<p> প্রাথমিকের পাঠ্য বইয়ে বহুল পঠিত কবিতার একটি 'বড় কে?'। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কবিতাটি পড়ানো হচ্ছে। শিশুদের আদর্শের পাঠ দেওয়ার ক্ষেত্রেও অভিভাবকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে এ কবিতা। এত দিন পাঠ্য বইয়ে এ কবিতার কবি হিসেবে লেখা ছিল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নাম। তবে চলতি বছর কবির নামের জায়গায় লেখা হয়েছে হরিশচন্দ্র মিত্রের নাম। এখন প্রশ্ন উঠেছে- কবিতাটির আসল কবি কে?</p> <p> 'বড় কে?' কবিতাটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ানো হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। এত দিন তৃতীয় শ্রেণির বাংলা পাঠ্য বইয়ের ৯৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ছিল কবিতাটি। এবার ছাপা হয়েছে ৯০ নম্বর পৃষ্ঠায়। আর এবার শুধু কবির নামই বদলায়নি, কবিতার চারটি লাইনও বাদ দেওয়া দেওয়া হয়েছে। আগে ছিল ১৬ লাইন, এখন রাখা হয়েছে ১২ লাইন। কয়েকটি শব্দের বানানও বদলে দেওয়া হয়েছে। আবার 'হরিশচন্দ্র মিত্রের' নামের বানান লেখা হয়েছে 'হরিশ্চন্দ্র মিত্র'।</p> <p> জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রকাশিত প্রাথমিকের বই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে গত ১ জানুয়ারি। আগে 'বড় কে?' কবিতাটিতে লেখা ছিল 'আপনাকে বড় বলে,/বড় সেই নয়'। এবারের সংস্করণে সংযোজন করা হয়েছে 'আপনারে বড় বলে, বড় সে নয়'। আর 'হিতাহিত না জানিয়া/মরে অহংকারে,/নিজে বড় হতে চায়/ছোট বলি তারে।' এ চার লাইন বাদ দেওয়া হয়েছে।</p> <p> তবে কেন হঠাৎ কবির নাম পরিবর্তন হলো? কবিতাটির আসল কবি কে? এ বিষয়ে পাঠ্য বইয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হয় রংপুর বেগম রোকেয়া কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক শাহ আলমের সঙ্গে। মো. আব্দুল হাই সম্পাদিত 'গীতি কবিতা সংগ্রহগ্রন্থ' উদ্ধৃত করে তিনি জানান, কবিতাটির আসল কবি হরিশচন্দ্র মিত্র। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার সহকারী অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ ও লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের তুষভাণ্ডার মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক আব্দুর রাজ্জাকও দাবি করেন, কবিতাটি হরিশচন্দ্র মিত্রেরই লেখা। অধ্যাপক শাহ আলম জানান, মো. আব্দুল হাই সম্পাদিত গ্রন্থে বাদ দেওয়া চারটি লাইন আছে। সেখানেও লেখা আছে 'আপনাকে' ও 'সেই'।</p> <p> ড. তুহিন ওয়াদুদ কালের কণ্ঠের কাছে দাবি করেন, "প্রজন্মের পর প্রজন্মকে এভাবে ভুল শেখানো হয়েছে। ভুল যেকোনো সময়ই সংশোধন করা যায়, তবে সে ক্ষেত্রে বর্তমান বইটিতে সংশোধনীর বিষয়ে কিছু উল্লেখ করতে হতো। আর চারটি লাইন বাদ দেওয়া ঠিক হয়নি, 'সেই'ও কোনোভাবে 'সে' হতে পারে না।"</p> <p> তবে কত দিন ধরে কবিতাটি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নামে চলেছে এর সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে কালীগঞ্জের প্রবীণ শিক্ষক ও ভাষাসৈনিক মহেন্দ্র নাথ রায় জানান, তিনি ১৯৪২-৪৩ সালের দিকে প্রাথমিকে 'বড় কে?' কবিতাটি পড়েছিলেন। গত মঙ্গলবার রাতে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার যত দূর মনে পড়ে কবিতাটির কবি হিসেবে ইশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নামই পড়ে এসেছি।' আবার হাতীবান্ধা মহিলা ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক আবু সাঈদও বলেন, "আমিও ছোটবেলায় প্রাথমিকে 'বড় কে?' কবিতা পড়েছি। সেখানে কবি হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নামই ছিল।"</p> <p> ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর দের সঙ্গে গতকাল বুধবার যোগাযোগ করা হলে তিনিও কালের কণ্ঠকে বলেন, "ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নয়, 'বড় কে?' কবিতাটি হরিশচন্দ্র মিত্রের। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এত দিন যদি কবিতাটি ঈশ্বরচন্দ্রের নামে ছাপা হয়ে থাকে তবে সেটা অবশ্যই ভুল হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যুগ যুগ ধরে ভুল পড়েছে।'</p> <p> জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল কাশেম মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, '২০১৫ শিক্ষাবর্ষের বইয়ে যা ছাপা হয়েছে সেটিই ঠিক। এত দিন কবিতাটির কবির নাম ভুল ছাপা হয়েছে। আমাদের বইয়ে অনেক ভুলভ্রান্তি ছিল, যা অনেকটাই এবার ঠিক করা হয়েছে।' চার লাইন বাদ দেওয়া এবং শব্দ পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, 'শিশুপাঠ্য করে কবিতাগুলো ছাপানো হয়। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে কবিতার আকার কিছুটা কমানোর অধিকার সম্পাদকদের আছে। হয়তো সেটাই করা হয়েছে।'</p> <p> হরিশচন্দ্র মিত্রের বিষয়ে বাংলাপিডিয়ায় তথ্য সংযোজন করেছেন লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। গতকাল যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'এই (বড় কে?) কবিতাটি হরিশচন্দ্র মিত্রের। এত দিন আমরা ভুল পড়েছি। হরিশচন্দ্র অবহেলিত ছিলেন। তাঁকে নিয়ে কেউ কাজ করেনি। আমিই তাঁকে তুলে ধরেছি। তাঁকে নিয়ে লিখেছি। তার পরই পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চোখে এই ভুলটি ধরা পড়ে এবং তারা তা সংশোধন করে।'</p> <p> বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, কবি, নাট্যকার, প্রবন্ধকার ও সাংবাদিক হরিশচন্দ্র মিত্র ১৮৩৭ সালে ঢাকার এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেন। ১৮৫৮ সালে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায়। ১৮৬০ সালে হরিশচন্দ্র ঢাকার প্রথম সংবাদপত্র মাসিক 'কবিতা কুসুমাবলী' প্রকাশ করেন। ১৮৬৩ সালে তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা 'ঢাকা দর্পণ' প্রকাশ করেন। ১৮৭২ সালের ৪ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু হয়।</p> <p>  </p> <p>  </p>