<p>পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠিত ধর্মমত ও জাতিগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এসব বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় প্রাত্যহিক জীবনের চাল-চলন, সামাজিক অনুষঙ্গ, খাদ্যাভ্যাস থেকে নিয়ে নিজ নিজ স্থাপত্যশৈলীগুলোতেও। আজকের প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব মুসলিম স্থাপত্য নিয়ে। মুসলিম স্থাপত্য হলো স্থাপত্যের একটি শৈলী, যা ইসলামী বিশ্বে বিকশিত হয়েছে এবং একে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও উপাদান দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। মুসলিম স্থাপত্য মুসলিম বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। তবে বক্ষ্যমান প্রবন্ধের মূল আলোচনা মুসলিম স্থাপন নিয়ে নয়, এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে। আজকের দিনে যখন তীব্র দাবদাহে শহর থেকে নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদ সর্বত্র জনজীবন অতিষ্ঠ, তখনো প্রাচীন মুসলিম স্থাপনাগুলোর মধ্যে প্রবেশ করলে অনুভূত হয় এক প্রশান্তিময় শীতল আবহ। এর রহস্য উদঘাটনে চিন্তাবিদরা এই স্থাপনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক চিহ্নিত করেছেন। যার মধ্যে আছে—</p> <p>জালিযুক্ত নকশা ব্যবহার করে আলো ও ছায়ার এফেক্ট : প্রায় সব ইসলামী স্থাপত্যে পাশের দেয়ালের নানা অংশে জালিযুক্ত নকশার ব্যবহার দেখা যায়, যা বাতাস ও আলোকে ফিল্টার করে ডায়নামিক এক প্যাটার্ন তৈরি করে। আর ভবনের সর্বত্র বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করে। প্রয়োজনীয় আলোর উপস্থিতি নিশ্চিত করে। হাল আমলের অনেক স্থপতিকেও এই পদ্ধতির দিকে ঝুঁকতে দেখা যাচ্ছে। যেমন—গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে ভারত সরকার ২০১৯ সালে গ্রহণ করেছে ‘ইন্ডিয়া কুলিং অ্যাকশন প্ল্যান’। এই পরিকল্পনায় গ্রীষ্মের তাপমাত্রা যেন ঘরে আবদ্ধ হয়ে না থাকে এবং বায়ু চলাচলের মাধ্যমে যেন ঘর ঠাণ্ডা রাখা যায়, সে জন্য কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যার অন্যতম একটি হলো ‘জালি পর্দা’র ব্যবহার। জালি পর্দা হলো জালের মতো দেখতে দেয়াল। ছিদ্রযুক্ত হওয়ায় এর ভেতর দিয়ে আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে। আগ্রার তাজমহল কিংবা জয়পুরের হাওয়া মহলে এই জালি দেয়াল দেখতে পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, এই ছিদ্রযুক্ত জালি দিয়ে বাইরের তীব্র তাপমাত্রাযুক্ত বাতাস কিছুটা শীতল হয়ে ঘরে প্রবেশ করে। অন্যদিকে ইটের তৈরি দেয়ালের মতো তাপকে আবদ্ধ করে রাখে না।</p> <p>উত্তর ভারতে মাইক্রোসফটের কার্যালয় নির্মাণ করার ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। এই নির্মাণশৈলীর কারণে ভবনটি আমেরিকার গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের সর্বোচ্চ রেটিং ‘লিড প্লাটিনাম রেটিং’ স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হোটেল, অফিস কিংবা আবাসিক স্থাপনা নির্মাণে এই জালি পর্দা ব্যবহার করা হচ্ছে। সব ক্ষেত্রেই নির্মাতারা বলছেন, এর মাধ্যমে বাইরের তীব্র তাপমাত্রা অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে।</p> <p>উন্মুক্ত প্রান্তর ও নানা গাছগাছালি : প্রাচীন মুসলিম স্থাপনার প্রতিটির পাশেই বিস্তর উন্মুক্ত প্রান্তর বা ফাঁকা মাঠ বিদ্যমান ছিল। স্থাপনার চারপাশ শোভিত ছিল নানা গাছগাছালি বা বাগান। স্থাপনার চারপাশে পর্যাপ্ত গাছগাছালিও স্থাপনার ভেতরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করত। </p> <p>স্থাপনার চারপাশে জলাধার : প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্যের অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিশাল জলাধারের মধ্যে এবং চারদিকে পুরু দেয়াল দিয়ে বসবাসের জন্য ঘর তৈরি করা হতো। পানি ও দেয়ালের পুরুত্বের কারণে মাটির ঘরের মতো এসব ঘরের অভ্যন্তরে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা অনুভূত হতো না। পাশাপাশি স্থাপনাগুলোর নকশা এমনভাবে করা হতো, যাতে বাইরের শীতল বাতাস ঘরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সঠিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের উত্তর ও মধ্য প্রদেশে মোগল আমলে নির্মিত এ ধরনের অনেক জলমহালের অস্তিত্ব এখনো রয়েছে।</p> <p>পরিবেশে মানবসৃষ্ট নানা বিপত্তির কারণে আজকের দিনের এই তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ জীবন থেকে রক্ষা পেতে এখনো যদি মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর রীতি অনুসরণ করে আমাদের চারপাশে পর্যাপ্ত পরিমাণে গাছ লাগাতে পারি, আর এক স্থাপনা থেকে অন্য স্থাপনার মধ্যে প্রয়োজনীয় দূরত্ব নিশ্চিত করতে পারি, স্থাপনা নির্মাণে দক্ষ আর্কিটেকচারের মাধ্যমে সবুজ স্থাপনাশৈলী অনুসরণ করতে পারি, তাহলে এই যুগেও আমাদের ঘরগুলো অনেকাংশে স্বস্তিদায়ক হবে ইনশাআল্লাহ।</p> <p>তাই আসুন, আমরা নিজ নিজ আঙিনায় বেশি পরিমাণে গাছ লাগিয়ে পরিবেশের উষ্ণতা রোধে ভূমিকা রাখি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন।</p> <p>লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস</p> <p>saifpas352@gmail.com</p> <p> </p> <p> </p> <p> </p>