<p> প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রাণপুরুষ আমজাদ খান চৌধুরী মারা গেছেন। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনায় ডিউক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে ভুগছিলেন।</p> <p> মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরী ছিলেন দেশের ব্যবসাজগতের উজ্জ্বলতম এক নক্ষত্র। ১৯৮১ সালে তিনি রংপুরে টিউবওয়েল তৈরির কারখানা হিসেবে রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (আরএফএল) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৫ সালে গড়ে তোলেন এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কম্পানি, যার ব্র্যান্ড নাম প্রাণ। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ এখন দেশের শীর্ষ কয়েকটি গ্রুপের একটি। তাদের উৎপাদন তালিকায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি পণ্য আছে। ১০৮টি দেশে প্রাণ-আরএফএল নিজস্ব ব্র্যান্ড নামে পণ্য রপ্তানি করে।</p> <p> গ্রুপের ৬০ হাজারের বেশি কর্মীর কাছে আমজাদ খান চৌধুরী ছিলেন একজন উদ্যোক্তার চেয়েও বেশি কিছু। তিনি নিজ প্রতিষ্ঠানে এমন কিছু নিয়ম চালু করেছেন, যা অন্য কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দেখা যায় না।</p> <p> প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সবার পোশাক একই, নীল শার্ট। নিজেদের মধ্যে সাম্যতার রীতি রক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকও একই রঙের শার্ট পরে অফিসে যান। খাবার জায়গায় চেয়ারম্যান বা অন্য ঊর্ধ্বতনদের আলাদা টেবিল নেই। প্রতিষ্ঠানপ্রধান যে টেবিলে বসে খান একজন নিরাপত্তাকর্মীও একই টেবিলে বসে খেতে পারেন, কোনো বাধা নেই। মালিক অফিসে গেলে কাউকে উঠে দাঁড়াতে হয় না, বরং কাজে মনোযোগকে সেখানে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাড়তি সময় কাজের জন্য প্রত্যেকে পান বাড়তি বেতন।</p> <p> আমজাদ খান চৌধুরী সেই বিনিয়োগকারীদের একজন যিনি এমন সব এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছেন যেখানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি, যাতে দরিদ্ররা তাঁর কারখানায় কাজ করে তাদের অভাব ঘোচাতে পারে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের করপোরেট লক্ষ্যও দারিদ্র্য বিমোচন। এখন এ গ্রুপের ওপর সরাসরি নির্ভর করে ১০ লাখ পরিবারের জীবিকা।</p> <p> আমজাদ খান চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য এক মাস যাবৎ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।</p> <p> আমজাদ খান চৌধুরী ১৯৩৯ সালের ১০ নভেম্বর নাটোরের সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আলী কাশেম খান চৌধুরী, মাতা মরহুমা আমাতুর রহমান। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটে। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ান স্টাফ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৮১ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন।</p> <p> আমজাদ খান চৌধুরী মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতি, পরিচালকসহ নানা পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব), বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা), আন্ডারপ্রিভিলেজড চিলড্রেন্স এডুকেশন প্রোগ্রাম (ইউসেপ) প্রভৃতি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা।</p> <p> তাঁর মৃত্যুতে দেশের ব্যবসাজগতে শোক নেমে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী সংগঠন আমজাদ খান চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন টেলিফোন করে গভীর শোক জানিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমজাদ খান চৌধুরীর অসাধারণ উদ্ভাবনী ক্ষমতা ছিল। তিনি ছিলেন অসম্ভব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন গুণী মানুষকে হারাল।'</p> <p> আমজাদ খান চৌধুরীর ছোট ছেলে ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান খান চৌধুরী তাঁর পিতার জন্য সবার দোয়া চেয়েছেন। তিনি জানান, তাঁর পিতার মৃতদেহ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনার পর ঢাকায় সামরিক কবরস্থানে সমাহিত করা হবে। গতকাল তাঁর মৃত্যুর খবর আসার পর প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে শোকের ছায়া নেমে আসে। তিনি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তিনি ছিলেন আমাদের পিতার মতো। প্রতিষ্ঠানের সবাইকে তিনি নিজ সন্তানের মতো দেখতেন। তাঁর আচরণ কখনো মালিকের মতো ছিল না।'</p>