<p>ঢাকার উপকণ্ঠ গাজীপুর নগরে চলছে ভোটের চূড়ান্ত প্রচারণা। এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে সাতজন প্রার্থী থাকলেও আলোচনায় আছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি নেতৃত্বাধীন দুই জোটের দুই প্রার্থী। আওয়ামী লীগের মো. জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকারকে নিয়েই চলছে কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশ। এক মাস আগেও যেখানে ক্ষমতাসীন দলের অনেককেই নৌকার প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামতে দেখা যায়নি, তারাও এখন ভেদাভেদ ভুলে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে।</p> <p>আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছে, নগরীর দুর্ভোগ দূর করতেই নৌকার প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করবে ভোটাররা। প্রতিটি এলাকাতেই উন্নয়নের আশায় জাহাঙ্গীরের পক্ষে জোয়ার উঠেছে। ভোটের দিন তার প্রতিফলন ঘটবে।</p> <p>তবে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের কর্মী-সমর্থকরা সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কার কথা বলছে। তারা বলছে, সুষ্ঠু ভোট হলে এবং নেতাকর্মীরা ভোট দিতে পারলেই দলের প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়লাভ করবেন।</p> <p>বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, ভোটের মাঠে সমান তালে তাঁরা প্রচার চালাতে পারছেন না। প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় পুলিশ দিয়ে নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগও করছেন তাঁরা।</p> <p>সরেজমিনে দেখা গেছে, গাজীপুর মহানগরের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষ্মীপুরা এলাকায় নৌকা প্রতীকের লিফলেট নিয়ে ভোট চাচ্ছেন ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম রবি ও যুবলীগ নেতা ওবায়দুল ইসলামসহ ১০ থেকে ১২ নেতাকর্মী। রবি ও ওয়ায়দুল যথাক্রমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র কমিটির আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়ক।</p> <p>নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম রবি বলেন, ‘দুই দিন পর নির্বাচন, এখন কথা বলার টাইম নেই।’ এ কথা বলেই ছুটতে থাকেন লিফলেট নিয়ে। তবে ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘নৌকার বিজয় ছাড়া উপায় নেই। সব নেতাই মাঠে নামছে। এইবার ফিরায় কেডায়?’ </p> <p>শুধু নগরের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কেন্দ্র কমিটির নেতারাই নন, ৪২৫টি ভোটকেন্দ্রের জন্য গঠিত নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নেতারা এভাবেই ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সাধারণ ভোটারদের কাছে রাত-দিন বিরামহীনভাবে ভোট প্রার্থনা করে যাচ্ছেন।</p> <p>নগরের দীঘিরচালায় গিয়ে দেখা যায়, অসুস্থ শরীর নিয়ে নৌকার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন গাজীপুর নগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল আহসান সরকার রাসেল। সঙ্গে শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে ব্যবসায়ী এবং সাধারণ ভোটারদের কাছে নৌকার পক্ষে ভোট চাচ্ছেন।</p> <p>মাঠের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাসেল সরকার বলেন, ‘গোপালগঞ্জের পর গাজীপুর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। আর সেই ঘাঁটিতে নৌকার বিজয় এখন সুনিশ্চিত। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রেই আমাদের নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির নেতাকর্মীরা নৌকার পক্ষে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সমম্বয় করছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সভাপতি মো. ওমর ফারুক চৌধুরী।’</p> <p>শুধু যুবলীগ নেতারাই নন, আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগসহ প্রতিটি সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরা নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। এক মাসেও ক্ষমতাসীন দলের যেসব নেতারা নানা গ্রুপিং আর দলাদলির কারণে জাহাঙ্গীরের পক্ষে মাঠে নামেননি, এখন সেই নেতারাই নিজের পকেটের টাকা খরচ করে নৌকার পক্ষে ভোট প্রার্থনা করছেন। ভেদাভেদ ভুলে নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সবাই যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছেন। শেষ মুহূর্তে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।</p> <p>গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিট। জয়দেবপুর বাজার থেকে পশ্চিমে নগরীর লক্ষ্মীপুরা তিন সড়কের মোড়। এর এক শ গজ দূরেই জামাল হোসেনের চায়ের দোকান। ফুটবল বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার পরাজয় নিয়ে আলোচনার ফাঁকে ষাটোর্ধ্ব ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘খেলাধুলা বাদ দাও, দুই দিন পর নির্বাচন হেইডার কথা কও।’ পাশেই বসা মিরাজ হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন তো জইম্যা উঠছে। নৌকা মার্কার লোকদের মাঠে বেশি দেখা গেলেও ধানের শীষ মার্কার লোকেরা নীরবে কাজ করছে। সুষ্ঠু ভোট হইলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।’ রিকশাচালক নৌকার সমর্থক আল আমিন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘হাড্ডাহাড্ডি কিসের লড়াই, পাঁচ বছরে বিএনপির মেয়র কোনো উন্নয়ন করে নাই। হেগো আবার ভোট দিব মানুষ! উন্নয়ন চাইলে নৌকার প্রার্থীকেই ভোট দিতে হইবো।’ আল আমিনের এমন কথার জবাবে রশিদ মিয়া বলেন, ‘সুষ্ঠু ভোট হইলে বোঝা যাইবো কেডায় পাস হয়।’</p> <p>কোনাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডের সামনে জটলা করা ইজিবাইকচালকদের কাছে জানতে চাইলে সালাউদ্দিন মিয়া, আব্দুর রহিম ও সালেক হাওলাদার জানান, ঈদের আগে দেশে (গ্রামের বাড়ি) যাওয়ার সময় হাত ধরে নেতারা বলেছিলেন যেন ফিরে এসে তাঁদের প্রার্থীকে ভোট দেই। শুধু ভোট দেওয়ার জন্যই চলে এসেছেন তাঁরা।</p> <p>টঙ্গীর রেলস্টেশনের পাশেই নৌকার পক্ষে প্রচার চালাতে দেখা যায় জার্মানি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ বাদল আহমেদসহ প্রবাসী নেতাকর্মীদের। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে ভোট চেয়ে ঘুরে বেড়ান তাঁরা। শেখ বাদল আহমেদ বলেন, ‘মেয়র প্রার্থীকে বিজয়ী করতে তাঁর পক্ষে প্রচার চালাতে জার্মানি থেকে প্রবাসী নেতাকর্মীদের নিয়ে চলে এসেছি। নৌকার পক্ষে দুই দিন ধরে ভোট চাচ্ছি। নৌকার পক্ষেই সাধারণ ভোটাররা আছে।’</p> <p>গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সবুজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২৬ তারিখের নির্বাচনে মানুষ উৎসাহ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবে। বঙ্গবন্ধুর কন্যার মুখে হাসি ফোটাতে আমরা ঐক্যবদ্ধ। তৃণমূলের ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমাদের শেষ মুহূর্তের প্রচার চলছে। আশা করছি বিপুল ভোটেই আমাদের প্রার্থীর বিজয় হবে।’ নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমতউল্লাহ খান বলেন, ‘নৌকার বিজয় এখন সময় মাত্র। নগরবাসী মুখিয়ে আছে নৌকায় ভোট দিতে।’</p> <p>নৌকার প্রতীকের প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বিগত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দিয়ে গাজীপুরবাসী যে ভুল করেছিল, এবার আর সেই ভুল করবে না। কারণ বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়ে গত পাঁচ বছরে মানুষকে শুধু কষ্টই দিয়েছে, শান্তি দিতে পারে নাই। নানা সমস্যায় জর্জরিত হলেও সেগুলোর সমাধান করে নাই। গাজীপুরের ভোগান্তি দূর করতেই মানুষ আমাকে ভোট দিবে। যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই মানুষের দুর্ভোগ দেখছি। সেই সব দুর্ভোগ দূর করতেই আমাকে ভোট দিতে প্রস্তুত নগরীর ভোটাররা।’</p> <p>দুপুরের পর নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের চান্দনা চৌরাস্তার রৌশন সড়ক এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, প্রচণ্ড রোদ ও ভাপসা গরম উপেক্ষা করে ৫০-৬০ জন নেতাকর্মী নিয়ে ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে ভোট চাইছেন সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সুরুজ আহাম্মদ। ২৬ জুনের ভোট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গজীপুরের মানুষ সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট ও অরাজকতার জবাব দিতে বিএনপিকেই আবার ভোট দিবে। আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচিত মেয়র অধ্যাপক মান্নানকে মিথ্যা ৩০টি মামলা দিয়ে দুই বছর জেলে রেখেছিল। তিনি উন্নয়ন কাজের জন্য টেন্ডার আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু কাজ করতে দেওয়া হয়নি। মিথ্যা মামলায় আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে জেলে আটকে রেখেছে। এসব অপকর্মের জন্য গাজীপুরের মানুষের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে আওয়ামী লীগ নানা অপকৌশল শুরু করেছে। তাদের ভোট কারচুপির স্বপ্ন সফল করতে দেওয়া হবে না। ভোটে কোনো অনিয়ম হলে মানুষ রুখে দাঁড়াবে।’</p> <p>২৪ নম্বর ওয়ার্ডের শিমুলতলী বাজারে শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে প্রচার চালাচ্ছিলেন জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সবুজ। ভোটের মাঠের অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যেখানেই যাচ্ছি ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে ভোট দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছে। পাশাপাশি তারা আমাদের কাছে নানা শঙ্কার কথাও বলছে। ভোটারদের আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা হুমকি দিচ্ছে। কোথাও কোথাও পুলিশ গ্রেপ্তারের হুমকি ও বাসায় অভিযান চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এতে ভোটাররা নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে কি না তা নিয়ে আতঙ্কে ভুগছে। ভোটাররা যদি ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে এবং ভোট দিতে পারে তাহলে আমাদের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন।’</p> <p>জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিল্পপতি সোহরাব হোসেন বলেন, ‘সুষ্ঠু ভোট নিয়ে আমরা শঙ্কিত। ৪২৫টি ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারা সবাই সাবেক ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ নেতা। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা একাধিকবার খোঁজখবর নিয়ে</p> <p>তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভোটগ্রহণ বিষয়ে তাদের গতকাল থেকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। তার আগে বৃহস্পতিবার দেওয়া হয় পোলিং অফিসারদের প্রশিক্ষণ। শুনেছি প্রশিক্ষণের নামে তাদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আচরণবিধি ভঙ্গ করে আওয়ামী লীগ সমাবেশ ও প্রচার চালাচ্ছে। এসব আলমত থেকে আমরা ভোট নিয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছি।’</p> <p>জেলা বিএনপির সহসভাপতি সিরাজ উদ্দিন কাইয়া বলেন, ‘৫৭টি ওয়ার্ডেই স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বিরামহীন প্রচার চালাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় নেতারা যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই মানুষের ঢল নামছে। বিএনপি প্রার্থী একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সৎ ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে গাজীপুরে পরিচিত।’</p> <p>নগরীর ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের হাড়িনাল বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ধানের শীষের মেয়র প্রার্থী হাসান সরকারের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন বিএনপি নেতা জয়নাল আবদিন (ভিপি জয়নাল)। বিজয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘গত নির্বাচনে সোয়া লাখ ভোটে আমরা জিতেছিলাম। কারচুপি না হলে এবার দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হব।’ তবে গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেক নেতাকর্মী ভয়ে মাঠে নামতে পারছে না বলে তিনি দাবি করেন।</p> <p>গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার রকিব উদ্দিন মণ্ডল বলেন, তাঁরা প্রভাবমুক্ত এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কাজ করছেন। কোনোভাবেই কাউকে কারচুপির সুযোগ দেওয়া হবে না। নির্বাচনে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কেউ নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করতে চাইলে বা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।</p>