্রমের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের যেসব শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তা এককথায় অসাধারণ। জেলার অন্য তিন উপজেলার মডেল স্কুলগুলোতে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।’</p>