রূপকথাই হয়ে রইলেন তিনি; বিশ্বায়ন প্রযোজিত 'ফ্রাঙ্কেন ফুডের ফিকশন, জি ই খাদ্যের পোয়েট্রি কিংবা গোল্ডেন রাইসের মুভি' কোনোটাই দূর করতে পারল না আমাদের নভেরা আহমেদকে জানার ক্ষুধাকে। বরং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি যেন খুলে দিলেন রূপকথার বহু সংস্করণের পথ। প্রতিষ্ঠান ছায়া দেয়নি তাঁকে, তিনি উদ্ভাসিত তাঁর শিল্পের শক্তিমত্তাতে, তাঁর প্রতি সাধারণ শিল্পানুরাগীদের ভালোবাসাতে। অবাকই লাগে, ষাটের দশকে পূর্ববাংলার উল্লেখযোগ্য প্রগতিশীল বাংলা পত্রিকা সমকালে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা বিভিন্ন সময় আলোচিত হলেও নভেরা সেখানে অনুক্ত ছিলেন, এমনকি শিল্পীদের দীর্ঘ বা নাতিদীর্ঘ কোনো তালিকায়ও কখনো তাঁর নাম আসেনি।
নভেরার মৃত্যুশিল্প
ইমতিয়ার শামীম

দুই ভাবে অথবা অনেক ভাবেই দণ্ডিত হতে হয়েছে নভেরাকে প্রাতিষ্ঠানিকতার হাতে। কেননা একদিকে তিনি ভাস্কর্য চর্চা করতেন, অন্যদিকে তিনি নারী ছিলেন।
নভেরার ভাস্কর্য দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে একদিকে হেনরি মুর, অন্যদিকে পিকাসো-ব্রাঙ্কুসি-এপস্টাইনের চিন্তাধারা। ফলে তাঁর শিল্পকর্ম পেয়েছে একদিকে পাশ্চাত্য-ভাস্কর্যের মসৃণতা অন্যদিকে প্রিমিটিভ আর্টের সরলতা, একদিকে ঘটেছে আধুনিক শিল্পকলার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার অন্যদিকে প্রাচীন শিল্পকলার বুনো-বোবা গতি। এই বৈপরীত্যকে তিনি সমন্বিত করেছেন তাঁর সংবেদনশীলতা দিয়ে। ফলে ত্রিমাত্রিকতা ধরা পড়েছে নতুনভাবে। আধুনিকতার সঙ্গে তিনি তুলে ধরেছেন লোকজ বিষয় ও ফর্মকে, এভাবে নিজেকে শনাক্ত ও উপস্থাপন করেছেন আলাদাভাবে।
ষাটের দশকের শেষদিকে নভেরা আহমেদ ঢাকা ছাড়েন, ক্রমেই বাংলাদেশের শিল্পীদের কাছে মৃত হয়ে পড়তে থাকেন, শিল্প আলোচনায় পাকিস্তানপর্বের মতোই উহ্য থাকেন, ঠিকাদারদের খাদ্যে পরিণত হয় তাঁর পরিকল্পিত শহীদ মিনার, রূপকার হিসেবে তাঁর নাম ছেঁটে ফেলা হয়; কিন্তু রাজধানী ঢাকার আলো-আঁধারিতে অযত্নে-অবহেলায় বিভিন্ন উন্মুক্ত স্থানে নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যগুলো পড়ে থাকতে থাকতে আমাদের জীবন যাপনের অংশ হয়ে ওঠে। প্রথম একক প্রদর্শনী হওয়ার আগেই এক পশ্চিমা ক্রিটিক তাঁর সৃষ্টিকর্মের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে খুঁজে পেয়েছিলেন 'অরগানিক ক্যারেক্টার'কে, তাঁর ভাস্কর্য তাই পরিণত হয় আমাদের উন্মুক্ত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে। আর তিনি নিজেও তাই চেয়েছিলেন। এক সাংবাদিকের কাছে প্রথম প্রদর্শনীর আগে বলেছিলেন, নগর পরিকল্পনায় প্রতিটি স্থাপনার উপযুক্ত পরিসরে ভাস্করদের ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন জড়িয়ে পড়ে শিল্পকর্মের প্রত্যক্ষ ও ইতিবাচক প্রভাবের সঙ্গে। তিনি চেয়েছিলেন নতুন নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে পৃথিবীর মহীয়ান নগরগুলোর পরিকল্পনা ও উদ্দীপনার কাছে ফিরে যেতে। তিনি বলেছিলেন, শিল্পীদের কর্তব্য হলো মানুষের জীবনের সত্য, অর্থ ও অন্তর্দৃষ্টির প্রতি কৌতূহলের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া এবং কেবল তখনই তা সম্ভব হতে পারে যখন নগরজীবনের পরিধিতে শিল্পের জায়গা করে দেওয়া যাবে।
নভেরার সৃজন শিল্পকে ঘিরে অবতার যে পর্দা উঠেছিল, ১৯৯৪ সালে সে পর্দা তুলে ফেলেন হাসনাত আবদুল হাই সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় 'নভেরা' লিখে। নভেরা প্রত্যাবর্তন করেন নতুন প্রজন্মের আইকন হয়ে, পুনর্জন্ম ঘটে তাঁর ভাস্কর্যের। ওই বছরেরই ১০ নভেম্বরে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে মেহবুব আহমেদ লেখেন 'ভাস্কর নভেরা আহমেদ'। আর রাষ্ট্রযন্ত্রও যেন নিভৃতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠান চেয়েছিল নভেরাকে মৃত বানাতে, কিন্তু তাদের সে আকাঙ্ক্ষারই মৃত্যু ঘটে ১৯৯৭ সালে নভেরা আহমেদকে একুশে পদকে ভূষিত করা হলে। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ১৯৯৭ সালের ১৭ অক্টোবরে (বর্ষ ২৯, সংখ্যা ২২) প্যারিসের বাংলাদেশ মিশনে কাউন্সিলর হিসেবে কর্মরত লেখক ইকতিয়ার চৌধুরী 'নভেরার ঠিকানা : প্যারিস' নিবন্ধটি লেখার পর তাঁর অবস্থানও নিশ্চিত হয় সবার কাছে।
নভেরার শিল্প অন্বেষণ তাঁর রহস্যময়তারও স্রষ্টা। নদীর তীরে তীরে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন তিনি, ঘুরেছেন মাজারের পর মাজারে, হৃদয়-মনন-সৃজন দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেছেন বৌদ্ধদর্শন ও বৌদ্ধশিল্পকে, সমসাময়িক শিল্পী ও শিল্পানুরাগীদের শিল্পভাবনাকে। আর এই পরিভ্রমণের মধ্যে দিয়ে জন্ম দিয়েছেন রহস্যময়তারও-যা তুঙ্গে ওঠে তাঁর স্বেচ্ছানির্বাসনের ফলে। প্যারিসে ২০১৪ সালের শুরুর দিকে তাঁর সর্বশেষ ও রেট্রোসপেকটিভ প্রদর্শনীর বিভিন্ন আলোকচিত্র থেকে স্পষ্ট, সৃজনশীল থাকলেও তাঁর শিল্পচর্চা নতুন কোনো মাত্রা পায়নি আর। সেটি বোধ হয় সম্ভবও ছিল না তিনি গুরুতর দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায়। এসব অপূর্ণতা থাকার পরও নভেরাই আমাদের ভাস্কর্য শিল্পের পথিৃকৎ, ভাস্কর্যে অ্যাবস্ট্রাকশনের জনক, প্রতিবেশ উপযোগী উপকরণ ব্যবহারের সূত্রধর এবং পরিণত সংবেদনশীলতা ও শিল্পভাবনাসম্পৃক্ত ভাস্কর। বৈপরীত্য-কী শিল্পচিন্তার, কী জীবন যাপনের-শিল্প অন্বেষণের অমোঘ প্রকাশ। নিজেকে ঘিরে তিনি যে রহস্যময়তা সৃষ্টি করে গেছেন, তা সেই অন্বেষণেরই প্রকাশ। যদিও তার মধ্যে দিয়ে তিনি ক্রমেই রূপকথা হয়ে উঠেছেন, রূপকথার অসংখ্য সংস্করণ তৈরির ঝুঁকি তৈরি করেছেন, কিন্তু তার মৃত্যুকে পরিণত করেছেন শিল্পে।
সম্পর্কিত খবর