<p>মূল্য স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রভৃতির মধ্যে কোনটিতে বেশি জোর দিতে হতে হবে তা নির্ধারণের ব্যাপারে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো স্বচ্ছ ও বহির্মুখী হতে বললেন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গভর্নর ড. চক্রবর্তী রঙ্গরাজন। তাঁর মতে, এর বেশি প্রয়োজন প্রচলিত নিয়ম ও বিচারিক বিচক্ষণতার একটা সুন্দর সমন্বয় সাধন।</p> <p>গত রবিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মিলনায়তনে বিআইবিএম আয়োজিত প্রথম এ কে এন আহমেদ স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে ‘মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জিং বিষয়’ বক্তৃতা করেন রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ১৯তম গভর্নর ড. রঙ্গরাজন।</p> <p>তিনি বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য যেমন মূল্য স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রভৃতির মধ্যে মূল্য স্থিতিশীলতার লক্ষ্যটি বেশি জোরালো হতে হবে। মূল্যস্ফীতির টার্গেটিং এ ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। সাধারণ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারলে এর অন্য লক্ষ্যগুলোও মধ্য মেয়াদে অর্জিত হবে।’</p> <p>রঙ্গরাজন বলেন, ‘বলা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং বিজ্ঞানও নয়, কলাও নয় বরং এটি একটি কৌশল। এ কথাটি কমপক্ষে অর্ধসত্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলতে এখন আর অতি পরিচিত কিছু সমস্যাকে সমাধানের জন্য অতিপরিচিত কিছু হাতিয়ার ব্যবহার করা বোঝায় না। এখন যে সমস্যাগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সামলাতে হয় তা অনেক জটিল। আমাদের এখন দরকার হয়েছে প্রতিনিয়ত কিভাবে একটি অর্থনীতি তার কর্মকাণ্ড ঘটায় তা জানা ও বোঝা এবং কিভাবে অর্থনীতির বিভিন্ন অংশগ্রহণকারীরা নীতি পরিবর্তনে সাড়া দেয় তাও সঠিকভাবে জানা ও বোঝা। সফল কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো হলো সেগুলো, যারা অতিদ্রুত কৌশলের সঙ্গে এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যেকোনো আর্থিক সমস্যার প্রতি সাড়া দেয়।’</p> <p>রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘অর্থনীতির বিবর্তনের ধারায় উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় দেশগুলোতে বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মুদ্রানীতি। এর চ্যালেঞ্জগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আজকের মুদ্রাব্যবস্থা এবং আর্থিকব্যবস্থা অনেক বেশি জটিলতর। আর্থিক সেবার সংখ্যা এত বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে যে কয়েক দশক আগেও যেসব আর্থিক সেবা অপরিচিত ছিল তা আজ অতি সাধারণ ও পরিচিত। মুদ্রানীতি সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় এসব পরিবর্তনগুলো অনেক বেশি ভূমিকা রাখছে।’</p> <p>বর্তমানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ স্থানান্তরের প্রক্রিয়া দ্রুত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের মুদ্রানীতি সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন ড. রঙ্গরাজন। তিনি বলেন, ‘মুদ্রানীতির উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে একটা ভারসাম্য আনার পাশাপাশি দেশ-বিদেশের প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশের যুগান্তকারী পরিবর্তনের সঙ্গে এর খাপ খাওয়ানোর দরকার হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে মুদ্রানীতির অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতির প্রতিরোধে মুদ্রানীতি অর্থনৈতিক পলিসির একটি সম্ভাবনাময় হাতিয়ার।’</p> <p>ভারতীয় মুদ্রানীতির ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষেত্রে ড. রঙ্গরাজন বলেন, ‘স্বাধীনতার পর প্রথম তিন দশকে সরকারের প্রধান কাজ ছিল পরিকল্পনাগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন। বাংলাদেশেও তার পার্থক্য হওয়ার কথা নয়। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক অবকাঠামো উন্নয়নে এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আশির দশকে এসে ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং রাজস্ব ঘাটতি পূরণে স্বয়ংক্রিয় মানিটাইজেশন নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব দেখা যায়। এর পরের বছরগুলোতে রাষ্ট্রীয় অনেক কমিটির মতামত কম বা বেশি বাস্তবায়িত হলেও ২০১৬ সালে এসে ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নমনীয় মূল্যস্ফীতি নির্ধারণের নীতির ওপর ভিত্তি করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সুদহার কখন বাড়ানো হবে আবার কখন কমানো হবে তা নিয়ে সব সময়ই একটা বিতর্ক রয়েছে।’</p> <p>কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ড. চক্রবর্তী বলেন, ‘প্রায় সব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। তবে অধিকাংশ সরকারই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামতকে গুরুত্ব দেয়। মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি যদি একমুখী না হয় তখন তা অর্থনীতির জন্য এটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই একটা অর্থনীতিকে সুচারুরূপে কার্যকরী রাখার জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে গভীর সংলাপ ও সমন্বয় থাকা প্রয়োজন।’</p> <p>অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, এটা মনে রাখতে হবে যে দেশের সরকার ও আর্থিক ব্যবস্থার অন্যান্য শাখার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ততা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের একা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না। আরো মনে রাখতে হবে, এই মূল্যস্ফীতির পেছনে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পরিস্থিতিই দায়ী। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধূরী।</p>
