<p>ভরা বৈশাখে, বর্ষার মতো বজ্রগর্ভ মেঘের বৃষ্টির উৎপাতেও ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারের শতবর্ষী যুবক বৃক্ষে মহুয়া ও বাদুড়ের তুমুল উৎসব চলছে। বজ্র, বৃষ্টি ও হাওয়ার এই উৎসবে মহুয়ার সুরভি বুঝি বা নেই হয়ে আছে। বর্ষণ-মন্দ্রিত এমন উৎসবে মহুয়াগাছে মাঝরাত পর্যন্ত পাপিয়া বা কোকিল গান গেয়ে যেতেও পারে। অভিসারী হতে পারে কোনো মানব-মানবী রাতের অন্ধকারে। আকাশে তখন উসকানিমূলক জ্যোত্স্না ঢালতে পারে পৃথিবীর সুযোগ্য সন্তান কলানিপুণ চাঁদ ভাই। বসন্ত-বৈশাখী সুমন্দ হাওয়াও থাকতে পারে।</p> <p>চোখের সামনে যখন মহুয়া সন্ধের অবসরে ফুটছে তখন মত্ত না হয়ে কি থাকা যায়! আর হাওরের ধান পাকার স্বর্ণ সময়ে নেমে এলো বৃষ্টি ও উজানী ঢলের সংহার। এদিকে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য বসন্ত-গ্রীষ্মের মহুয়ার ফুল ও বৃক্ষ। লালচে কচি পাতায় সম্পূর্ণ গাছ বিশাল একটি টব হয়ে আছে, যেন অনুরাগ ও ভালোবাসার লজ্জায় রক্তিম। এই মহুয়ার তুলনা শুধু মহুয়া। রাধার গালের টেবোর মতো ফুল প্রতি সন্ধ্যায় ফুটতে শুরু করে, সঙ্গে তার মাতাল করা সৌরভ। সঙ্গে সারা রাত বাদুড় ও চামচিকের ফুল খাওয়ার উৎসব। আর বনের গাছের তলায় এ জন্য ভালুক ও শেয়ালের নেশাগ্রস্ত বিচরণ। দিনের তপ্ত বৈশাখে আরো আছে বিজন বেদনায় ডাকা হরিয়াল ও ঘুঘুরা। তখন রবীন্দ্রনাথের ‘কপোত ডাকে মধুক শাখে বিজন</p> <p>বেদনায়’ গানের কলি বুক ছ্যাঁচড়া করে দিতে বাকি রাখে না। সেই মহুয়া খেতে আসা বাদুড়-চামচিকে বজ্রবিদ্যুৎ ও বৃষ্টিতে জবুথবু, উদভ্রান্ত। আমি পশ্চিমের বারান্দায় বসে সব দেখি। এ বছর মহুয়াগাছে মৌচাক হয়নি।</p> <p>মহুয়া বৃক্ষ থাকলেই সেখানে বাদুড়, চামচিকে ও পাপিয়াদের উৎপাত জমবেই। ঠিক সন্ধেয় ঘণ্টা দেড়-দুয়েক খেয়ে ওরা চুপ হয়ে গাছে ঝুলে থাকবে মৌতাতের আনন্দে নিবিড় নীরবে। মহুয়ার মধুর মত্ততা এ জন্য দায়ী। এই মধুর নেশা কাটার পর ওরা আবার শুরু করবে খাওয়া। আবার ঘণ্টা দুয়েক পরে মৌতাত। আমি তখন টিপ বাতি জ্বেলে দেখি ওদের শান্তি-কল্যাণ হয়ে ঝুলে থাকা। ছবি তুলি সনি ক্যামেরা দিয়ে। উষ্ণ হই।</p> <p>প্রাচীন কাল থেকে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে মহুয়ার মদ্য শ্রেষ্ঠ। সৌন্দর্য ও সুগন্ধে মহুয়া বিরল ও শ্রেষ্ঠ। কবিতা ও গানে সুবর্ণমদির শোভনীয়। ছায়াঘন বৃক্ষ হিসেবেও সমীহ আদায়কারী। আদিবাসীরা ফুল শুকিয়ে রাখে বর্ষা ও আপৎকালের খাদ্য হিসেবে। পাকা কাঠ শক্ত, মূল্যবান ও কাঠশিল্পে স্বীকৃত।</p> <p>আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সুপ্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত মহুয়া অগ্নিমান্দ্যে, গ্রহণী রোগে, কাশিতে, রক্তপিত্তে, কৃমির রোগে ব্যবহূত হয়ে আসছে ওষুধ হিসেবে। বাহ্য ব্যবহারে উপকার করে বাতের যন্ত্রণায়, নবীন ও প্রাচীন ক্ষতে এবং মাথার যন্ত্রণায়। মহুয়াকে বলা হয় হৃদ্য, কারণ মহুয়া হৃিপণ্ডকে খারাপ করে না, বরং ভালো করে—এ জন্য সে হৃদ্য। কবিরাজরা এটি শিখেছেন ভালুক থেকে।</p> <p>মহুয়ার ফুল থেকে ফল হয় জলপাইয়ের মতো। বীজের ওপরের মাংসল চামড়াও বাদুড়ের খাদ্য। আষাঢ়-শ্রাবণে আবার বাদুড়ের তেমনি ধাতবপ্রায় সুরের চেঁচামেচি ও আহার পর্ব। লিচুর বীজের মতো বীজটি পশুখাদ্য। মহুয়ার গুণের শেষ বুঝি নেই।</p>