ঢাকা, শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫
১০ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫
১০ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ মহররম ১৪৪৭

ডাকি শহীদ মিনার বলে

  • পৃথিবীর প্রথম জাতি হিসেবে ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন বাংলার রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকে। তাঁদের স্মরণে দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয়েছে মিনার-স্থাপত্য। তার কয়েকটি নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের নির্মাণ
খান মিজান
খান মিজান
শেয়ার
ডাকি শহীদ মিনার বলে
ছবি : শেখ হাসান

মেডিক্যাল কলেজ সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ছিল  ইট, বালি। পুরান ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদামে ছিল সিমেন্ট। সেখান থেকে উপকরণগুলো আনতে হবে। শিক্ষার্থীরা লম্বা পিঁপড়ার সারি তৈরি করে।

তারপর হাতে হাতে সেসব উপকরণ এনে জড়ো করে। কাজ তদারকিতে ছিলেন জিএস শরফুদ্দিন (ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিন নামে পরিচিত)। নকশা করলেন বদরুল আলম, সঙ্গে সাঈদ হায়দার। তাঁদের সহযোগিতায় দুজন রাজমিস্ত্রি।

১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। শেষ বিকেল তখন। স্মৃতিস্তম্ভটি রাতের মধ্যে শেষ করতে হবে। ১০ ফুট উঁচু আর ছয় ফুট চওড়া মিনারটির নির্মাণ রাতের মধ্যে ঠিকই শেষ হলো।

মেডিক্যালের ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাক) ১২ নম্বর শেডের পূর্ব প্রান্তে। কোনাকুনিভাবে হোস্টেলের মধ্যবর্তী সড়কের গা ঘেঁষে ছিল শহীদ মিনারটি।

২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে শহীদ মিনারটি  উদ্বোধন করেন আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। ওই দিনই পুলিশ ও সেনাবাহিনী মেডিক্যালের ছাত্র হোস্টেল ঘিরে ফেলে; ভেঙে ফেলে প্রথম শহীদ মিনার।

১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল ক্ষমতায় এলো যুক্তফ্রন্ট সরকার।

৯ মের অধিবেশনে ২১ দফার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শহীদ মিনার তৈরি, একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষিত হয়। কিন্তু ওই বছর ৩০ মে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় তা আইনসিদ্ধ করা সম্ভব হয়নি।

১৯৫৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন পূর্ববঙ্গ সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও ভাষাশহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম। ওই সময়ই একুশে ফেব্রুয়ারিকে আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।

১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ আবার শুরু হলো। নকশা করলেন ভাস্কর হামিদুর রাহমান। শিল্পীর পরিকল্পনা ছিল অনেকখানি জায়গা নিয়ে। বেশ বড় আয়তনের শহীদ মিনার কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। সে অনুযায়ী নকশায় মিনারের মূল অংশে ছিল মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে মা ও তাঁর শহীদ সন্তানের প্রতীক হিসেবে অর্ধবৃত্তাকার স্তম্ভ। স্তম্ভের গায়ে হলুদ ও গাঢ় নীল কাচের অসংখ্য চোখের প্রতীক খোদাই করে বসানোর কথা ছিল, যেগুলো থেকে প্রতিফলিত সূর্যের আলো মিনার চত্বরে সৃষ্টি করবে বর্ণালির ছটা।

এ ছাড়া মিনার-স্থাপত্যের সামনে বাংলা বর্ণমালায় গাঁথা একটি পূর্ণাঙ্গ রেলিং তৈরি আর মিনার চত্বরে দুই বিপরীত শক্তির প্রতীক হিসেবে রক্তমাখা ও কালো রঙের পায়ের ছাপ আঁকাও ছিল পরিকল্পনার অংশ। পাশে তৈরি হওয়ার কথা ছিল জাদুঘর, পাঠাগার আর সংগ্রামবিষয়ক দীর্ঘ দেয়ালচিত্র। আশপাশের জায়গা নিয়ে চোখের আকৃতিবিশিষ্ট ঝরনা নির্মাণের পরিকল্পনাও ছিল, যার প্রান্তে থাকবে ঢেউ-খেলানো উঁচু বেদি।

পরিকল্পনা ও নকশা নিয়ে ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে কাজ শুরু হয়। হামিদুর রাহমানের সহকর্মী হিসেবে ছিলেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। এ সময় মিনারের ভিত, মঞ্চ ও কয়েকটি স্তম্ভ তৈরির কাজ শেষ হয়। সেই সঙ্গে রেলিং, পায়ের ছাপ, ম্যুরালের কিছু কাজ। নভেরার তিনটি ভাস্কর্যের কাজও সম্পন্ন হয়। এর ভেতর সামরিক আইন জারি হয় ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে। বন্ধ হয়ে যায় শহীদ মিনার নির্মাণকাজ। তবু ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত চার বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে মানুষ এই অসম্পূর্ণ শহীদ মিনারেই ফুল দিয়েছে, সভা করেছে ও শপথ নিয়েছে।

১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আজম খানের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী মূল নকশা বহুলাংশে পরিবর্তন করা হয়। পরিকল্পিত স্থাপত্যের বিস্তর অঙ্গহানি ঘটিয়ে একটি নকশা দাঁড় করানো হয়। ওই নকশা অনুযায়ী দ্রুত শহীদ মিনারের কাজ শেষ করা হয়। ১৯৬৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মিনার উদ্বোধন করেন শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম। সেই সংক্ষিপ্ত ও খণ্ডিত শহীদ মিনারই একুশের চেতনার প্রতীকরূপে মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী মিনারটি আবার ভেঙে দেয়। সেখানে ‘মসজিদ’ কথাটি লিখে রাখা হয়। কিন্তু এ দেশের মানুষ তা গ্রহণ করেনি।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে শহীদ মিনার নতুন করে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবারও মূল নকশা পরিহার করে ১৯৬৩ সালের সংক্ষিপ্ত নকশার ভিত্তিতেই দ্রুত কাজ শেষ করা হয়। ১৯৭৬ সালে নতুন নকশা অনুমোদিত হলেও আর বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৮৩ সালে মিনার চত্বরের কিছুটা বিস্তার ঘটিয়ে শহীদ মিনারটিকে বর্তমান অবস্থায় আনা হয়। স্থাপত্য-ভাস্কর্যগত অসম্পূর্ণতা নিয়েই সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে দণ্ডায়মান বর্তমানের শহীদ মিনার।

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ