<p>মাত্র ছয় বছর বয়সেই মাকে হারান প্রিয় নবী (সা.)। কল্পনার আকাশে সেই দৃশ্য ভেসে উঠলে যেকোনো মুমিনেরই নয়নযুগল বন্যায় ভেসে যাবে। সে আওয়াজ কত করুণ, যেখানে একটি ছেলে তার মায়ের বুকে পড়ে মা! মা! করে আর্তনাদ করছে, যাকে কোলে তুলে নেওয়ার মতো কোনো আত্মীয় তখন পাশে ছিল না। চাচা-চাচি, মামা-মামি, খালা-খালু, ফুফা-ফুফু, দাদা-দাদি, নানা-নানি—কেউই না। ‘আবওয়া’ নামের সেই স্থানের আকাশ-বাতাস হয়তো ভারী হয়ে গিয়েছিল মহানবী (সা.)-এর আর্তচিৎকারে। আকাশ-বাতাস, তরুলতা, পাহাড়—সব কিছু বুক ফাটিয়ে কান্না করছিল উভয় জাহানের বাদশাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ক্রন্দনে।</p> <p>কল্পনায় ভাসে সেই দৃশ্যটি, যখন উম্মে আয়মান আমার প্রিয় নবীর কচি হাত ধরে মক্কার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, আর আমার রাসুল বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিলেন, বারবার ছুটে যেতে চাইছিলেন মায়ের কবরের কাছে। ঘটনার শুরু এভাবে—একদিন মা আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদিনায় যাবেন। উদ্দেশ্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করা। মা আমিনা, ছেলে, ও সঙ্গী উম্মে আয়মানকে নিয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে মদিনায় পৌঁছেন। তিনি মদিনায় এক মাস সময় অতিবাহিত করেন।</p> <p> </p> <p><strong>মক্কায় ফেরার পথে</strong></p> <p>স্বামীর শোকে তিনি মুহ্যমান। স্বামী আবদুল্লাহর কবর জিয়ারত করে মক্কায় ফিরছিলেন। মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি আবওয়া নামক স্থানে এসে আমিনা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সঙ্গে আছেন দাসী বারাকাহ ও পুত্র মুহাম্মদ (সা.)। তাঁরা একটি মরূদ্যানে থামলেন। মাথা ব্যথায় অসহ্য কষ্ট হচ্ছিল আমিনার। আমিনা উম্মে আয়মানকে কাছে টেনে নিলেন। উম্মে আয়মান (রা.)-এর মূল নাম ছিল বারাকাহ। মা আমিনা বাকরুদ্ধ কণ্ঠে তাঁকে বললেন, ‘বারাকাহ! আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই এ দুনিয়া ছেড়ে যাব। আমি আমার শিশুটিকে তোমার হাতে দিয়ে যাচ্ছি। গর্ভে থাকাকালে সে তার পিতাকে হারিয়েছে। এখন তার চোখের সামনে মাকেও হারাচ্ছে। এখন থেকে তুমি তার মা। কখনো তাকে ছেড়ে যেয়ো না।’ মা আমিনা শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে আমানত হিসেবে তুলে দিলেন বাকারাহর হাতে। বারাকাহ বলেন, ‘আমিনার কথা শুনে আমার হৃদয় ভেঙে গেল। আমি কান্না শুরু করলাম। তখন শিশুটি হতবিহ্বল হয়ে কান্না শুরু করে দিল। ভয়ে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমিনাও শিশুটির সঙ্গেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তারপর চিরকালের জন্য নীরব হয়ে গেলেন।’</p> <p>বারাকাহ কাঁদলেন। গভীরভাবে কাঁদলেন। সেদিন মরুর বুকে ছিল বারাকাহ (রা.) ও শিশুটি আর আমিনার প্রাণহীন দেহ। নিকটে তখন অন্য কোনো মানুষ ছিল না। আমিনার দেহ নীরব, নিস্তব্ধ। বারাকাহ (রা.) ও শিশুটির কণ্ঠেও কান্না। নিজ হাতে বারাকাহ (রা.) মরুর বালি সরিয়ে কবরের মতো করে ফেললেন। আর আমিনার মৃতদেহ রেখে সেখানে ধুলি দিয়ে ভরিয়ে দিলেন। তারপর বারাকাহ শিশুটিকে নিয়ে মক্কায় ফিরে এসে তাঁর পিতামহ আবদুল মোত্তালিবের হাতে তাঁকে অর্পণ করেন। (সিরাত ইবনে হিশাম : ১/১৬৭)</p> <p>একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার মায়ের ইন্তেকালের পর উম্মে আয়মানই আমার মা।’ (তারিখে ইবনে আসাকির : ৮/৫১)</p> <p> </p> <p><strong>মায়ের কবর জিয়ারতে প্রিয় নবী (সা.)</strong></p> <p>হিজরতের কয়েক বছর পর সেই পথ দিয়ে আবারও তাঁর সাহাবিদের নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রিয় নবী (সা.)। সারা জাহানের সর্দার নবীকুল শিরোমণি তখন কিছুক্ষণের জন্য বিমূঢ় হয়ে গেলেন। সাহাবিদের সেখানে অবস্থানের নির্দেশ দিয়ে তিনি মায়ের কবর পানে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। দীর্ঘক্ষণ মোনাজাত করে কাঁদলেন। উপস্থিত সাহাবিরাও রাসুল (সা.)-এর এ অবস্থা দেখে কান্না সংবরণ করতে পারলেন না। যাঁরা জানতেন যে এখানে প্রিয় রাসুল (সা.)-এর সম্মানিত আম্মাজানের কবর তাঁরা তো বুঝলেনই, আর যাঁরা জানতেন না তাঁরা রাসুল (সা.)-এর জিয়ারত শেষে জিজ্ঞেস করলে রাসুল (সা.) বলেন, এটি আমার আম্মাজানের কবর। (মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, হাদিস : ৩২৯২)</p> <p>হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর আম্মাজানের কবর জিয়ারত করার জন্য গমন করেন। এ সময় রাসুল (সা.) কাঁদলেন এবং তাঁর সঙ্গীরাও কাঁদল। এরপর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি আমার রবের কাছে, আমার মায়ের কবর জিয়ারত করতে চাইলে তিনি এর অনুমতি দিয়েছেন। কাজেই তোমরা কবর জিয়ারত করবে। কেননা তা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৩২৩৪)</p> <p> </p> <p>লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক</p> <p> </p>