ঢাকা, শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫
১০ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫
১০ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ মহররম ১৪৪৭

নভেরার মৃত্যুশিল্প

ইমতিয়ার শামীম
ইমতিয়ার শামীম
শেয়ার
নভেরার মৃত্যুশিল্প

রূপকথাই হয়ে রইলেন তিনি; বিশ্বায়ন প্রযোজিত 'ফ্রাঙ্কেন ফুডের ফিকশন, জি ই খাদ্যের পোয়েট্রি কিংবা গোল্ডেন রাইসের মুভি' কোনোটাই দূর করতে পারল না আমাদের নভেরা আহমেদকে জানার ক্ষুধাকে। বরং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি যেন খুলে দিলেন রূপকথার বহু সংস্করণের পথ। প্রতিষ্ঠান ছায়া দেয়নি তাঁকে, তিনি উদ্ভাসিত তাঁর শিল্পের শক্তিমত্তাতে, তাঁর প্রতি সাধারণ শিল্পানুরাগীদের ভালোবাসাতে। অবাকই লাগে, ষাটের দশকে পূর্ববাংলার উল্লেখযোগ্য প্রগতিশীল বাংলা পত্রিকা সমকালে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা বিভিন্ন সময় আলোচিত হলেও নভেরা সেখানে অনুক্ত ছিলেন, এমনকি শিল্পীদের দীর্ঘ বা নাতিদীর্ঘ কোনো তালিকায়ও কখনো তাঁর নাম আসেনি।

যেন শিল্পী নভেরার জন্ম হয়েছে নিঃশব্দে অথবা যেন জন্ম না নিয়েই শিল্পী নভেরা ক্রমাগত মৃত্যুশিল্প তৈরি করে চলেছেন, যেন ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে প্রথম মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়নি, আর হলেও সেটার মধ্যমণি নভেরা আহমেদ নন; যেন ১৯৬০ সালে ঢাকায় পাকিস্তানের প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়নি, কিংবা হলেও যেন ওই প্রদর্শনীর শিল্পী নভেরা আহমেদ নন; যেন শহীদ মিনারের নকশার রূপকার ছিলেন না তিনি এবং ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের সুবাদে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন না ওই নির্মাণযজ্ঞের সঙ্গে। পরে আমরা একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেছি বটে; কিন্তু নভেরার নকশাকে কাটাছেঁড়া করে, উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে, সর্বোচ্চ স্তম্ভের স্টেইন গ্লাস ও ছোট ছোট স্তম্ভের ভাস্কর্যগুলো বিয়োগ করে।

দুই ভাবে অথবা অনেক ভাবেই দণ্ডিত হতে হয়েছে নভেরাকে প্রাতিষ্ঠানিকতার হাতে। কেননা একদিকে তিনি ভাস্কর্য চর্চা করতেন, অন্যদিকে তিনি নারী ছিলেন।

বাঙালি মুসলমান শিল্পকলার খাতায় নাম লেখালেও কুণ্ঠিত ছিল ভাস্কর্যচর্চায়, 'মূর্তি নির্মাণের' মতো পাপগন্ধী শিল্প হয়ে ভাস্কর্য দ্বিধান্বিত করে রেখেছে শিল্পীদের। ভাস্কর্যচর্চার এই করুণ অবস্থা দেখে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় মওলানা আকরম খাঁ কয়েকটি পর্বে 'ভাস্কর্য ও এছলাম' শিরোনামের একটি প্রবন্ধ লেখেন, চেষ্টা করেন ধর্মের আলোকে বাঙালি মুসলমানদের ভাস্কর্যচর্চায় আশ্বস্ত ও উদ্বুদ্ধ করতে। কিন্তু ওই প্রবন্ধ মূর্তিচর্চার গ্লানি থেকে মুক্ত করতে পারেনি তাদের। দেশ বিভাগের পর চারুকলা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, এমনকি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শিল্পীদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ইউরোপীয় শিল্পধারার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসেন; তার পরও প্রায় এক দশক পর্যন্ত সে প্রতিষ্ঠানে শিল্পমাধ্যম হিসেবে ভাস্কর্য স্থান পায়নি।
চারুকলা প্রতিষ্ঠানে ভাস্কর্য যুক্ত হয় ১৯৬৩ সালে। তবে সেখানেও শিল্পী নভেরাকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। যদিও নভেরারও আগ্রহ ছিল, যেমনটা আমরা জানতে পারি শিল্পী আমিনুল ইসলামের ভাষ্য থেকে, '...শুনেছি আর্ট কলেজে স্কাল্পচার ডিপার্টমেন্ট খুলে সেখানে পড়াতে চেয়েছিলেন। তাঁর চালচলনে ভয় পেয়ে আবেদিন স্যারও সাহস পাননি। তা ছাড়া পোস্ট ক্রিয়েট করা, বাজেট বরাদ্দ-এসব ব্যুরোক্রেটিক জটিলতা তো ছিলই।
' বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলা চর্চার ইতিহাস যুগপৎ চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিকতার ইতিহাস, কেবল আধুনিক ভাস্কর্য চর্চাই এর ব্যতিক্রম। এর শুরু ও বিকাশ অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে, নভেরা আহমেদের হাত ধরে। তিনিই পথিকৃৎ বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পের। তাঁর অংশগ্রহণে ও উদ্যোগেই প্রথম মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয় পাকিস্তানে, প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনীও তাঁর, এমনকি ১৯৬১ সালে যখন কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের (ওই সময় পাকিস্তানের আর্টস কাউন্সিলের সেক্রেটারি) আমন্ত্রণে তিনি লাহোর গেলেন, 'ন্যাশনাল এঙ্িিবশন অব পেইন্টিং, স্কাল্পচার অ্যান্ড গ্রাফিক আর্টসে' অংশ নিলেন, রাষ্ট্রপতির প্রথম পুরস্কারটিও পেলেন তার 'চাইল্ড ফিলোসফার' শিল্পকর্মটির জন্য। অনেক পরে এ সম্পর্কে আমরা লেখক হাসনাত আবদুল হাইয়ের কাছে শিল্পী মুর্তজা বশীরকে এই পুরস্কারপ্রাপ্তি সম্পর্কে বলতে শুনেছি, 'খুব সেনসেশন ক্রিয়েট করেছিল। পাকিস্তানে তখন ভাস্কর্য তেমন পরিচিত ছিল না; বরং এক ধরনের নীরব নিষেধাজ্ঞা ছিল। নভেরা ব্রেক থ্রু করল। শ্রেষ্ঠ পুরস্কার শুধু তার জন্য নয়, শিল্পকর্ম হিসেবে ভাস্কর্যেরও প্রথম স্বীকৃতি।' এ প্রদর্শনীর ব্রোশিওরে নভেরার বিভিন্ন ভাস্কর্য সম্পর্কিত আলোচনার শুরুতেই শিল্পানুরাগী আমেরিকান ফ্রেন্ড অব দ্য মিডল ইস্টের পরিচালক ডি এস ওয়াটসন মন্তব্য করেন, 'নো ডিসকাশন অব পাকিস্তান আর্ট উড বি কমপ্লিট উইদাউট রেফারেন্স টু হার।' কিন্তু সেই নভেরা আহমেদের চারুকলা প্রতিষ্ঠানে স্থান হলো না। একবিন্দু শিশির অবশ্য পেয়েছিলেন তিনি জয়নুল আবেদিনের কাছ থেকে, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দেয়ালে নির্মাণ করেছিলেন ফ্রিজ বা ম্যুরাল; জানান দিয়েছিলেন তার গন্তব্য-লোকজ ফর্মকে নগরমনস্কতা দিয়ে উপস্থাপন করার ও ক্রাফটম্যানশিপ থেকে লোকশিল্পকে মুক্ত করার এক দর্শন। গ্রামীণতাকে ধারণ করেন তিনি তার প্রথম ম্যুরালে, তবে গ্রাম্যতা থেকে মুক্ত করে।

নভেরার ভাস্কর্য দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে একদিকে হেনরি মুর, অন্যদিকে পিকাসো-ব্রাঙ্কুসি-এপস্টাইনের চিন্তাধারা। ফলে তাঁর শিল্পকর্ম পেয়েছে একদিকে পাশ্চাত্য-ভাস্কর্যের মসৃণতা অন্যদিকে প্রিমিটিভ আর্টের সরলতা, একদিকে ঘটেছে আধুনিক শিল্পকলার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার অন্যদিকে প্রাচীন শিল্পকলার বুনো-বোবা গতি। এই বৈপরীত্যকে তিনি সমন্বিত করেছেন তাঁর সংবেদনশীলতা দিয়ে। ফলে ত্রিমাত্রিকতা ধরা পড়েছে নতুনভাবে। আধুনিকতার সঙ্গে তিনি তুলে ধরেছেন লোকজ বিষয় ও ফর্মকে, এভাবে নিজেকে শনাক্ত ও উপস্থাপন করেছেন আলাদাভাবে।

ষাটের দশকের শেষদিকে নভেরা আহমেদ ঢাকা ছাড়েন, ক্রমেই বাংলাদেশের শিল্পীদের কাছে মৃত হয়ে পড়তে থাকেন, শিল্প আলোচনায় পাকিস্তানপর্বের মতোই উহ্য থাকেন, ঠিকাদারদের খাদ্যে পরিণত হয় তাঁর পরিকল্পিত শহীদ মিনার, রূপকার হিসেবে তাঁর নাম ছেঁটে ফেলা হয়; কিন্তু রাজধানী ঢাকার আলো-আঁধারিতে অযত্নে-অবহেলায় বিভিন্ন উন্মুক্ত স্থানে নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যগুলো পড়ে থাকতে থাকতে আমাদের জীবন যাপনের অংশ হয়ে ওঠে। প্রথম একক প্রদর্শনী হওয়ার আগেই এক পশ্চিমা ক্রিটিক তাঁর সৃষ্টিকর্মের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে খুঁজে পেয়েছিলেন 'অরগানিক ক্যারেক্টার'কে, তাঁর ভাস্কর্য তাই পরিণত হয় আমাদের উন্মুক্ত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে। আর তিনি নিজেও তাই চেয়েছিলেন। এক সাংবাদিকের কাছে প্রথম প্রদর্শনীর আগে বলেছিলেন, নগর পরিকল্পনায় প্রতিটি স্থাপনার উপযুক্ত পরিসরে ভাস্করদের ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন জড়িয়ে পড়ে শিল্পকর্মের প্রত্যক্ষ ও ইতিবাচক প্রভাবের সঙ্গে। তিনি চেয়েছিলেন নতুন নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে পৃথিবীর মহীয়ান নগরগুলোর পরিকল্পনা ও উদ্দীপনার কাছে ফিরে যেতে। তিনি বলেছিলেন, শিল্পীদের কর্তব্য হলো মানুষের জীবনের সত্য, অর্থ ও অন্তর্দৃষ্টির প্রতি কৌতূহলের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া এবং কেবল তখনই তা সম্ভব হতে পারে যখন নগরজীবনের পরিধিতে শিল্পের জায়গা করে দেওয়া যাবে।

নভেরার সৃজন শিল্পকে ঘিরে অবতার যে পর্দা উঠেছিল, ১৯৯৪ সালে সে পর্দা তুলে ফেলেন হাসনাত আবদুল হাই সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় 'নভেরা' লিখে। নভেরা প্রত্যাবর্তন করেন নতুন প্রজন্মের আইকন হয়ে, পুনর্জন্ম ঘটে তাঁর ভাস্কর্যের। ওই বছরেরই ১০ নভেম্বরে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে মেহবুব আহমেদ লেখেন 'ভাস্কর নভেরা আহমেদ'। আর রাষ্ট্রযন্ত্রও যেন নিভৃতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠান চেয়েছিল নভেরাকে মৃত বানাতে, কিন্তু তাদের সে আকাঙ্ক্ষারই মৃত্যু ঘটে ১৯৯৭ সালে নভেরা আহমেদকে একুশে পদকে ভূষিত করা হলে। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ১৯৯৭ সালের ১৭ অক্টোবরে (বর্ষ ২৯, সংখ্যা ২২) প্যারিসের বাংলাদেশ মিশনে কাউন্সিলর হিসেবে কর্মরত লেখক ইকতিয়ার চৌধুরী 'নভেরার ঠিকানা : প্যারিস' নিবন্ধটি লেখার পর তাঁর অবস্থানও নিশ্চিত হয় সবার কাছে।

নভেরার শিল্প অন্বেষণ তাঁর রহস্যময়তারও স্রষ্টা। নদীর তীরে তীরে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন তিনি, ঘুরেছেন মাজারের পর মাজারে, হৃদয়-মনন-সৃজন দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেছেন বৌদ্ধদর্শন ও বৌদ্ধশিল্পকে, সমসাময়িক শিল্পী ও শিল্পানুরাগীদের শিল্পভাবনাকে। আর এই পরিভ্রমণের মধ্যে দিয়ে জন্ম দিয়েছেন রহস্যময়তারও-যা তুঙ্গে ওঠে তাঁর স্বেচ্ছানির্বাসনের ফলে। প্যারিসে ২০১৪ সালের শুরুর দিকে তাঁর সর্বশেষ ও রেট্রোসপেকটিভ প্রদর্শনীর বিভিন্ন আলোকচিত্র থেকে স্পষ্ট, সৃজনশীল থাকলেও তাঁর শিল্পচর্চা নতুন কোনো মাত্রা পায়নি আর। সেটি বোধ হয় সম্ভবও ছিল না তিনি গুরুতর দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায়। এসব অপূর্ণতা থাকার পরও নভেরাই আমাদের ভাস্কর্য শিল্পের পথিৃকৎ, ভাস্কর্যে অ্যাবস্ট্রাকশনের জনক, প্রতিবেশ উপযোগী উপকরণ ব্যবহারের সূত্রধর এবং পরিণত সংবেদনশীলতা ও শিল্পভাবনাসম্পৃক্ত ভাস্কর। বৈপরীত্য-কী শিল্পচিন্তার, কী জীবন যাপনের-শিল্প অন্বেষণের অমোঘ প্রকাশ। নিজেকে ঘিরে তিনি যে রহস্যময়তা সৃষ্টি করে গেছেন, তা সেই অন্বেষণেরই প্রকাশ। যদিও তার মধ্যে দিয়ে তিনি ক্রমেই রূপকথা হয়ে উঠেছেন, রূপকথার অসংখ্য সংস্করণ তৈরির ঝুঁকি তৈরি করেছেন, কিন্তু তার মৃত্যুকে পরিণত করেছেন শিল্পে।

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ