<p> ড্রয়িং রুমে সাজানো আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)। আছে লাইফ সাপোর্টের সরঞ্জাম। ডাইনিং রুমে কিডনি রোগীদের ডায়ালিসিস সেন্টার। বেডরুমে নবজাতক শিশুদের এনআইসিইউ। কিন্তু ডাক্তার বসেন কোথায়? খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল রান্নাঘরে! রীতিমতো চেয়ার-টেবিল আর রোগীর জন্য শয্যা সাজিয়ে ডক্টরস রুম বানানো হয়েছে রান্নাঘরটিকে। বাইরে বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা হাসপাতালের নাম। সঙ্গে ডাক্তারের নামের তালিকা। এমন ঘরোয়া হাসপাতালে মৃত্যু ঘটেছে তিন নবজাতকের। ঘটনার পর হাসপাতালটি বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই হাসপাতালের একজন মালিক ও তিনজন ডাক্তার আছেন কারাগারে।</p> <p> এর কয়েক দিন আগে ধানমণ্ডির কনশাস মেডিক্যাল সেন্টারে এনআইসিইউতে আরেক শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। শিশুটির স্বজনদের অভিযোগ ছিল, ওই আইসিইউটি ছিল ভুয়া। আইসিইউয়ের জন্য যেসব উপকরণ থাকা প্রয়োজন তা ছিল না বলেই শিশুটির মৃত্যু হয়। ওই ঘটনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তদন্ত করে অভিযোগের অনেকাংশেই সত্যতা পায়। ফলে ওই হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন আবার হাসপাতালটি চালুর অনুমোদন পেলেও আইসিইউ বা এনআইসিইউয়ের অনুমোদন আর দেওয়া হয়নি।</p> <p> আরো আগে নামকরা এক হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল আইসিইউতে থাকা রোগীর মৃত্যুর পরও স্বজনকে তা জানানো হয় কয়েক দিন পরে। কেবল বাড়তি টাকা আদায়ের জন্য এমনটা করা হয়েছিল বলে তখন অভিযোগ করা হয়েছিল।</p> <p> কেবল এ দু-তিনটি ঘটনাই নয়, লাইফ সাপোর্টের নামে মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অসাধু হাসপাতাল ব্যবসায়ী যেনতেনভাবে আইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউ সাজিয়ে বসেছেন। পথেঘাটে অলিগলিতে এখন চোখে পড়ে এমন আইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউয়ের সাইনবোর্ড। বেসরকারি এসব হাসপাতাল বা ক্লিনিকে এমন বেপরোয়া লাইফ সাপোর্টের ব্যবসা চললেও এর জন্য সরকারের তরফ থেকে নেই কোনো আলাদা অনুমোদন। এমনকি এসব লাইফ সাপোর্টের ইউনিটগুলোর বেশির ভাগেই নেই উপযুক্ত যন্ত্রপাতি, নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক বা নার্স। অথচ এসব হাসপাতাল বা ক্লিনিকে দিনে পাঁচ-সাত হাজার থেকে শুরু করে মান ভেদে ৫০-৬০ হাজার টাকা করেও আদায় করা হয়। কোনো কোনো হাসপাতালে বেড ভাড়া আলাদা নিয়ে প্রতিটি যন্ত্রের জন্য আলাদা করে ঘণ্টা হিসাবেও ভাড়া আদায় করা হয়। এ ক্ষেত্রে আরো বেশি ভাড়াও নিয়ে থাকে বড় কিছু বেসরকারি হাসপাতাল। আর সরকারের তরফ থেকে এত দিন এমন বিশৃঙ্খলা রোধে তেমন কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। কোন বেসরকারি হাসপাতালে কতটি আইসিইউ-এনআইসিইউ আছে এরও কোনো সঠিক হিসাব নেই কর্তৃপক্ষের কাছে।</p> <p> পরিস্থিতি সম্পর্কে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে চিকিৎসকদেরই নেতা বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে এখন যেন লাইফ সাপোর্টের নামে আইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউয়ের নতুন এক উপদ্রব শুরু হয়ে গেছে, যা অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে একরকম জিম্মি করে অর্থ আদায়ের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের দিক থেকেও কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।</p> <p> এদিকে সর্বশেষ এশিয়ান হাসপাতালে তিন শিশুর মৃত্যুর ঘটনার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের জন্য। পাশাপাশি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বেসরকারি জেনারেল হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউ, ডায়ালিসিসের মতো বিশেষায়িত কোনো ইউনিট চালাতে হলে আগেভাগেই আলাদা অনুমোদন নিতে হবে।</p> <p> জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বেসরকারি অনেক হাসপাতাল বা ক্লিনিকে এমন প্রতারণার ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। একাধিক ঘটনার তদন্তেও আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি। এসব ইউনিটের জন্য উপযুক্ত জনবল ও যন্ত্রপাতি না থাকতেও সাইনবোর্ড টাঙিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসা করা হচ্ছে। তাই এখন আমরা এ বিশৃঙ্খলা রোধে পদক্ষেপ নিয়েছি। শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'</p> <p> ডা. সামিউল ইসলামের স্বাক্ষরেই গত ২৯ সেপ্টেম্বর একটি সার্কুলারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক নির্দিষ্টসংখ্যক শয্যাবিশিষ্ট সাধারণ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স গ্রহণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিনা অনুমতিতে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা- আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিইউ, কিডনি ডায়ালিসিস, ডায়াবেটিস ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি ও জনবলের অভাবে কখনো কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার উদ্ভব হচ্ছে। তা ছাড়া সঠিক তথ্যের অভাবে এসব সেবা প্রদানের বিষয়ে মনিটরিং কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে। এ কারণে সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিককে ১০ দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানে সেবার ধরন, চিকিৎসক ও নার্সসহ কর্মরত মোট জনবল ও ব্যবহৃত চিকিৎসা-যন্ত্রপাতির সংখ্যা জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।</p> <p> জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেশে আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিইউ, কিডনি ডায়ালিসিস ইউনিটের চাহিদা বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরাও এখন কথায় কথায় আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিইউ, কিডনি ডায়ালিসিসের পরামর্শ দিচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্যসংখ্যক এ সেবা থাকার কারণে বেসরকারি পর্যায়ে এটাকে মওকা হিসেবে নেওয়া হয়েছে। কারণ একজন চিকিৎসক যখন কোনো রোগীর স্বজনকে রোগীর জীবন বাঁচাতে হলে আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দেন তখন রোগীর স্বজনরা ভালোমন্দ কোনো দিকে না তাকিয়ে ছোটাছুটি শুরু করে ওই বেডের জন্য। আর সরকারি হাসপাতালে সহজে এসব বেড পাওয়া যায় না। সিরিয়ালে থাকতে হয় দিনের পর দিন। সাধারণত কোনো রোগী সুস্থ হয়ে সাধারণ বেডে কিংবা বাড়ি না যাওয়া পর্যন্ত আইসিইউ-এনআইসিইউয়ের বেড খালি হয় না। আর অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত এক শ্রেণির সরকারি চিকিৎসক ও কর্মচারী নিজেদের বাড়তি কমিশন বা অর্থ আয়ের লোভে রোগীকে পাঠিয়ে দেন নিজ নিজ পছন্দের বেসরকারি হাসপাতালে। যেমনটা ঘটেছে লালমাটিয়ায় এশিয়ান হাসপাতালে মারা যাওয়া তিন শিশুর ক্ষেত্রে। ওই তিন শিশুকেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে পাঠানো হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছিল স্বজনরা। বেশির ভাগ হাসপাতালেই আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিইউ, কিডনি ডায়ালিসিস ইউনিট পরিচালনার জন্য নিজস্ব কোনো চিকিৎসক নেই। বরং সরকারি হাসপাতালের একেকজন চিকিৎসক একাই কয়েকটি করে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিইউতে কাজ করেন। ফলে প্রয়োজনমতো তিনি সব হাসপাতালে উপস্থিত থাকতে পারেন না। বরং ফোনে ফোনে চিকিৎসা বা পরামর্শ দিয়ে থাকেন, যা রোগীর জন্য ভয়াবহ বিপদ বয়ে আনে। এশিয়ান হাসপাতালের ক্ষেত্রে এমন ঘটনাই ঘটেছিল।</p> <p> ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন সহযোগী অধ্যাপক ওই হাসপাতালের আইসিইউয়ের দায়িত্বে থাকা ডা. মোজাফফর আহম্মেদ ছিলেন এশিয়ান জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউয়ের প্রধান কনসালট্যান্ট। তবে তিনি সব সময় এখানে থাকতেন না বলে নিজেই স্বীকার করেন কালের কণ্ঠের কাছে। তিনি বলেন, 'আমি কেবল এশিয়ানেই নয়, আরো একাধিক হাসপাতালে আইসিইউয়ের সঙ্গে আছি। তবে সব সময় আমাদের যেতে হয় না। অনকলে থাকি। এমনকি যেখানে আইসিইউয়ের রোগীদের দেখতে ডাকা হয় সেখানেই সুযোগ বা সময় পেলে গিয়ে পরামর্শ দিয়ে আসি।'</p> <p> এশিয়ান হাসপাতালের ঘটনায় কারাগারে থাকা ডা. আফতাবউদ্দিনের মূল কর্মস্থল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। তিনি ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক হয়েও এশিয়ান হাসপাতালের আইসিইউতে ডিউটি করতেন। এমনকি ওই ঘটনার পরদিন সকালে অন্য কাউকে না পাওয়া গেলেও তাঁকে পাওয়া যায় এশিয়ান হাসপাতালের ডক্টরস রুমের ভেতরে।</p> <p> গ্রেপ্তারের আগে ডা. আফতাব কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি এখানকার আইসিইউয়ের খণ্ডকালীন চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করে থাকি। মূলত আমি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক।' তিনি ওই সময় জানিয়েছিলেন, এখানকার বেশির ভাগ চিকিৎসকই খণ্ডকালীন কাজ করেন। স্থায়ী চিকিৎসক তেমন একটা নেই বললেই চলে।</p> <p> দেশের আইসিইউ সেবা নিয়ে সর্বশেষ ২০১০ সালে একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায় দেশের ৯০ শতাংশ আইসিইউ ইউনিটই ঢাকা মহানগরীতে। আর ২০১০ সালে ঢাকায় বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিটের সংখ্যা ছিল ৪০, আর সরকারি হাসপাতালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র চার। আর এসব ইউনিট মিলে মোট বেড সংখ্যা ছিল ৪২৪, যার মধ্যে ৬৪ শতাংশ চালান অ্যানেসথেটিস্টরা। ঢাকায় থাকা তখন ৪০টি ইউনিটের মধ্যে মাত্র ৯টিতে আইসিইউয়ের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুসারে (চার বেডের জন্য একজন) চিকিৎসক ছিল। আর মাত্র ১৫টিতে আইসিইউয়ের প্রতি রোগীর জন্য একজন নার্স দেখা যায়।</p> <p> স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক জানান, আগের সেই অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটেছে। সরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ৮০টি আইসিইউ বেড পূর্ণাঙ্গভাবে চালু আছে। এ ছাড়া কিছু এনআইসিইউ আছে। পাশাপাশি দেশের সব পুরনো মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কমপক্ষে আটটি এবং জেলা হাসপাতালে চারটি করে আইসিইউ চালুর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল আইসিইউয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এসব সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউ, ডায়ালিসিস সুবিধা চালু করা গেলে বেসরকারি পর্যায়ে আইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউ, ডায়ালিসিস ইউনিটের নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণামূলক তৎপরতা এমনিতেই কমে যাবে।</p> <p> এদিকে বেসরকারি হাসপাতাল ও প্রাইভেট ক্লিনিকে জীবন রক্ষাকারী বিশেষায়িত সেবা পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মো. নুরুল হক এতে সভাপতিত্ব করেন। এ সভায় ঢাকাসহ দেশের সব বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউ কিংবা ডায়ালিসিসের মতো চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাপনা সরেজমিনে গিয়ে দেখার জন্য বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের একটি টিম গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। শিগগিরই ওই টিম অভিযানে নামবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া হবে। কোথাও কোনো রকম অনিয়ম ধরা পড়লেই তাৎক্ষণিকভাবে ওই প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল)।</p>