<p> রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বগাছড়ির চৌদ্দ মাইল এলাকায় ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে পাহাড়িদের তিনটি পাড়ায় হামলা চালিয়ে অন্তত ৫০টি বাড়িঘর ও সাতটি দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে পুনর্বাসিত বাঙালিরা। দখল করা জমিতে আনারস ও সেগুন বাগানের গাছ কেটে ফেলার পর এর জন্য পাহাড়িদের দোষারোপ করে এ তাণ্ডব চালানো হয়। সোমবার রাতে জ্বালাও-পোড়াওয়ের পর গতকাল মঙ্গলবার সকালে পাহাড়িরা সড়ক অবরোধ করে এর প্রতিবাদ জানায়।</p> <p> ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙামাটি জেলা সভাপতি বাবলু চাকমা দাবি করেছেন, কারা বাগানের গাছ কেটে ফেলেছে সেটা না জেনেই পাহাড়িদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। তাঁর দাবি, শতাধিক বাড়িঘর পুড়ে গেছে। চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিহারের বুদ্ধমূর্তি। পাহাড়িদের অভিযোগ, বাঙালিরা জোর করে তাদের জমি দখল করে বাগান করেছে।</p> <p> অন্যদিকে নানিয়ারচর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুজ্জামান দাবি করেছেন, পাহাড়ি লোকজনই বাঙালিদের বাগান ধ্বংস করেছে। প্রতিবছরই এভাবে তারা বাঙালিদের বাগান ধ্বংস করে দেয় দাবি করে তিনি বলেন, পাহাড়িরা নিজেদের দোষ চাপা দেওয়ার জন্য তারা এখন নিজেদের শূন্য বাড়িঘরে আগুন দিয়ে বাঙালিদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।</p> <p> এ বিএনপি নেতার অভিযোগ, ঘটনার প্রতিবাদে বাঙালিরা সড়ক অবরোধ করতে চাইলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সরিয়ে দেয়।</p> <p> ঘটনার পরপরই কুতুবছড়ি এলাকায় পাহাড়িদের সমর্থনে ইউপিডিএফের নেতা-কর্মীরা রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মো. মোস্তফা কামাল, পুলিশ সুপার আমেনা বেগম, সেনাবাহিনী ও পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তাঁরা দফায় দফায় স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। আনারস ও সেগুন বাগান ধ্বংস এবং বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও তাঁরা আশ্বাস দেন।</p> <p> রাঙামাটির পুলিশ সুপার আমেনা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, 'যে কুচক্রী মহল এলাকায় শান্তি নষ্ট করে ফায়দা লুটতে চায়, তাদের পাহাড়ি-বাঙালি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করা হবে।' দুটি ঘটনায় মামলা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারো নেই।'</p> <p> ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে : প্রায় প্রতিবছরই আনারস চাষের জন্য বিখ্যাত বগাছড়ি এলাকায় ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে চারা কেটে কিংবা এসিড দিয়ে বাগান ধ্বংস করা হয়। আনারসচাষিদের বেশির ভাগই বাঙালি হওয়ায় এবং পাশের এলাকায় পাহাড়িদের বসবাস হওয়ায় এ ঘটনাকে ঘিরে প্রায়ই ওই স্থানে পাহাড়ি-বাঙালি সম্পর্কের টানাপড়েন চলে।</p> <p> বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাহাড়িরা তাদের জায়গা দখলের অভিযোগ করে আসছে অনেক দিন ধরে। অন্যদিকে বাঙালিরা বাগান ধ্বংসের জন্য পাহাড়িদের দোষারোপ করে থাকে।</p> <p> জানা গেছে, সোমবার মধ্যরাতে বগাছড়ির চৌদ্দ মাইল এলাকায় দুষ্কৃতকারীরা নুরুল ইসলাম, আসাদ, কামাল, জামাল ও মিজানের মালিকানাধীন প্রায় ১৫ একর আনারস বাগানের আনারসের চারা কেটে ফেলে। একই সময় আবছার মাস্টার ও আসাদের মালিকানাধীন একটি সেগুন বাগানের প্রায় ২০ হাজার চারা কেটে ফেলে তারা। সকালে খবর পেয়ে বাগান মালিকরা ওই স্থানে আসেন। এ সময় তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে ঘটনার জন্য পাশের পাহাড়ি বসতির লোকজনকে দায়ী করে স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক অবরোধের চেষ্টা করা হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লোকজনকে সেখান থেকে সরিয়ে দিলে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে পাহাড়িদের বাড়িতে আগুন দেয়। এতে প্রায় ৩০টি বাড়িঘর ও সাতটি দোকান পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র।</p> <p> অন্যদিকে ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, বগাছড়ি এলাকার মো. আফসার আলী গত বছর সুরিদাশপাড়ার বাসিন্দা পদ্ম রঞ্জন চাকমার দুই একরের বেশি জায়গা দখল করে নেন। এ বছর ওই জমিতে তিনি আনারস লাগিয়েছেন। এতে বাধা দিয়েও কোনো কাজ হয়নি।</p> <p> শান্তিচুক্তিবিরোধী সংগঠনটির অভিযোগ, বাঙালিরা বগাছড়িতে জড়ো হয়ে প্রথমে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে অবস্থিত পাহাড়িদের সাতটি দোকান পুড়িয়ে দেয়। এরপর তারা পাশের সুরিদাশপাড়া, নবীন তালুকদারপাড়া ও বগাছড়িপাড়ায় ঢুকে ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং লুটপাট চালায়।</p> <p> ইউপিডিএফের রাঙামাটি জেলা শাখার সংগঠক সচল চাকমা গতকাল এক বিবৃতিতে পাহাড়ি গ্রামে হামলা ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান। তিনি দাবি করেন, হামলাকারীরা স্থানীয় করুণা বৌদ্ধ বিহারে ঢুকে একজন ভিক্ষুকে মারধর করে এবং চারটি পিতলের তৈরি বৌদ্ধমূর্তি লুট করে নিয়ে যায়। তিনি অভিযোগ করেন, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সংঘটিত হামলায় সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের তিনটি পাড়ায় হামলা চালায়। তারা সুরিদাশপাড়ায় ৩৭টি, বগাছড়িপাড়ায় সাতটি ও নবীন তালুকদারপাড়ায় ছয়টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে।</p> <p> নানিয়ারচর থানার ওসি আবদুর রশিদ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানিয়েছেন, রাতে আনারস ও সেগুন বাগানের চারা কেটে ফেলার পর গতকাল সকালে কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।</p> <p> এদিকে, হামলা ও আগুন দেওয়ার প্রতিবাদে এবং পুনর্বাসিত বাঙালিদের বগাছড়ি থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে নানিয়ারচর ভূমি রক্ষা কমিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কমিটির সদস্য সেন্টু চাকমা স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে আরো রয়েছে, আজ বুধবার ঘিলাছড়ি থেকে খামারপাড়া ও নানিয়ারচর সদরে মানববন্ধন, বৃহস্পতিবার ঘিলাছড়ি, কুদুকছড়ি ও বেতছড়িতে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং শুক্রবার নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে স্মারকলিপি প্রদান।</p> <p>  </p>