সংবিধান সংশোধন করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ও বিনামূল্যে সেবা প্রদানের প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া পুরাতন আইন যুগোপযোগী করা, নতুন আইন প্রণয়ন ও চিকিৎসা ব্যয় কমানোর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অতিদরিদ্র ২০ শতাংশের জন্য রয়েছে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা।
গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সংস্কার কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়।
স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। যেসব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ইনফরমেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন, অধ্যাপক লিয়াকত আলী, ডা. সায়েবা আক্তার, সাবেক সচিব এম এম রেজা, ডা. আজহারুল ইসলাম, ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ডা. আহমেদ এহসানুর রাহমান এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি উমায়ের আফিফ।
পরে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন সংস্কার কমিশনের সদস্যরা। সংবাদ সম্মেলনে ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, ‘আমার জানা মতে, এ জনপদে স্বাস্থ্য সংস্কারের উদ্যোগ এই প্রথম। এই প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ, সরেজমিন পরিদর্শন, জনমত জরিপ করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যতই বলি স্বাস্থ্য আমার অধিকার।
কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই। প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন রোগী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তবে তিনজনের মধ্যে একজন রোগী প্রয়োজনীয় সেবা না পেয়ে ফিরে যান বা উপেক্ষিত হন।
জনমত জরিপে যা জানা গেল : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে আটটি বিভাগে আট হাজার ২৫৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মতামত নেওয়া হয়েছে। এতে ওষুধের মূল্য, রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষার ফি নির্দিষ্ট করার পক্ষে মত দিয়েছে ৯৬ শতাংশ।
৯৭ শতাংশ জানিয়েছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে দেওয়া প্রয়োজন। ৯২ শতাংশ ওয়ার্ড ও ইউনিয়নে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির পক্ষে মত দিয়েছে।
৭২ শতাংশ মনে করে, জনস্বাস্থ্য সেবা পৃথক অবকাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া উচিত। স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের বেশির ভাগ সরকারের ওপর ন্যস্ত হওয়া উচিত বলে মনে করে ৯২ শতাংশ। স্বাস্থ্য হানিকর খাদ্য, পানীয় ও ভোগ্য পণ্যের ওপর উচ্চহারে কর প্রয়োগের বিষয়ে একমত ৭৯ শতাংশ। স্বাস্থ্য বীমা গ্রহণে আগ্রহী ৭১ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সংস্কার কমিশনের সদস্যরা এ পর্যন্ত ৫১টি বৈঠক করেছেন। কমিশন চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল ও ঢাকায় ৩২টি পরামর্শ সভা করেছে।
কমিশনের প্রতিপ্রাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘স্বাস্থ্য সবার অধিকার’। স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের সুপারিশকে সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো স্বাস্থ্য সেবাদান ও ভৌত অবকাঠামো, নেতৃত্ব সুশাসন ও কর্মসংস্কৃতি, স্বাস্থ্য জনবল ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য জনবলের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধপত্র, চিকিৎসা প্রযুক্তি ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ, স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন ও স্বাস্থ্য তথ্যব্যবস্থা।
সুপারিশ প্রণয়নে বিবেচনায় রাখা হয়েছে সংবিধান ও আইন, নীতি, প্রতিষ্ঠান, কর্মসূচি, সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রস্তাবিত মেয়াদ, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে করণীয় এবং জাতীয় প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার।
বিদ্যমান স্বাস্থ্য ক্যাডারসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্যাডার এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সব জনবল নিয়ে নতুন সিভিল সার্ভিস করার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন। প্রস্তাবিত এই সার্ভিসের নাম হবে ‘বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস (বিএইচএস)’। শুধু তা-ই নয়, এই সার্ভিসের জন্য একজন চিকিৎসকের নেতৃত্বে স্বতন্ত্র সচিবালয় করা, নিয়োগের জন্য আলাদা পিএসসি গঠন এবং পৃথক বেতনকাঠামোরও সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
সুপারিশে আরো যা বলা হয়েছে : দেশের ২০ শতাংশ অতিদরিদ্র হাসপাতালে বিনা মূল্যে সব ধরনের সেবা, প্রাথমিক পর্যায়ে বিনা মূল্যে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। শুরুতে ২৫ শতাংশ ওষুধ জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন করতে হবে। পাঁচ বছরের মধ্যে ১০০ শতাংশ ওষুধ জেনেরিক নামে লিখতে হবে।
ওষুধ কম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা চিকিৎসকের কাছে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে তাদের পণ্যের প্রচার করতে পারবেন না। শুধু চিকিৎসকদের ই-মেইলে বা ডাকযোগে তাদের পণ্য সম্পর্কিত তথ্য পাঠাতে পারবেন। ক্যান্সার, ডায়বেটিসের ওষুধের ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
স্বাস্থ্যসেবা গ্রহীতার অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি আধুনিক ডিজিটাল অভিযোগ নিষ্পক্তি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সহিংসতা রোধে ‘মেডিক্যাল পুলিশ’ নামে প্রশিক্ষিত একটি বিশেষ ইউনিট গঠন, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ও পরিষেবা সহায়ক নেটওয়ার্ক, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ইউনিক স্বাস্থ্য আইডি ও স্মার্ট স্বাস্থ্য কার্ড চালু করতে হবে। এ ছাড়া কাগজবিহীন ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখার সুপারিশ এসেছে সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে।