<p>পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতের আম এবং ফলফলাদির সুখ্যাতি দেশজুড়ে। অথচ ফলের বিবর্ণ রং, পোকার আক্রমণ আর আকারের হেরফেরের কারণে এখানকার ফলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা আশানুরূপ বাড়ছে না। তবে আশার কথা, পাহাড়ি অঞ্চলের ফলে আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ‘পোশাক’ পরিয়ে ফলকে পোকার আক্রমণ ও কীটনাশক থেকে রক্ষা এবং দাগহীন করার কাজ শুরু হয়েছে। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ) মূলত পাহাড়ি আমচাষি ও ফল ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাজারজাতের সমন্বয় এবং কৃষিপণ্য বিক্রয়-বিপণন কেন্দ্র খোলায় উদ্বুদ্ধ করতে এ উদ্যোগ নিয়েছে। ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে চলতি বছর এ প্রথম গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়েছে পাহাড়ে। লিখেছেন : আবু দাউদ, খাগড়াছড়ি</p> <p> </p> <p>খাগড়াছড়ি জেলা সদরের তেঁতুলতলা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম গোয়ামাহাট। সেখানে গিয়ে থোকায় থোকায় আমের প্যাকেট ঝুলতে দেখা যায়। আসলে এগুলো সাধারণ কোনো ব্যাগ নয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত ‘ব্যাগ বিশেষ।’ যেটি ‘ফ্রুট ব্যাগ’ নামেই বেশি পরিচিত। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পর পাহাড়ে এবারই প্রথম কৃষকের বাগানে ফ্রুট ব্যাগ বা ফলে পোশাক পরানো হলো। কেবল গোয়ামাহাট নয়, জেলা সদরের রোয়াসাংপাড়া, তেঁতুলতলা, কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের আশপাশ এলাকায় একই চিত্র দেখা গেছে। জানা গেছে, এবার অপর দুই পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও বান্দরবানের পাহাড়ি গ্রামেও ‘ফ্রুট ব্যাগ’ ব্যবস্থায় বিভিন্ন ফলমূল আবৃত করা হয়। </p> <p>কৃষি বিজ্ঞানীরা জানালেন, মূলত সূর্যের আলো বা সান বার্ন ও পোকার আক্রমণ থেকে সুরক্ষা করতে এই ব্যবস্থা। এতে ফলের গায়ে কালো কালো দাগও লাগতে পারে না। আমের জাত ভেদে ৪৫ দিন থেকে ৬৫ দিনের মধ্যেই বিশেষ প্রযুক্তির ব্যাগটি পরাতে হয়। খাগড়াছড়ির বিভিন্ন জাতের জনপ্রিয় ‘আম’-এ এবার স্থানীয় কৃষক সেই পোশাক পরিয়েছেন। আমগুলোর মধ্যে রয়েছে বারি আম-৩, বারি আম-৪, বারি আম-৮, মল্লিকা ও আশ্বিনা উল্লেখযোগ্য। বিশেষত বারি আম-৪ এবং বারি আম-৮ বা রাঙ্গুই জাতের আমে সফলতা বেশি পাওয়া গেছে।</p> <p>হাটহাজারী আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্পের অধিকর্তা ড. মো. জামাল উদ্দিন জানিয়েছেন, পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপাদিত আমের উপযুক্ত দাম পাওয়া এবং পোকা ও কীটনাশকমুক্ত নিরাপদ আম বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই কৃষিবিজ্ঞানী বলেন, ‘বাদামি রঙের দুই লেয়ার সমেত এই ব্যাগ বৃষ্টিতে ভিজলেও নষ্ট হয় না। এছাড়া আমের গায়ে আলো-বাতাস চলাচলেও সমস্যা করে না।’</p> <p>খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুন্সি রশিদ আহমদ জানান, কৃষকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এবছর পরীক্ষামূলকভাবে কৃষক পর্যায়ে প্রায় চার হাজার আমে এ ব্যাগ পরানো হয়। বারি আম-৩, বারি আম-৪ ও বারি আম-৮, ফজলি ও আশ্বিনা জাতের গুটির বয়স ঠিক দুই মাস অতিক্রম হওয়ার পর বিশেষ ধরনের ব্যাগটি পরাতে হয়। ফলে আমে কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। অন্যদিকে আম পরিপক্ব হওয়ার অন্তত সাতদিন আগে ব্যাগ খুলে বাজারজাত করা যায়। এতে আম খুবই আকর্ষণীয় হয়। দাগহীন হওয়ার কারণে বাজারে আমের দামও ভালো পাওয়া যায়। বেশিদিন ঘরে রেখে খেলে আমের মিষ্টতাও বাড়ে। তবে ফ্রুট ব্যগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে চাষিদের সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণার কৃষিবিজ্ঞানী মুন্সি রশিদ আহমদ।</p> <p>তিনি জানান, ব্যাগিং একটি কৌশলপূর্ণ পদ্ধতি। ব্যাগিং করা আমে ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক ব্যবহৃত হয় না বলে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকে। সুন্দর ও আকর্ষণীয় হওয়ায় ফলের মূল্যবৃদ্ধিতেও সহায়ক হয়। তবে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে প্রয়োগ না হলে বিপর্যয় হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তিনি পাহাড়ের অম্লভাবাপন্ন মাটিকে যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্যে মাটির বিশেষ পরিচর্যার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। একই সঙ্গে ডলুচুন ও অনুসার এর ঘাটতি পূরণের পরামর্শ দিয়েছেন।</p> <p>গুয়ামাহাট ফল চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডিপুল চাকমা বলেন, ‘পরীক্ষামূলকভাবে আমে ব্যাগিং করে সফলতা পেয়েছি। এই প্রযুক্তিতে উৎপাদন করা আমকে সেরা বলতেও দ্বিধা নেই।’ এবার তিনি মাত্র এক হাজার আমে ব্যাগ পরালেও আগামী বছর সব কটি গাছের আমে পোশাক পরাবেন বলে জানান।</p> <p>একইভাবে এবার দিবাকর চাকমা, যত্নেশ্বর ত্রিপুরা, মংচিংউ মারমা, সুজন, মোস্তফা মিয়াজিসহ আরো বেশ কয়েকজন আমবাগানি তাঁদের আমে ফ্রুট ব্যাগ ব্যবহার করেন। তাঁরা বলেন, এই ব্যবস্থায় উৎপাদিত আমের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। আগামী বছর থেকে বেশি হারে ফ্রুট ব্যাগিং করার পরিকল্পনাও নিয়েছেন অনেক ফলচাষি। পোশাক পরিয়ে নিরাপদ, পোকা ও দাগহীন উজ্জ্বল রঙের আম পেয়ে খুশি হয়েছেন স্থানীয় কৃষক। মোস্তফা মিয়াজি জানালেন, বাজারে এ আমের দাম পাচ্ছেন প্রায় দ্বিগুণ।</p> <p>প্রসঙ্গত, কেবল আম নয়, খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে বেশ কিছু কলার ছড়াতেও ব্যাগ প্রযুক্তিতে সফলতা এসেছে। এছাড়া এবার মাল্টা, লিচুসহ আরো কিছু ফলেও ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।</p>