<p>‘অন্যের কথা কী বলব, আমাকেই তো রীতিমতো এইডস আক্রান্ত বানিয়ে দিয়েছিল একটি টেস্টের রিপোর্ট! আমার সংসার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সুইসাইড করাই বাকি ছিল আমার। পরে গেলাম আরেকটি হাসপাতালের ল্যাবে। পরীক্ষা করিয়ে দেখলাম, আগের রিপোর্টটি ছিল ভুল।’ একজন চিকিত্সক নিজের এমন অভিজ্ঞতার কথা এভাবে বললেন কালের কণ্ঠকে।</p> <p>একটি হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই চিকিত্সক আরো বলেন, ‘পরে আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, মূলত ঝামেলাটি ছিল রি-এজেন্টে, যা দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ওই রি-এজেন্টে ভেজাল ছিল। অনেক রোগীর ক্ষেত্রেই এমন ভুল রিপোর্টের নজির পাওয়া যায়।’</p> <p>এর আগে ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকার একটি প্যাথলজিতে রক্ত পরীক্ষায় কামরাঙ্গীরচরের এক গৃহিণীর শরীরেও এইচআইভি শনাক্ত হয়। এমন রিপোর্টের ভিত্তিতে ওই নারী একদিকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, অন্যদিকে স্বামী-সন্তানরা তাঁকে ভুল বুঝে নানা অপবাদ দিতে থাকে। তাঁর সংসার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। একপর্যায়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন তিনি। পরে একজন চিকিত্সকের পরামর্শে ওই নারীকে নিয়ে আইসিডিডিআরবি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দফা পরীক্ষা করানো হয়। ওই দুই প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে এইচআইভির কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি। তখন স্বাভাবিক হয় ওই নারীর জীবন। পরে ওই নারীর স্বজনরা প্রথম প্যাথলজিক্যাল ল্যাবে গিয়ে চড়াও হলে ল্যাব কর্তৃপক্ষ জানায়, অসাবধানতাবশত ভুল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। পরে দুপক্ষে সমঝোতার মাধ্যমে ঘটনার সমাপ্তি ঘটে।</p> <p>বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা জানান, একজন চিকিত্সক রোগীর রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টের ওপর নির্ভর করেন। রিপোর্ট দেখে চিকিত্সক ব্যবস্থাপত্র দেন। সেই রিপোর্ট যদি হয় ভুল, তবে ওষুধ ও পরবর্তী সব চিকিত্সাই ভুল হবে এটাই স্বাভাবিক। এতে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। তাই উচ্চ ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ বা সাধারণ টেকনোলজিস্ট যাঁরাই রোগীর বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন, তাঁদের অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে।</p> <p>জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা জানান, ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য ভুল বা ভুয়া মেডিক্যাল রিপোর্টে ক্ষতির শিকার হয় রোগীরা। দেশে বহু ডায়াগনস্টিক ল্যাব ও প্যাথলজি আছে অবৈধ বা নিম্নমানের। আবার অনেক ল্যাব কাগজে-কলমে বৈধ তথা দৃশ্যত মানসম্পন্ন হলেও ভেতরে চলে মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিক্যাল বা নষ্ট ও নিম্নমানের যন্ত্রপাতি দিয়ে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা, যা সাধারণ কোনো রোগী বা মানুষের পক্ষে ধরা সম্ভব নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির অভাবে দিনের পর দিন চলে এমন পরিস্থিতি। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতাল থেকেও দালালচক্রের মাধ্যমে রোগীদের নিয়ে যাওয়া হয় নামসর্বস্ব ও অবৈধ সব ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা প্যাথলজিক্যাল ল্যাবে। তাদের সঙ্গে একশ্রেণির চিকিত্সকের অসাধু কমিশন বাণিজ্য থাকে।</p> <p>সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে স্বাচিপের এক গোলটেবিল আলোচনায় বলেন, একশ্রেণির চিকিত্সকের কমিশন বাণিজ্য নিয়ে আমরা লজ্জায় পড়ে যাই। অসাধু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে ডাক্তারদের কমিশন বাণিজ্য দ্রুত বন্ধ করা দরকার; নইলে রোগীরা যেমন প্রতারিত হয় তেমনি বিপদগ্রস্তও হয়। সেই সঙ্গে গোটা চিকিত্সক সমাজের মর্যাদাহানি ঘটে।</p> <p>বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সনাল কালের কণ্ঠকে বলেন, রোগ নির্ণয়ের উপাদান-উপকরণেই যদি ভেজাল থাকে, তবে তো রিপোর্ট সঠিক হবেই না। আর রিপোর্ট ঠিক না হলে চিকিত্সাও ঠিক হবে না, এটাই তো স্বাভাবিক। তাই ল্যাবরেটরি মেডিসিন সেবার মান নিশ্চিত করতে সরকারের জায়গা থেকে আরো নজরদারি বাড়ানো দরকার।</p> <p>ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, কয়েক দিন আগে র‌্যাবের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে রাজধানীর শ্যামলী এলাকার লাইফটেক ও ভিউটেক নামের দুটি প্রতিষ্ঠানে চীন থেকে অবৈধভাবে আমদানি করা ও ভেজাল মেশানো রি-এজেন্ট (রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপাদান-উপকরণ) জব্দ করা হয়। এর মধ্যে লাইফটেক নামে প্রতিষ্ঠানটিতে পাওয়া রি-এজেন্টে উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান, দেশের নাম, উত্পাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের কোনো তারিখ ছিল না। এ অপরাধে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. আসাদুজ্জামানকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। আর ভিউটেক নামের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে মজুদ করা রি-এজেন্ট ছিল নিম্নমানের আর সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল না। এ অপরাধে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক মোবারক হোসেনকে আট লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে দুই মাস ১৫ দিনের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।</p> <p>এর আগে আরেক অভিযানে পুরান ঢাকার পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মেডিনোভা মেডিক্যাল সার্ভিসেসসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল রি-এজেন্ট, আগাম স্বাক্ষর করা রিপোর্ট কার্ড উদ্ধার করা হয়। পাওয়া যায় ডাক্তারের ভুয়া সিল। এসব অপরাধের দায়ে মেডিনোভার ম্যানেজারকে আটক ও আট লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজারসহ কয়েকজনকে আটক করে ছয় লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও  মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহারের অভিযোগে ম্যানেজারসহ তিনজনকে আটক করে চার লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে প্রত্যেককে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।</p> <p>এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি টিম সম্প্রতি আকস্মিক অভিযান চালিয়ে রাজধানীর চানখারপুল এলাকায় ১৭টি রোগ নির্ণয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫টিতেই কোনো না কোনো অনিয়ম দেখতে পায়। এর মধ্যে ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কয়েকটি রি-এজেন্ট মেয়াদোত্তীর্ণ পাওয়া যায়। আবার দুটি প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায় অনুমোদনহীন। কয়েকটিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল না। কোনো কোনোটিতে নেই উপযুক্ত চিকিত্সক, টেকনিশিয়ান বা প্যাথলজিস্ট। অদক্ষ ও ভুয়া জনবল দিয়ে কেউ কেউ চালাচ্ছিল এসব প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া লালবাগের আরাফাত ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি তাত্ক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।</p> <p>স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ল্যাবরেটরিগুলোতে ব্যবহৃত রি-এজেন্টের মানসহ সার্বিক মানদণ্ড নিশ্চিত করা না গেলে রোগীদের জন্য বিপদ বয়ে আনবে। তিনিও জানান, ল্যাবরেটরির অনুমতি দিলেও উপযুক্ত উপকরণ ও জনবল আছে কি না, তা ঠিকভাবে দেখা হয় না।</p> <p>স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশের আটটি বিভাগে প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের অনুমোদিত সংখ্যা প্রায় আট হাজার। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগেই আছে প্রায় চার হাজার, যার বেশির ভাগই রয়েছে ঢাকা মহানগরীতে।</p> <p>একই সূত্র জানায়, সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি পরিদর্শন টিম গাজীপুরে ১৪টি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিদর্শন করে প্রায় সবটাতেই কোনো না কোনো অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপও নেওয়া হয়।</p>