<p>বাংলাদেশে দূষিত বাতাস কতটা বিপজ্জনক ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ মিলল বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে। সংস্থাটি বলছে, শুধু এক বছরে (২০১৩ সালে) বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে এক লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। দুই দশক আগে ১৯৯০ সালে দেশে বায়ুদূষণে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার। সে হিসাবে ২৬ বছরে বায়ুদূষণে মানুষের মৃত্যুর হার বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের (আইএইচএমই) যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে। যৌথ গবেষণায় বিশ্বব্যাংক ও আইএইচএমই বলেছে, বাংলাদেশে বাতাসে সবচেয়ে ক্ষতিকর সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটার বা ভাসমান বস্তুকণার মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এক লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৮ জনের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষেরই মৃত্যু হয়েছে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার কারণে।</p> <p>গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের টেকসই উন্নয়ন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট লাউরা টাক, মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট কিথ হেনসেন ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন (আইএইচএমই) পরিচালক ক্রিস্টিফার মারে।</p> <p>গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশেও দ্রুত শিল্পায়নের প্রসার ঘটছে। নির্মাণ শিল্প এখন একটি বিকাশমান খাত। এর পাশাপাশি কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জ্বালানি থেকেও দূষণের মাত্রা বাড়ছে। এর ফলে দূষিত হচ্ছে বাতাস। বায়ুদূষণের কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার হাজারীবাগের চামড়া প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলো থেকে প্রতিনিয়তই হাইড্রোজেন, সালফার ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়াসহ বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হচ্ছে। শিল্প-কারখানা ও যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং ইটভাটা, চিনিকল, সার কারখানা, পাটকল, বস্ত্র ও পোশাক কারখানা থেকেও বায়ুদূষণ ঘটছে। সামগ্রিকভাবে টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বায়ুদূষণ বড় ধরনের হুমকি বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।</p> <p>জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে উন্নয়নকাজ বেড়েছে। আর এই উন্নয়নমূলক কাজ চলছে পুরোপুরি অপরিকল্পিতভাবে। এ কারণে বাতাস দূষিত হচ্ছে বেশি। এ ছাড়া রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণেও বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা বাড়ছে। তিনি বলেন, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে এখন যেসব রোগী ভর্তি হয়, তাদের মধ্যে ইন্টারস্টিসিয়াল লাং ডিজিস (আইএলডি) রোগীর সংখ্যা বেশি। এ রোগের প্রধান কারণ দূষিত বাতাস। গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের কারণে চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে ৬ শতাংশ।</p> <p>এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক এক গবেষণায়ও দেখা গেছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রভাবে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। নব্বইয়ের দশকে যেখানে বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে বছরে মৃত্যু ছিল ৩১ হাজার, সেটি এখন বেড়ে এক লাখ ছুঁই ছুঁই। বাংলাদেশ সরকার বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার জাতীয় মাত্রা নির্ধারণ করেছে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু বিশ্বব্যাংক ও আইএইচএমইর গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার মাত্রা জাতীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এটি ১৫০ মাইক্রোগ্রামের ওপরে।</p> <p>সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ অ্যাজমা বা হাঁপানিতে আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার উপস্থিতি। ফুসফুস ক্যান্সারে মৃত্যুর অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ।</p> <p>গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় চীন ও ভারতে। ১৯৯০ সালে ভারতে যেখানে বায়ূদূষণে মারা গেছে ১০ লাখ, সেটি ২০১৩ সালে বেড়ে ১৫ লাখে ঠেকেছে। আর চীনে বায়ুদূষণে ২০১৩ সালে মারা গেছে ১৭ লাখ, ১৯৯০ সালে এটি ছিল ১৫ লাখ। গবেষণা মতে, চীনে বায়ুদূষণের মূল কারণ মাত্রাতিরিক্ত কয়লা ব্যবহার। চীন তার জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করে কয়লা পুড়িয়ে। ২০১৩ সালের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে। চীনে বায়ুদূষণের মাত্রা কমাতে ১০০ কোটি ডলার অর্থায়ন করারও ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। শিল্প-কারখানা থেকে দূষণ কমিয়ে আনতে এই অর্থ খরচ করা হবে।</p> <p>বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটু সচেতন হলেই দেশে বায়ূদূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ করার সময় নিয়মিত পানি ছিটানো, বড় ভবন নির্মাণের সময় পানি ছিটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন আচ্ছাদন ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া ইস্পাত কারখানা, রি-রোলিং মিলসহ এ ধরনের কলকারখানায় বস্তুকণা নিয়ন্ত্রণমূলক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করারও পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।</p>