<p>একাত্তরের রণাঙ্গনে ইউনিয়ন পরিষদের একজন চেয়ারম্যান শত্রুসেনাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এই দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধার নাম আকবর হোসেন মিয়া। যশোর ও ফরিদপুর জেলার বিশাল এলাকাজুড়ে দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন এই যোদ্ধা। মাত্র সাতটি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে শুরু করে একটি বিশাল সশস্ত্র আঞ্চলিক বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর এই স্বতন্ত্র বাহিনী প্রথমে ‘শ্রীপুর বাহিনী’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও পরে ‘আকবর বাহিনী’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।</p> <p>তেজোদীপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেনের জন্ম মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার টুপিপাড়া গ্রামে। ১৯৫১ সালে যোগ দেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। ‘কিন্তু পাকিস্তানিদের অশ্রাব্য গালিগালাজ আর অবজ্ঞাসুলভ ব্যবহার আমার মন বিষিয়ে তুলল। অবশেষে ১৯৫৪ সালে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলে এলাম স্বদেশ ভূমিতে।’—স্মৃতিকথায় লিখেছেন আকবর হোসেন। এরপর তিনি সাধারণের সেবার ব্রত নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দেন এবং শ্রীপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি নিজ ইউনিয়ন শ্রীকোলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং টানা ২৪ বছর এই দায়িত্ব পালন করেন।</p> <p>আকবর হোসেনের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য মাগুরা আনসার ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়। শ্রীপুর কলেজের বিপুলসংখ্যক ছাত্রসহ বিভিন্ন এলাকার তরুণ-যুবকরা এতে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মাগুরায় এমএনএ, এমপিএর নেতৃত্বে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে উঠলে ওই কমিটির বেশির ভাগ নেতা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। ক্যাম্পের অধিকাংশ যোদ্ধাও নেতাদের অনুসরণ করলে ক্যাম্পটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। নেতৃত্ব নেই, নেই সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। এ অবস্থায় ক্যাম্পের ছয়টি রাইফেল, একটি ওয়্যারলেস সেট আর ছয়জন সঙ্গী নিয়ে শ্রীপুর চলে যান আকবর। আগে থেকেই তাঁর ছিল একটি চাইনিজ রাইফেল। এদিকে চারপাশে শুরু হয়ে যায় লুটতরাজ, ডাকাতি, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড। টার্গেটে পরিণত হয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আকবরের ভাষায়, ‘মুক্তি সংগ্রাম লুটের সংগ্রামে পরিণত হলো। এ অবস্থায় নিজ এলাকার নিরীহ মানুষকে রক্ষার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন আকবর চেয়ারম্যান। প্রতিরোধের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন একটি বাহিনী। মে মাসের দিকে এই বাহিনীতে ছিলেন ৭০ জন যোদ্ধা। আর অস্ত্র বলতে ছিল মাত্র ২৪টি রাইফেল। তাঁরা অস্ত্র হাতে রাত জেগে পাহারা দিতে থাকেন গ্রামগুলো।</p> <p>আকবর বাহিনীকে প্রথমদিকে দ্বিমুখী শত্রুর মোকাবিলা করতে হয়। একদিকে স্থানীয় ও আঞ্চলিক দুষ্কৃতকারী দস্যু ও ডাকাতদল, অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী। বেশ কয়েকজন কুখ্যাত ডাকাতের বিরুদ্ধে পরিচালিত খতম অভিযান সফল হলে এই বাহিনীর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এই বাহিনীতে ছাত্র, আনসার, ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু পলাতক সদস্য এবং স্থানীয় যুবকরা যোগ দিতে থাকেন। আকবর তাঁদের নিয়ে একটি ব্যাটালিয়ন গড়ে তোলেন। এই পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য টুপিপাড়া গ্রামে ক্যাম্প খোলা হয়।</p> <p>জুন মাসের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা শুরু করে আকবর বাহিনী। শত্রুদের জন্য দ্রুতই আকবর বাহিনী আতঙ্ক হয়ে ওঠে। একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে নিজ এলাকার বাইরে গড়ে ওঠা পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেন এই বাহিনীর সাহসী যোদ্ধারা। বিশেষ করে শ্রীপুর থানা দখল, শৈলকুপা থানা আক্রমণ, ইছাখাদা রাজাকার ক্যাম্প ও মাগুরা আনসার ক্যাম্পে হামলা, আলফাপুরের যুদ্ধ, নাকোলের যুদ্ধ, বিনোদপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির রামদিয়াতে পাকিস্তানিদের সহযোগী চাঁদ খাঁর বাড়ি আক্রমণ—এসবই আকবরের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।</p> <p>শত্রুর কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েই এই বাহিনী তাদের অস্ত্রের চাহিদা মিটিয়েছিল। বাহিনীর খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদার জোগান দেয় স্থানীয় জনগণ। অধিকৃত অঞ্চলে বাহিনীপ্রধান একটি প্রশাসন গড়ে তোলারও চেষ্টা করেন। বাহিনীর বিভিন্ন দায়িত্ব বিভিন্নজনের ওপর ভাগ করে দেওয়া ছিল। মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর শ্রীপুরের ওসি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের এসআই বীর মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হোসেনকে। গরিব মুক্তিযোদ্ধাদের ৪০ টাকা করে মাসিক ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মাগুরা, ঝিনাইদহ, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও ফরিদপুরের বিভিন্ন গ্রামের সাধারণ পরিবারের মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন এই বাহিনীর সক্রিয় সদস্য।</p> <p>আকবর বাহিনীতে ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের মোট ১২৮ জন এবং সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা কিশোর-তরুণ-যুবক মিলিয়ে হাজারের মতো যোদ্ধা ছিলেন। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য শ্রীপুরের চার পাশে ছোট ছোট মুক্তিযোদ্ধা দল তৈরি করেন আকবর। এই বাহিনীর যোদ্ধারা শ্রীপুর, বালিয়াকান্দি, শৈলকুপা, পাংশা, ঝিনাইদহ ও রাজবাড়ী অর্থাৎ ঝিনাইদহের গাড়াগঞ্জ থেকে ফরিদপুরের গোয়ালন্দ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাঁদের দখলে আনেন। এই বাহিনীর তৎপরতার কারণেই সে সময় শ্রীপুরে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা কোনো ধরনের ক্যাম্প স্থাপন করতে পারেনি। দুর্ধর্ষ এই বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ ও প্রতিরোধের খবর তখন প্রচারিত হয়েছিল বিবিসি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে।</p> <p>গোটা মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনী স্বতন্ত্র বাহিনী হিসেবে পরিচালিত হয়। যদিও তিনি মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতির কাছে অস্ত্র সহায়তার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। কাঙ্ক্ষিত অস্ত্র সহায়তা না পেলেও একটি এলএমজি পেয়েছিলেন। মুক্তিবাহিনীর ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ মঞ্জুর এক পত্রের মাধ্যমে এই বাহিনীকে ‘শ্রীপুর বাহিনী’ ও আকবর হোসেনকে বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তবে যুদ্ধ চলাকালেই এই বাহিনী পরিচিতি পায় ‘আকবর বাহিনী’ নামে।</p> <p>আকবর বাহিনীই ৭ ডিসেম্বর মাগুরা শত্রুমুক্ত করে এবং পরবর্তী সময়ে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ফরিদপুরে অভিযান চালায়। এই বাহিনীর ৪১ জন বীর যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।</p> <p>আকবর হোসেনের অন্যতম সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা মোল্লা নবুয়ত আলী জানান, মুক্তিযুদ্ধের পর সরকার তাঁদের এই স্বতন্ত্র বাহিনীকে স্বীকৃতি দেয়নি। এই বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে একটি মামলাও চলছে হাইকোর্টে।</p> <p>আকবর হোসেন ৮৯ বছর বয়সে মারা যান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যা সন্তানের জনক। আমৃত্যু তিনি রাজনীতি ও জনসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। গড়ে তোলেন বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। মৃত্যুকালে শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। জীবদ্দশায় তাঁর লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে আমি ও আমার বাহিনী’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে আকবর বাহিনীর নিয়মিত সদস্য হিসেবে ৩৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে।</p> <p>স্থানীয় সাংবাদিক জাহিদ রহমান আকবর বাহিনীর প্রধান আকবর হোসেন সম্পর্কে বলেন, নেতা হিসেবে আকবর ছিলেন অনুকরণীয় চরিত্রের। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রের কাছ থেকে যথার্থ মূল্যায়ন পাননি। তবে জনগণের ভালোবাসা পেয়েছেন অঢেল।</p> <p>প্রতিবেদনটিতে তথ্য সহায়তা দিয়েছেন মাগুরা প্রতিনিধি শামীম খান।</p>