<p>যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ কমিটির কর্মকর্তা পিটার ডাব্লিউ গ্যালব্রেইথ ১৯৮৮ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে পর পর (ব্যাক-টু-ব্যাক) বৈঠক করেছিলেন। আলাপকালে উভয় নেত্রীই বলেছিলেন, তাঁরা মনে করেন এরশাদ মার্কিন সহায়তা পাচ্ছেন। একপর্যায়ে গ্যালব্রেইথ খালেদা জিয়ার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যুক্ত পার্টি গঠন এবং নতুন সরকারে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি এবং শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। খালেদা জিয়া তীব্রভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।</p> <p>চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর অবমুক্ত করা নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। কনফিডেনশিয়াল (গোপন নথি) লেখা ওই নথি ছিল ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের। এর মাধ্যমে এরশাদ সরকারের শেষ দিকে বাংলাদেশে সম্ভাব্য সরকার পরিবর্তন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ লক্ষ করা যায়।</p> <p>গ্যালব্রেইথের সঙ্গে বৈঠকে দুই নেত্রীই দাবি করেছিলেন, সব কিছুর আগে রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। তাঁরা দুজনই ওই বছরের ৩ মার্চের নির্ধারিত সংসদ নির্বাচনের বিরোধিতা করেন। তখনও দুজনের মধ্যে একে অন্যের প্রতি ব্যক্তিগত অপছন্দের বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। তাঁদের ‘ঐকমত্য’ ছিল কেবল এক দফায়। তা হলো এরশাদের অপসারণ। এর বাইরে তাঁদের মধ্যে ঐক্যের কোনো লক্ষণ ছিল না।</p> <p>গ্যালব্রেইথ দুই নেত্রীর কাছেই জানতে চেয়েছিলেন বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের সাহায্য করতে পারে। এ সময় বিএনপির জবাব ছিল, “এরশাদকে ‘যথাযথ’ পদক্ষেপ নিতে হবে।” আর শেখ হাসিনার  জবাব ছিল, ‘তাঁকে (এরশাদ) পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে।’ আলাপকালে দুই নেত্রীই বলেছিলেন, তাঁরা বিশ্বাস করেন এরশাদ মার্কিন সহায়তা পাচ্ছেন। এ সময় গ্যালব্রেইথ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ হলো বাংলাদেশে মানবিক সহায়তা এবং দেশের জনগণের অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নতিতে কাজ করা।</p> <p>নথিতে বলা হয়, গ্যালব্রেইথ দুই নেত্রীর সঙ্গে আলাপ করে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কারণ দুই নেত্রীই এরশাদ সরকারের পরিবর্তন ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁদের কোনো পরিকল্পনার কথা তুলে ধরতে পারেননি।</p> <p>খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলাপকালে তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মহাসচিব লে. ক. (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান। শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপকালে তাঁর সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এবং ওআইসিতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আরশাদুজ্জামান।</p> <p>বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির কর্মকর্তা গ্যালব্রেইথ বিএনপি নেত্রীর কাছে জানতে চান—যদি প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন একই দিনে হয়, তাহলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সহায়তা করার উপায় কী হতে পারে। এ সময় কর্নেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এ সময় আবারও গ্যালব্রেইথ জানতে চান, যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের সহায়তা করতে পারে। জবাবে মুস্তাফিজ বলেন, “আপনারা এরশাদকে চাপ দিন, যাতে সে ‘সঠিক’ কাজটি করে।”এ সময় খালেদা জিয়া সম্মতি জানান। এ সময় খালেদা জিয়া ও মুস্তাফিজ এরশাদ, তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের দুর্নীতির বিষয় তুলে ধরেন।</p> <p>একপর্যায়ে গ্যালব্রেইথ প্রশ্ন করেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ‘যুক্ত পার্টি’ গঠনের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। তখন খালেদা জিয়া ও মুস্তাফিজ দুজনই সজোরে বলেন, এটা অসম্ভব। কারণ দুটির পার্টির মধ্যে পার্থক্য অনেক। তাদের আলাদা লক্ষ্য, নীতি, কৌশল ইত্যাদি রয়েছে। এটা (চলমান আন্দোলন) হলো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, এরশাদকে অপসারণের জন্য। এর বেশি কিছু নয়। এ সময় গ্যালব্রেইথ বলেন, তিনি এমন একটি আলাপ শুনেছেন যে ভবিষ্যৎ সরকারে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি হতে পারেন এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। খালেদা জিয়া এ কথা শুনে খুব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান এবং তীব্রভাবে এমন সম্ভাবনার কথা প্রত্যাখ্যান করেন। এ সময় মার্শাল লয়ের সম্ভাবনার কথা জিজ্ঞেস করলে মুস্তাফিজ বলেন, এমনটা হলে তা ‘বাজে’। মিলিটারি শুরুতে ‘দ্রুত নির্বাচনের’ কথা বলবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনের কোনো গ্যারান্টি তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। তবে মার্শাল ল মেনে নেওয়ার ব্যাপারে খালেদা জিয়াকে অনেক বেশি ইচ্ছুক মনে হয়েছিল তখন, যদি নতুন সামরিক শাসক দ্রুত নির্বাচন দেয়।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা গ্যালব্রেইথ জানতে চান, বিরোধীদের দাবি অনুযায়ী ‘নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ প্রধান হিসেবে বিএনপি কারো নাম প্রস্তাব করবে কি না। এ সময় খালেদা জিয়া বলেন, প্রধান বিচারপতি আব্দুল মুনিম ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বিচারপতিকেই তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে মেনে নেবেন। কারণ আব্দুল মুনিম হলেন এরশাদের লোক। তিনি বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কেউ তাঁকে মানবে না।</p> <p>খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপির লোকজন এবং দেশের মানুষ মনে করে, এরশাদের ক্ষমতায় থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্র দায়ী। জবাবে গ্যালব্রেইথ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে মানবিক সহায়তা, জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে আগ্রহী। আলাপের শেষ পর্যায়ে গ্যালব্রেইথ জানতে জানান, যুক্তরাষ্ট্র সফরের কোনো পরিকল্পনা খালেদা জিয়ার আছে কি না। জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান। কারণ বিএনপির ‘অনেক বন্ধু’ সেখানে (যুক্তরাষ্ট্রে) আছে। বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের জানা গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় গ্যালব্রেইথ ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসকে সহায়তা করার জন্য খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করেন।</p> <p>শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে তিনি ও তাঁর সঙ্গে থাকা আরশাদুজ্জামান দুজনই মার্কিন কর্মকর্তা গ্যালব্রেইথকে ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের সমাবেশের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। হাসিনা জানান, পুলিশ সেদিন গুলি করে ৭০ জনকে হত্যা করেছিল। এমনকি পুলিশের ট্রাকের লক্ষ্য ছিল তাঁকে চাপা দেওয়া। এ সময় এরশাদের খারাপ আচরণের কথা উল্লেখ করে হাসিনা বলেন, এরশাদই কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদকে ফ্রিডম পার্টি গঠন করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এ সময় গ্যালব্রেইথ জানান, তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে সন্তুষ্ট। কারণ তাঁর বাবা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে তাঁর জাতির জনক।</p> <p>বৈঠকে গ্যালব্রেইথ জানতে চান, যুক্তরাষ্ট্র কী করতে পারে। তখন শেখ হাসিনা বলেন, তিনি চান যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে (এরশাদ) পদত্যাগ করতে বাধ্য করুক। কারণ দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, যুক্তরাষ্ট্রই এরশাদকে ক্ষমতায় রেখেছে। এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশকে অবশ্যই মার্শাল ল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নতুন করে মার্শাল ল হলে তাঁর দল কিভাবে নেবে—এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের সব মানুষই মনে করে, এরশাদকে বিদায় নিতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, তিনি মনে করেন, স্বচ্ছ নির্বাচন হলে আওয়ামী জয়লাভ করবে। কারণ শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর ভালোবাসা এ দেশের মানুষের রয়েছে এবং আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে সংগঠিত দল। বৈঠকে শেখ হাসিনা প্রশ্ন রাখেন, যদি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সরকারকে সমর্থন করবে কি না। জবাবে গ্যালব্রেইথ বলেন, একটি স্বচ্ছ নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ যাকেই নির্বাচিত করবে, যুক্তরাষ্ট্র তাকে সমর্থন করবে। বৈঠকে শেখ মুজিবের প্রতি সর্বোচ্চ প্রশংসা করায় গ্যালব্রেইথের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন হাসিনা, বিশেষ করে শেখ মুজিবকে জর্জ ওয়াশিংটনের সঙ্গে তুলনা করায়।</p> <p> </p>