<p>দিনমজুর নিজাম উদ্দিনের চর এলাকার বাড়িতে গত ১০ দিন ধরে বন্যার পানি। সেই পানি বাড়ছেই। দুই দিন ধরে পানি গিয়ে ঠেকছে ঘরের প্রায় চালা পর্যন্ত। সাত সদস্যের এ পরিবারটি এ পর্যন্ত ত্রাণ সহায়তা পেয়েছে খুবই কম। এর পরও তাঁর বড় দুশ্চিন্তার নাম দুটি গরু। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে ভুগতে থাকা নিজামের প্রতিবেশী গৃহবধূ রোজিনা বেগমের একই চিন্তা। বললেন, ‘মানুষ তো মাচার ওপর, চালের ওপর থাকবার পারে; কিন্তু গরু তো তা পারে না।’ কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার ব্যাপারীপাড়া গ্রামের এই চিত্র।</p> <p>উত্তরাঞ্চলে এভাবেই বানের পানি বাড়ছে, আর নানা দুর্ভোগে পড়ছে মানুষ। ভারি বৃষ্টি ও উজানের ঢলের কারণে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর বন্যার পানি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুনামগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত হাওরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায়ও ‘বাড়ন্ত’ পানি আরো বাড়তে থাকায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় গতকাল সোমবার পর্যন্ত ১০ লাখ ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি জীবন যাপন করছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা সুনামগঞ্জে তিন লাখ, কুড়িগ্রামে আড়াই লাখ, রংপুরে ছয় হাজার, নীলফামারীতে ১০ হাজার, বগুড়ায় এক লাখ ২০ হাজার, জামালপুরে এক লক্ষাধিক, সিরাজগঞ্জে এক লাখ ও গাইবান্ধায় দেড় লাখ।</p> <p>পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বলছে, ভারতে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে বলে দেশের বন্যা পরিস্থিতি আগামী কয়েক দিনে আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সমতলে ৯০টি বন্যা পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের মধ্যে ৫৫টিতেই গতকাল পানি বৃদ্ধি ঘটেছে। আর ৯০টি নদীর মধ্যে ১৮টি নদীর পানিই বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই প্রধান প্রধান নদ-নদী।</p> <p>নদ-নদীর অবস্থা : স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যালয়গুলো থেকে জানা গেছে, গতকাল বিকেলে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপত্সীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ও ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায়  ব্রহ্মপুত্রে ৮, ধরলায় ২৫, তিস্তায় ৫  ও দুধকুমার নদে ১৬ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পায়। গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনাসহ সব নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি ২২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ১৩ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদের পানি ৩৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ ছাড়া জেলায় করতোয়ার পানি ১০ সেন্টিমিটার এবং তিস্তার পানি ২০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে গতকাল তিস্তার পানি বিপত্সীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রংপুরে তিস্তার পানি রবিবার থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।</p> <p>যমুনার পানি গতকাল জামালপুরে বিপত্সীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ও সিরাজগঞ্জে ২৪ সেন্টিমিটার এবং বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনট পয়েন্টে বিপত্সীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জে গতকাল বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ২৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়। গতকাল  রাজবাড়ীতে পদ্মার পানি বিপত্সীমার ২১ সেন্টিমিটার এবং গোয়ালন্দ পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সুনামগঞ্জে গতকাল বিকেলে সুরমা নদীর পানি বিপত্সীমার ৮৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।</p> <p>বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা মোকাবিলা করছে কুড়িগ্রামের মানুষ। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। স্রোতের টানে প্রায় অর্ধশত ঘর ভেসে গেছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কুড়িগ্রামে সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ৯টি উপজেলার ৫৩টি ইউনিয়নের ৩৫০টি গ্রামের আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি। সদর উপজেলার ভোগডাঙা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান জানান, চর বড়াইবাগী গ্রামের মোস্তাজিন নামের দেড় বছরের একটি শিশু ঘরে ভেতর মাচা থেকে পানিতে পড়ে মারা যায়। তার বাবার নাম তাজুল ইসলাম। বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর সড়কে দুই দিন ধরে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। কুড়িগ্রামে জেলা ত্রাণ অফিস জানায়, এ পর্যন্ত পাঁচ লাখ টাকার শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে ৯২ টন চাল বিতরণ চলছে।</p> <p>গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, যমুনাসহ সব নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এ জেলায় অন্তত দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলা প্রশাসন গতকাল পর্যন্ত ২০০ টন চাল এবং দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ১৫টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বন্যার্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৭০ টন চাল এবং নগদ তিন লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। রংপুরে তিস্তার পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় গতকালই প্রথম বন্যা দেখা দিয়েছে। গঙ্গাচড়া উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে প্রায় ছয় হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সরেজমিনে গতকাল উপজেলার সাউদপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায় মানুষ রান্নার অভাবে চিঁড়া ভিজিয়ে খাচ্ছে।</p> <p>জামালপুরে যমুনার পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জামালপুর জেলার ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলায় গতকাল আরো ৪০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়। ইসলামপুর-গুঠাইল, গুঠাইল-মলমগঞ্জ এবং মেলান্দহ-মাহমুদপুর সড়ক সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। জেলার চার উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান জানান, ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জে ৫৭ টন চাল এবং নগদ দু্ই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।</p> <p>বগুড়ায় গতকাল পর্যন্ত এক লাখ ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সারিয়াকান্দি উপজেলায় ৭০ হাজার, ধুনটে ৩০ হাজার এবং সোনাতলায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। সিরাজগঞ্জে নিম্নাঞ্চলগুলোয় বন্যার পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় এক লাখ মানুষ। জেলা ত্রাণ অফিস জানায়, জেলায় এখন পর্যন্ত ৬৫ টন চাল ও নগদ তিন লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন, সদরপুর ও সদর উপজেলায় পদ্মার পানি অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে।</p> <p>সুনামগঞ্জে অব্যাহত পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। গতকাল জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়। জেলায় এ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি। প্রশাসনিকভাবে সদর, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলাকে বন্যাকবলিত বলা হলেও জেলার ছাতক উপজেলাও প্লাবিত হয়েছে। তা ছাড়া জেলার অন্য পাঁচটি উপজেলার নিম্নাঞ্চলও নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, পাঁচ উপজেলায় দুর্গতদের মধ্যে ১০১ টন চাল এবং বেশ কিছু পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছে। রাজবাড়ীতে পদ্মার পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদীতে তীব্র স্রোত দেখা দিয়েছে। ফলে ভাঙন আরো তীব্র হয়েছে।</p> <p>মাদারীপুর শিবচরের কাওড়াকান্দি-শিমুলিয়া নৌরুটের পদ্মা নদীতে তীব্র স্রোত অব্যাহত থাকায় ফেরিসহ নৌযান পারাপার মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। ঘাট সূত্রে জানা গেছে, ফেরিগুলো শিমুলিয়া প্রান্তে প্রায় দুই-আড়াই কিলোমিটার উজানে গিয়ে চললেও পারাপারে হিমশিম খাচ্ছে। এর ফলে কাওড়াকান্দি ঘাটে প্রায় চার কিলোমিটারজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়।</p> <p>পরিস্থিতির আরো অবনতির শঙ্কা উজানে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে গতকাল বিকেল ৩টা পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, দেশের নদ-নদীগুলোর ৯০টি পয়েন্টের মধ্যে ১৮টিতে পানি বিপত্সীমার ওপরে বইছে। এর ফলে অন্তত ১৪ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।</p> <p>ঢাকায় বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্য মতে, সমতলে বন্যা পর্যাবেক্ষণ কেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগ স্থানে পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ; রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ধরলা নদী কুড়িগ্রামে, তিস্তা নদী ডালিয়ায়, ঘাঘট নদী গাইবান্ধায়, ব্রহ্মপুত্র চিলমারীতে, যমুনা বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি, কাজীপুর ও সিরাজগঞ্জে, গুর নদী সিংড়ায়, আত্রাই নদী বাঘাবাড়ীতে, ধলেশ্বরী এলাসিনে, পদ্মা গোয়ালন্দ ও সুরেশ্বরে, সুরমা নদী কানাইঘাট ও সুনামগঞ্জে, কংস নদী জারিয়াজঞ্জাইলে ও তিতাস নদীর পানি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পয়েন্টে বিপত্সীমার দুই থেকে ১০৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে।</p> <p>পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী রিপন কর্মকার জানান, উজানের ঢলে বন্যার বিস্তার ঘটছে। এখন পর্যন্ত ১৪টি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা ও সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীগুলোর পানি সমতলে বাড়ছে। উজানে আরো দুই দিন বৃষ্টি থাকতে পারে। এর প্রভাবে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদীসংলগ্ন জেলায় অন্তত তিন দিন পানি বাড়বে। এতে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে।</p> <p>(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেন ঢাকায় এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা।)</p>