বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক রেটে চালুর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সিদ্ধান্তের ফলে এখন থেকে মার্কিন ডলারের মূল্য নির্ধারণ হবে বাজারের চাহিদা ও জোগানের ওপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা এখন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে ডলার বাজারকে পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।’
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই।
চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে এর দাম ওঠানামা করবে। এটাই নিয়ম। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই বাজার ইচ্ছাকৃতভাবে ধরে রেখেছিল বাংলাদেশ সরকার। আইএমএফ এই নিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থাপনার ওপর নারাজ ছিল। সংশোধনের পরামর্শ দিলেও তা এত দিন বাস্তবায়ন করা হয়নি। ঋণ পাওয়ার জন্য এক প্রকার ঝুঁকি নিয়েই বাজারের ওপর ডলারের দাম ছেড়ে দেওয়া হলো। এর ফলে প্রাথমিকভাবে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ ঠিক থাকলে খুব বেশি সুবিধা করতে পারবেন না অসাধু ব্যবসায়ীরা।
গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে দুবাই থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এই ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে আগামী জুনে আইএমএফের দুই কিস্তি পাওয়া যাবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
গভর্নর বলেন, ‘এত দিন আমরা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। এখন উপযুক্ত সময় এসেছে ডলারকে বাজারভিত্তিক করে দেওয়ার। আমরা আইএমএফের দেওয়া সব শর্ত মানিনি।
তার পরও তারা নিষেধ করেনি। আমাদের সঙ্গেই ছিল। আমরা এখনো তাদের ঋণ ছাড়া চলতে পারব। কিন্তু তাদের ঋণ সহায়তা ছাড়া অন্যান্য সহযোগী দেশগুলো ঋণ দিতে সাহস পাচ্ছে না। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিলেও নিয়মিত মনিটরিং করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদি কেউ বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এককথায় ডলার মার্কেটে হাত দিতে এলে হাত পুড়ে যাবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন বাজারে ডলারের কোনো সংকট নেই। প্রয়োজনীয় ডলার বাজার থেকেই সংগ্রহ করা সম্ভব। তার পরও যদি কোনো বড় ধরনের আন্তর্জাতিক পেমেন্টের প্রয়োজন হয়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সহযোগিতা করা হবে।’ ব্যাংকগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের এক্সচেঞ্জ রেট বাংলাদেশের মাটিতেই নির্ধারণ করা হবে। অযৌক্তিক দামে ডলার কেনার প্রয়োজন নেই, কারণ বাজারে যথেষ্ট ডলার রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান বাজারকে অস্থির করার চেষ্টা করতে পারে, তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তা প্রতিহত করার পূর্ণ সক্ষমতা রাখে।
গভর্নর বলেন, ‘আগামী জুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের দুই কিস্তির ১.৩ বিলিয়ন ডলারসহ বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাইকা, এআইআইবিসহ কয়েকটি সংস্থা থেকে আরো ২.২০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাবে দেশ। সব মিলিয়ে আগামী মাসে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের ঋণ আসবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী করেন ব্যাংকের বোর্ড ও সরকারের অচল নীতিকে। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, প্রভিশন সংরক্ষণ না করে কেউ এক টাকাও লভ্যাংশ দিতে পারবে না। আগে এটা কার্যকর করা যায়নি, কিন্তু এবার আমরা তা বাস্তবায়ন করেছি। ব্যাংক রক্ষার জন্য নয়, আমরা এসেছি আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। যদি প্রয়োজন হয়, দুর্বল ব্যাংকগুলোর মার্জার বা অবসায়ন করা হবে। অনিয়ম পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক এক মাস সময় দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে তাদের প্রভিশন পূরণ করার জন্য। ব্যর্থ হলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গভর্নরের বক্তব্য অনুযায়ী, মে মাসেই মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের নিচে নেমে আসবে এবং ভবিষ্যতে এটি আরো কমবে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ডলার বাজার এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। এই সময়ে আমাদের বাজারভিত্তিক যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে। এখন সবাইকে সবার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। সুযোগ পেয়ে যদি ডলার বাজার নিয়ে কেউ খেলা করে, সেটা ঠিক হবে না। আশা করছি, ডলার বাজার স্থিতিশীলই থাকবে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে নিজের কাজ সঠিকভাবে পালন করব বলেই আশা করছি।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বিনিময় হার আরো নমনীয় করে ঋণের কিস্তি এলে এটা দেশের জন্য ভালো। এর মাধ্যমে আমরা বড় ঝুঁকি কাটালাম। কারণ আইএমএফের ঋণ ঝুলে গেলে অন্য সহযোগী সংস্থার ঋণও আটকে যেত। বিনিময় হার আরো নমনীয় করার এখনই স্বস্তিকর সময়। কারণ রপ্তানি ও প্রবাস আয় ঊর্ধ্বমুখী। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস, কয়লাসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম ১২ শতাংশ কমার পূর্বাভাস মিলেছে। তাই এখনকার চেয়ে উত্তম সময় আর না-ও মিলতে পারে।’
জাহিদ হোসেন আরো বলেন, ‘ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারভিত্তিক কোনো দেশ করে না। তবে বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও একই প্রক্রিয়ায় ডলারের দাম নির্ধারণ করতে হবে। ভয় না দেখিয়ে ডলার বেচাকেনার মাধ্যমে দামে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এটাই বৈশ্বিক চর্চা।’