<p>লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিবারের জন্য টাকাও পাঠাতে পারবে—এমন আশায় মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেন মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার জাহিদ হোসেন। নরসিংদীর রায়পুরার দালাল তৌহিদুল ইসলাম তাঁর কাছ থেকে নিয়েছিলেন তিন লাখ টাকা। কিন্তু মালয়েশিয়া গিয়ে জাহিদ লেখাপড়া করতে পারেননি। কারণ ভর্তি আর বেতনের টাকা কলেজে জমা না দিয়ে পুরো টাকা নিয়ে পালিয়ে যান তৌহিদুল। ভিসা না থাকায় এখন অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় আছেন জাহিদ। সেখানে আমপাং এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। মাসে আয় এক হাজার ২০০ রিঙ্গিত (এক রিঙ্গিতে প্রায় ১৮ টাকা)। তা থেকে ২০০ রিঙ্গিত কেটে নেয় দালাল। এরপর খাওয়া ও থাকার খরচ চুকিয়ে হাতে বিশেষ কিছুই থাকে না। দেশে পরিবারের জন্যও কিছু পাঠাতে পারেন না।</p> <p>সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় দেখা হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে জাহিদ বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসার সময় আমাকে বলা হয়েছিল লেখাপড়ার পাশাপাশি হোটেল বা রেস্টুরেন্টে কাজ করতে পারব, এ জন্য টাকা নেওয়া হয় তিন লাখ। কিন্তু মালয়েশিয়ায় পড়ালেখা করব কী, আমি এখন অবৈধ অভিবাসী হয়ে গেছি। গ্রেপ্তার আতঙ্ক মাথায় নিয়ে দিন পার করছি। জীবনের সব আনন্দ-বিনোদন হারিয়ে গেছে।</p> <p>বেতন যা পাই তা থেকে নির্দিষ্ট অংশ কেটে রাখেন যিনি চাকরি দিয়েছেন সেই দালাল।’</p> <p>একই রেস্টুরেন্টে কাজ করেন মাইনুল ইসলাম তুহিন, খলিলুর রহমানসহ পাঁচজন। প্রত্যেকেই স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে এখন শ্রমিক হয়েছেন। সরেজমিনে মালয়েশিয়ায় কয়েক দিন ঘুরে দেখা গেছে, কুয়ালালামপুরের বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও মার্কেটে কর্মরতদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি কর্মী। তাদের বড় অংশই স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়ায় এসেছে। নিজেদের কষ্টের কথা বলার পাশাপাশি তাঁরা অন্যদের দালালের ফাঁদে পড়ে মালয়েশিয়া না আসার অনুরোধ জানান। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনও এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক হতে বলেছে।</p> <p>টুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় গেছেন বাংলাদেশের পাবনার সাঁথিয়ার নজরুল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈধ পথে আসতে না পেরে টুরিস্ট ভিসায় আসি। দালাল বলেছিল এখানে কাজ দিবে। কিন্তু এখানে আসার পর যে বেতন পাব বলেছিল সেটা পাচ্ছি না। যে কম্পানিতে কাজ দিয়েছে তার বেতন থেকে কমিশন কেটে নিয়ে যায় অনেক টাকা। প্রতিবাদ করলে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়।’</p> <p>শুধু জাহিদ আর নজরুলই নয়; স্টুডেন্ট, টুরিস্ট ও পেশাগত ভিসা (ডিপি-১০) নিয়ে বিগত বছরগুলোতে যাঁরা মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগই নানা কষ্ট আর দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। কারখানা, কম্পানি কিংবা কৃষি খাতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও ঠিকমতো বেতন জোটে না। দালাল ও এজেন্টরা সেই বেতন থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন হিসেবে টাকা কেটে নেয়। কাজ শেষে বাইরে বের হওয়ারও সুযোগ নেই। কারণ পাসপোর্ট মালিকপক্ষের কাছে জমা থাকে।</p> <p>মালয়েশিয়ার নিলাইয়ের কাঠ কারখানায় কর্মরত হাবিবুর রহমান, আবু সালেহ, ওবায়দুল্লাহসহ একাধিক শ্রমিক বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসার পরপরই কারখানার মালিক আমাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে নেন। প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করার কথা ছিল। এর বেশি কাজ করানো হলে ওভারটাইম হিসেবে পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা। কিন্তু কারখানায় ১২ ঘণ্টা কাজ করানো হয়, যদিও টাকা দেয় আট ঘণ্টারই। মাসে ১২০০ রিঙ্গিত বেতন থেকে এজেন্ট কমিশন হিসেবে নিয়ে যায় ২০০ রিঙ্গিত। খেয়ে না খেয়ে আমরা পরিশ্রম করি, আর বেতনের একটি অংশ কমিশন বাবদ নিয়ে যায় দালাল-এজেন্ট। আমাদের পরিশ্রমের টাকায় দালালরা পরিবার নিয়ে সুখে থাকে আর আমরা জেলখানার মতো বন্দি জীবন কাটাই।’ </p> <p>ডিপি-১০ ভিসায় বাংলাদেশ থেকে দালালচক্র গত কয়েক বছরে ৫০ হাজারের বেশি অদক্ষ কর্মী পাঠিয়েছে মালয়েশিয়ায়। বিভিন্ন পেশায় অভিজ্ঞদের ডিপি-১০ ভিসায় পাঠানোর নিয়ম থাকলেও পাঠানো হয়েছে অদক্ষদের। এ বিষয়ে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার একাধিক সদস্য বলেন, ডিপি-১০ ভিসা ডাক্তার, নার্স, প্রকৌশলীসহ দক্ষ শ্রমিকদের জন্য। কিন্তু গত কয়েক বছরে এ ভিসায় হাজার হাজার অদক্ষ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় গেছে। কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে অদক্ষদের সেখানে পাঠানোর কারণে এখন কর্মীরাই বিপদে পড়ছে। এসব সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বায়রার মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কর্মী নেওয়া বন্ধ বলে অনেকেই টুরিস্ট, স্টুডেন্ট ও ডিপি-১০ ভিসায় গেছে। বৈধপথে কর্মী যাওয়া শুরু হলে এসব ভিসায় যাওয়ার পরিমাণ ৯৫ ভাগই কমে যাবে।</p> <p>মালয়েশিয়ার জহুরবারুর একটি মার্কেটের ক্রোকারিজের দোকানে কাজ করেন মোস্তফা হোসেন। বেতন মাসে ১৫০০ রিঙ্গিত। তা থেকে কমিশন বাবদ ৩০০ রিঙ্গিত নিয়ে যায় দালাল। মোস্তফা বলেন, ‘আমার পাসপোর্ট নেই, ভিসাও নেই। টুরিস্ট ভিসায় এসে অবৈধভাবে থাকছি। দালালের মাধ্যমে কাজ নিয়েছি, বিনিময়ে কমিশন দিতে হয়। এখন বৈধ হওয়ার জন্য দেড় হাজার রিঙ্গিত জমা দিয়েছি, একটি নিবন্ধন হয়েছে। পুত্রজায়ায় ইমিগ্রেশন বিভাগে নিবন্ধনের অপেক্ষায় আছি। বৈধ হলে এই দোকানে কাজও করব না, দালালদের কমিশনও দিব না।’</p> <p>জহুরবারুর বাংলাদেশি কর্মীরা জানান, অবৈধ শ্রমিক হিসেবে যাঁরা মালয়েশিয়ায় কাজ করছেন তাঁদের বেতনের একটি অংশ কমিশন হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে দালালরা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়ে কর্মীদের কাছ থেকে কমিশন বাবদ লাখ লাখ রিঙ্গিত হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। মালয়েশিয়ার প্রতিটি স্টেটেই একই অবস্থা।</p> <p>দেখা গেছে, মূলত কম্পানিগুলো ভালো বেতন দিলেও তার বেশির ভাগই চলে যায় আউটসোর্সিংয়ের দালালদের পকেটে। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তারা মূলত মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের জিম্মি রাখে। কেউ দেশে ফিরে যাওয়ার কথা বললে তার পাসপোর্ট আটকে রাখা হয়। পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। তার ওপর মালয়েশিয়ার মুদ্রা রিঙ্গিতের মান কমে গেছে। মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ার নির্মাণ শ্রমিক মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘দেশে আগের মতো টাকা পাঠাতে পারি না। যে টাকা পাঠাই তাতে পরিবারের চলে না। রিঙ্গিতের মান কমে গেছে। আগে ৫০০ রিঙ্গিত বাড়িতে পাঠালে সাড়ে ১২ হাজার টাকা পাওয়া যেত। এখন পাওয়া যায় সাড়ে আট হাজার টাকা।’</p> <p>এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার শহিদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক কর্মীই মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে বসবাস করছে। প্রায় এক বছরের বেশি সময় দেওয়া হলেও অনেকেই বৈধতার সুযোগ নেয়নি। যারা অবৈধ কর্মী হিসেবে আছে তাদের কাছ থেকে দালালরা বেশি সুযোগ নিতে পারছে। বৈধ কোনো কর্মী প্রতারিত হলে আইনের আশ্রয় নিতে পারে।</p> <p>নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় পাঁচ শতাধিক প্রভাবশালী আছেন, যাঁরা দেশটির বিভিন্ন শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের কাজ দিয়ে কমিশন খাচ্ছেন। এসব শ্রমিকের কমিশনের টাকায় তাঁরা বিলাসী জীবনযাপন করলেও কষ্টে থাকছেন আমার দেশের খেটে খাওয়া কর্মীরা।’</p>