ঢাকা, বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫
৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫
৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ মহররম ১৪৪৭
সাদাকালো

অনন্য মহাকাশবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং

  • আহমদ রফিক
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
অনন্য মহাকাশবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং

সংবাদপত্রে আলোড়িত সংবাদ : ‘চলে গেলেন হকিং’। একালের সর্বাধিক আলোচিত মহাকাশবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, যাঁকে একাধিক অভিধায় চিহ্নিত করা যায়। অস্তিবাদী, নাস্তিবাদী, গণিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী, সর্বোপরি সব মিলিয়ে একজন অ্যাস্ট্রোফিজিকসের মহাতারকা।

কিন্তু ওই যে ‘চলে গেলেন’—যে কথাটি প্রায়ই লেখা হয় কাগজে, হকিংই মনে হয় এ ব্যাপারে কারো প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতে পারতেন : ‘কোথায় চলে গেলেন?’ ‘রসিক ওই বিজ্ঞানী’র পক্ষে এমনটাই স্বাভাবিক।

তবে তিনিও এ রহস্যের সদুত্তর দিতে পারেননি। কারণ বিষয়টি বড় বেশি গোলমেলে ও তাত্ত্বিক। এর দুটি দিকই সত্য—‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। তাই এই বিষয় নিয়ে বৌদ্ধিক চিন্তাভাবনার যুগ থেকে দার্শনিক ও বিজ্ঞানী, এই দুই দলই এ রহস্যের সমাধান খুঁজেছে।
সে অন্বেষা এখনো শেষ হয়নি।

সেই কবে মধ্যযুগে ইরানি কবি-দার্শনিক বিজ্ঞানী ওমর খৈয়াম এসব প্রশ্ন—কোথা থেকে আসা, কোথায় যাওয়া, ‘মৃত্যু আর ভাগ্যলিখন’ নিয়ে কাব্যচর্চার মাধ্যমে (চতুষ্পদী লিখে) তাঁর সংশয়বাদী চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে যুগস্রষ্টা বিজ্ঞানীদের অনেকের চিন্তায় পরমশক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট মতামত প্রকাশ পায়নি। কারণ উত্তরটা নেতিবাচক হলে পরিণাম মারাত্মক।

কোপার্নিকাস, ব্রুনো, কেপলার, গ্যালিলিও বা নিউটন থেকে আইনস্টাইন, ম্যাক্স প্ল্যাংক হয়ে স্টিফেন হকিং নানাভাব প্রশ্নবিদ্ধ।

একমাত্র শেষোক্তজনেই এ বিষয়ে এবং ‘পূর্বনির্ধারিত’ সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন। সেখানেও তিনি ঘুরেফিরে সংশয়বাদী। তাঁর জটিল তত্ত্বের গভীরে নাক গলানোর সাধ্য আমার নেই। তত্ত্বকে সাধারণের বোধগম্য করতে তাঁর লেখা বইগুলো তাঁর মতামত বোঝার পক্ষে সহায়ক।

তবু কি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পূর্বোক্ত প্রশ্নগুলো সম্পর্কে হকিংয়ের মতামত কি?

‘সবই কি পূর্বনির্ধারিত’—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি যা বলেছেন তা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’র দুই তীর ঘেঁষে যায়। তবে ‘না’র দিকটায় জোর বেশি। তিনি যখন দর্শনের নিয়তিবাদের সমালোচনা করেন এবং বলেন দার্শনিকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তিক্ত, তখন তাঁর ভাবনার কিছুটা হদিস মেলে। কিন্তু গোল বাধে যখন একই সঙ্গে বলেন, মহাবিশ্বের প্রাথমিক নকশা হয়তো ঈশ্বর বেছে নিয়েছিলেন, কিংবা হয়তো সেটাও নির্ধারিত হয়েছিল বিজ্ঞানের বিধিগুলো দিয়ে, তখন ওই দুই ‘হয়তো’ সত্যি আমাদের গভীর সমস্যার গহ্বরে নিক্ষেপ করে।

এবং করে যখন তিনি ‘সব কিছু পূর্বনির্ধারিত’ এই তত্ত্বের সমস্যা নিয়ে ভাবিত হন এবং স্পষ্ট ভাষায়ই বলেন, ‘আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা রয়েছে। আমরা যদি কিছু করব বলে ঠিক করি তাহলে সেটা করার স্বাধীনতা আমাদের রয়েছে।’ তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে যোগ করা যায় এমন কথা যে সে কাজটি করে ফেলার পর পূর্বনির্ধারিত নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।

হকিং মনে করেন, একটি ‘পূর্ণাঙ্গ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব’ বিজ্ঞানেরও অনেক প্রশ্নের উত্তর সরবরাহ করতে পারে। জীবনের উদ্ভব সম্পর্কেও একই ধরনের সংশয় ও অনিশ্চয়তা। ডারউইনের ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’, বিবর্তনবাদ ও মানবপ্রজাতির জন্ম যদি অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে কয়েকটি পরমাণুর স্বতঃস্ফূর্ত মিলনের পরিণাম হয়ে থাকে তাহলে ছোট্ট জটিল দ্বিকুণ্ডলীর ডিএনএ অণুই বা কেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিবর্তনের ধারায় গঠিত হতে পারবে না?

হয়তো এমন কোনো বিবেচনায় হকিং লিখেছেন, আদিম স্তরে ডিএনএর পাকখাওয়া জোড়া কুণ্ডলী হয়তো একটি উন্নতি ছিল। এমন এক বিবেচনা থেকে হকিং মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ নিয়ে অতিসংক্ষেপে কিছু কথা বলেছেন তাঁর ‘কৃষ্ণগহ্বর’ বইটিতে। আরো বলেছেন, ‘সবই পূর্বপরিকল্পিত’ এমন ধারণার ভিত্তিতে কেউ নিজের আচরণ ঠিক করতে পারে না।

তবে এ সম্পর্কে তাঁর চিন্তায় সংশয়বাদের দিকে ঝোঁকটাও সত্যি, যেমনটা বলা হয় ওমর খৈয়ামের নাস্তিবাদ সম্পর্কে। কারণ সব পূর্বনির্ধারিত কি না এ প্রশ্নে ধর্মীয় মতবাদের সহায়তায় নয়, বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিতর্কের শেষে হকিংয়ের মন্তব্যটি দ্ব্যর্থবোধক : ‘সব কিছু কি পূর্বনির্ধারিত’—এ প্রশ্নের জবাবে আমার উত্তর ‘হ্যাঁ’। কিন্তু উত্তরটা ‘না’ হতে পারে, কারণ কী পূর্বনির্ধারিত তা আমরা কোনো দিনও জানতে পারব না।

এ প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। কোনো একটি বইতে পড়েছিলাম এমন তথ্য যে জীববিজ্ঞানীদের তুলনায় পদার্থবিজ্ঞানীরা অধিকমাত্রায় ভাববাদী। এ মন্তব্যের পক্ষে প্রমাণ মেলে জিনস, নিউটন প্রমুখ থেকে আইনস্টাইনের মতো পদার্থবিজ্ঞানীর পরম শক্তিবিষয়ক ভাবনায়। বেশ কিছুদিন আগে সংবাদপত্রের এক মন্তব্যে পড়ি একই বিষয়ে হকিংয়ের বিশ্বাসের কথা। আবার এই কিছুদিন আগে সংবাদপত্রেই মন্তব্য প্রকাশ পেয়েছে যে মহাবিশ্ব সৃষ্টি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। তাঁর কোন বক্তব্যটিকে সঠিক বলে মনে করব? শেষটা কি?

এ সমস্যার বড় কারণ জীববিজ্ঞানীদের আর মহাকাশবিজ্ঞানীদের কর্মক্ষেত্রের পার্থক্য। মহাবিশ্বের অবিশ্বাস্য আয়তন, প্রায় সীমাহীন পরিপ্রেক্ষিত বিজ্ঞানীর যুক্তিতর্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তাই দার্শনিকের ভাববাদ বিজ্ঞানীর চেতনায় প্রভাব বিস্তার করে। তবু মানতে হয়, অগ্রজদের তুলনায় হকিং অনেকটাই বস্তুবাদী।

হয়তো তাই অনেক আগেকার এক সাক্ষাৎকারে তিনি এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হন যে অনেকের মতে তিনি বাস্তব ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে বাদ দিয়েছেন। জবাবে হকিং বলেন, ‘আমার গবেষণার ফল হচ্ছে মহাবিশ্ব কিভাবে শুরু, সেটা ঈশ্বরের ব্যক্তিগত খেয়াল—এ কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার প্রশ্ন, মহাবিশ্ব অস্তিত্বের সমস্যা কেন নিল? আপনার ইচ্ছা হলে বলতে পারেন, এই প্রশ্নের উত্তরই ঈশ্বরের সংজ্ঞা।

দুই.

অসাধারণ মেধাবী মহাকাশবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি, ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি, বিলাতের অক্সফোর্ডে; যদিও তাঁর পরিবারের বাসস্থান ছিল লন্ডনে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। তাই পড়াশোনাটাও অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ পরিসরে। শিক্ষার্থী জীবনের গোড়া থেকে তাঁর ঝোঁক ছিল গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের দিকে, বিশেষ করে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে।

একপর্যায়ে মহাকাশবিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ তৈরি হয়। সে জন্য এ বিষয়ে অধিক অগ্রসর কেমব্রিজে তাঁর পড়াশোনা ও গবেষণা। এরই মধ্যে তিনি দুরারোগ্য মোটরনিউরন রোগে আক্রান্ত হন। নামটা বেশ খটোমটো, সংক্ষেপে ASL. চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এ সম্পর্কে একটি সরস ঘটনা না বলে পারছি না। মেডিসিনের মোটাসোটা বইটিতে ‘নার্ভাস সিস্টেম’ (স্নায়ুতন্ত্র) অধ্যায়টি সবচেয়ে বড়। পড়তে গিয়ে প্রবল হতাশা। ওই ASL থেকে অধিকাংশ রোগের সম্পর্কে লেখা—রোগের উৎস বা কারণ অজ্ঞাত। এর চিকিৎসাও নেই।

তাহলে এত পরিশ্রমে এগুলো পড়ে কী হবে? আর সে প্রতিক্রিয়ায় আমার এক বন্ধু যখনই ‘নার্ভাস সিস্টেম’ পড়তে গিয়ে এজাতীয় বক্তব্যের সম্মুখীন হতেন, তখনই ওই বিশাল মোটা বইটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিতেন। রুমে গভীর মনোযোগে পাঠরত দুই সহপাঠীর চমকে উঠে প্রশ্ন : ‘কী, হলোটা কী?’ জবাব : না, এগুলো পড়ার কোনো অর্থ নেই। অবশ্য পরে একসময় মেঝে থেকে বইটা কুড়িয়ে এনে আবার পড়া শুরু, পরে আবারও একই ঘটনা। এই নিয়ে কী হাসাহাসি!

আশ্চর্য এমন এক কঠিন মস্তিষ্ক স্নায়ুরোগে আক্রান্ত স্টিফেন হকিং চিকিৎসকের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত করে সত্তরোর্ধ্ব বয়স অবধি বেঁচে থেকে মহাকাশবিজ্ঞানের চর্চায় নতুন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কারে অবিশ্বাস্য অবদান রেখে গেলেন। বিশ শতকের পদার্থবিজ্ঞানে বড় দুটি আবিষ্কার ম্যাক্স প্ল্যাংকের কোয়ান্টামতত্ত্ব এবং আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব।

দুটি তত্ত্বই পদার্থবিজ্ঞানে বৈপ্লবিক চরিত্রের। কিন্তু আশ্চর্য যে আইনস্টাইন কোয়ান্টামতত্ত্বকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। কথাটা হকিংয়ের। কিন্তু এ দুই তত্ত্ব সম্পর্কে হকিং কী বলেন? তিনি যেমন আপেক্ষিকতত্ত্ব মানেন তেমনি কোয়ান্টামতত্ত্ব। কিন্তু তাঁর অধিক পক্ষপাত কোয়ান্টামতত্ত্বের প্রতি। এই কণাবাদী তত্ত্বের ওপর নির্ভর করেছেন তাঁর বিস্ময়কর তত্ত্বগুলোর ক্ষেত্রে।

তাঁর স্থান-কালবিষয়ক বইতে তিনি লিখেছেন : ‘কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সঙ্গে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ যোগ করলে এমন একটি সম্ভাবনা মনে আসে, যে সম্ভাবনা আগে ছিল না।’ মহাবিশ্ব বিজ্ঞানকে জনবোধ্য করতে এ বইটি (‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’) অবিশ্বাস্য ভূমিকা পালন করে (১৯৮৭)। একটি তথ্যে দেখছি, বইটির বিক্রয়সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি। ভাবা যায় না।

পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁর গবেষণাকর্মের শুরুতেই বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বের বিষয়টি বেছে নেন। তাঁর মৌলিক গবেষণার প্রধান বিষয় ‘কৃষ্ণগহ্বরতত্ত্ব’ (ব্ল্যাক হোল থিওরি) বা বিগ ব্যাং তত্ত্বকেও প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর গবেষণাকর্মের প্রথম পর্বে সহকর্মী ছিলেন মেধাবী গবেষক রজার পেনরোজ, জর্জ এলিস প্রমুখ। দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ কোয়ান্টামতত্ত্ব নিয়ে নিজস্ব গবেষণাকর্মে (১৯৭৪ থেকে) একইভাবে সহকর্মী ছিলেন বিজ্ঞানী গ্যারি গিবনস, ডন পেজ প্রমুখ।

কৃষ্ণগহ্বরবিষয়ক বিস্ফোরণ তত্ত্বের নানা দিক, বিশেষ করে সেখান থেকে শক্তিকণার বিকিরণ (হকিং রেডিয়েশন) নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে, তাঁর খ্যাতির সীমানার অভাবিত বিস্তার ঘটায়। এ আলোচনায় পদার্থবিজ্ঞানের জটিলতায় প্রবেশ না করে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে পদার্থবিজ্ঞানে যেসব ‘বল’ আবিষ্কৃত হয় সেগুলোকে এক তত্ত্বে প্রকাশের চেষ্টা চালিয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানীরা।

হকিংও এ প্রচেষ্টার যাত্রী। তবে আপেক্ষিকতাবাদ ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের সমন্বয় ঘটিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের আধুনিক অগ্রযাত্রায় বিশেষ অবদান রেখেছেন স্টিফেন হকিং। অবাক হওয়ার কিছু নেই সংবাদপত্রে তাঁর মৃত্যুতে শ্রদ্ধাস্মারক লেখাগুলোর সংখ্যাধিক্য দেখে। কারণ তাঁর বৈশিষ্ট্য গবেষণাগারের বাইরে বৈশ্বিক সমস্যা, বিশ্বজনসমস্যা, অনাকাঙ্ক্ষিত জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, আঞ্চলিক যুদ্ধ ও বিশ্বশান্তি নিয়ে ভাবনা এবং সে ভাবনার প্রকাশ বিবৃতিতে, সাক্ষাৎকারে। সর্বোপরি গবেষণাগারের আবিষ্কার ও সংশ্লিষ্ট জ্ঞানকে সাধারণ মানুষের গোচরে নিয়ে আসা। যে উদ্দেশ্যে বিশেষ কয়েকটি বই লেখা জনবোধ্য ভাষায়। এ কাজটি অন্য প্রতিভাবান পদার্থবিজ্ঞানীরা করেননি।

হুইলচেয়ারে বসা মহাকাশবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে নিয়ে তাই বাংলাদেশেও সংবাদমাধ্যমে বিচিত্র শিরোনামে শ্রদ্ধা নিবেদন তাঁর প্রয়াণ উপলক্ষে। কারো ভাষ্যে তিনি ‘মহাকালের নায়ক’, কারো ভাষ্যে ‘খেয়ালি বিজ্ঞানী’, কারো মতে ‘কোথাও নিউটন, আইনস্টাইনকে ছাড়িয়ে হকিং’ ইত্যাদি। আমাদের এক বিজ্ঞানীর মতে, ‘তিনি মানবজাতিকে বিজ্ঞানের নতুন স্তরে নিয়ে গেছেন।’

এমন সব শিরোনামের নিবন্ধের তাত্ত্বিক আলোচনার শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশে প্রয়াত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের স্মরণে এ সাদামাটা অতাত্ত্বিক লেখাটি পরিবেশিত।

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

রাজনীতিকে ‘অলাভজনক’ করাই হবে সবচেয়ে বড় সংস্কার

    নূরে আলম সিদ্দিকী
শেয়ার
রাজনীতিকে ‘অলাভজনক’ করাই হবে সবচেয়ে বড় সংস্কার

জুলাই-আগস্টের রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে চিরদিনের জন্য বদলে ফেলার একটি দুর্লভ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হওয়া দুটি তরুণ প্রজন্ম চরম অপমানজনকভাবে রুখে দিয়েছে বহুল সমালোচিত স্বৈরাচারী শাসনের অগ্রযাত্রাকে। এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল তরুণ প্রজন্ম। তাদের এই অবিস্মরণীয় অর্জন আজ সমগ্র বিশ্বের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

এরই স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট ২০২৪ সালে বিশ্বের সেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচিত করেছে।

সঠিক গণতন্ত্রের অভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এমন এক স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে আছে কেবল ক্ষমতা ভোগ ও লুটপাট। অথচ রাজনীতির মৌলিক উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনকল্যাণ, কিন্তু তা আজ ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রাজনীতিকে অলাভজনক করে তোলা এবং সেই সঙ্গে মন্ত্রী, এমপিদের সব ধরনের অনৈতিক আর্থিক ফায়দা লাভের সুযোগ বন্ধ করাই হবে দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সংস্কার।

রাজনীতিতে এ ধরনের আমূল পরিবর্তন আনার মাধ্যমে গণতন্ত্র, সুশাসন ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। তবে এই পরিবর্তন আনতে হলে প্রয়োজন পর্যাপ্ত সময়, ধৈর্য, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, কার্যকর নীতিমালা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে এই লক্ষ্যে সুচিন্তিত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশে রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে।

নির্বাচন, পদায়ন এবং সরকারি সুবিধাগুলোকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহারের প্রবণতা স্বাধীনতার পর থেকেই ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়েছে। ফলে দুর্নীতি বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে সীমাহীনভাবে। রাজনীতিবিদদের অনেকে সরকারি প্রকল্প ও উন্নয়ন কার্যক্রমের আড়ালে অবৈধ সম্পদ অর্জনের পন্থা খুঁজে পান।
যখন রাজনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ বা অনৈতিক অর্থ উপার্জন করা সম্ভব হবে না, তখন দুর্নীতি করার প্রবণতাও কমবে। জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কাজের প্রতি রাজনীতিবিদদের মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে। প্রশাসন হবে কার্যকর, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। রাজনীতিতে এই পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে প্রথমেই নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন  এবং বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করে তোলা প্রয়োজন। রাজনীতিবিদদের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

দলীয় তহবিল ও নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য স্বচ্ছ ও নির্ধারিত নিয়ম থাকা এবং সেগুলো যাতে কঠোরভাবে মেনে চলা হয়, তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অর্থের অপব্যবহার রোধ করতে দলগুলোর তহবিল পরিচালনা নিয়মিত নিরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে রাজনীতিবিদদের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা সীমিত করা উচিত। সরকারি সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন ও তা কার্যকর করতে হবে। সর্বোপরি রাজনীতিতে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ও মনোযোগ বাড়াতে হবে। যখন জনগণ রাজনীতির প্রতি সচেতন হবে, তখন তারা সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের প্রত্যাখ্যান করবে।

এই প্রক্রিয়ার অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেসব রাজনীতিবিদ রাজনীতিকে ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন, তাঁরা কখনো এই পরিবর্তন মেনে নেবেন না। তাঁদের বিরোধিতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমানে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে তারই প্রতিফলন ঘটছে। তা ছাড়া বেশির ভাগ মানুষ রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত নয়। তাদের শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা সময়সাপেক্ষ। সর্বোপরি যেসব প্রতিষ্ঠান রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ছাড়া রাজনীতিকে অলাভজনক করা সম্ভব নয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ করার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করতে হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে সরকারি পদায়ন ও অনৈতিক সুবিধা বন্ধ করতে হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিজেই দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। ব্যাপক সংস্কার এনে এই কমিশনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও কার্যকর দুর্নীতি দমন নিশ্চিত করতে হবে। বিচারব্যবস্থায় সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনীতিতে ও সমাজে নৈতিকতা এবং স্বচ্ছতার গুরুত্ব নিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, যাতে তারা অনৈতিক কার্যকলাপ উদঘাটন করতে পারে। শিক্ষিত ও দক্ষ নেতাদের রাজনীতিতে উৎসাহিত করতে হবে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক পদে থাকা ব্যক্তিদের অপ্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধা এবং বিশেষাধিকার সীমিত করতে হবে। সরকারি প্রকল্পে রাজনৈতিক প্রভাব এবং অবৈধ সুবিধা অর্জনের পথ বন্ধ করতে হবে।

নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী এবং তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সব কর্মকাণ্ড ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রেকর্ড করতে হবে, যেন যেকোনো অনিয়ম চিহ্নিত করা যায়। ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সমঝোতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

এসব পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকারকে গ্রহণ করতে হবে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে। এসব কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়নই রাজনীতিকে অলাভজনক ও জনকল্যাণমুখী করার পথে একটি মাইলফলক হতে পারে। আর রাজনীতিকে অলাভজনক করার মাধ্যমে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক সংস্কার নয়, বরং একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনেরও সূচনা। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও জনগণের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।

 

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

মন্তব্য

বস্ত্র খাতে সংকট : অনিশ্চয়তায় লাখো শ্রমিক

    সাহিদা পারভীন শিখা
শেয়ার
বস্ত্র খাতে সংকট : অনিশ্চয়তায় লাখো শ্রমিক

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাকশিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই খাত থেকেই দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ রপ্তানি আয় আসে। লাখ লাখ শ্রমিক, বিশেষ করে নারী শ্রমিক এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনের জমিন এখন নরম হয়ে যাচ্ছে।

গত এক-দেড় বছরে যে ধাক্কাগুলো এসেছে, তাতে শুধু রপ্তানি আয় নয়, হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা পড়ে গেছে অনিশ্চয়তার মুখে।

২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে শুধু বিজিএমইএর (বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন)আওতায় থাকা ১১৩টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানায় কাজ করতেন প্রায় ৯৬ হাজার শ্রমিক। এর বাইরেও বন্ধ হয়ে গেছে আরো অনেক ছোট সাবকন্ট্রাক্টর কারখানা, যাদের সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও অনুমান করা হয় মোট বন্ধ কারখানার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।

একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে অর্ডার কমে যাওয়া, অন্যদিকে বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটসহ নানা কারণে উৎপাদন কমে যাওয়াসব মিলিয়ে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোর পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকগুলো বন্ধ হওয়ার পথে কিংবা কোনো রকমে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। শ্রমিকরা বেকার হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন।

বেকার হয়ে পড়া একজন নারী শ্রমিক জানালেন, প্রথমে ভাবছিলাম কয়েক দিন ছুটি, পরে জানতে পারি কারখানাই আর খুলবে না।

এখন ঘরে খাবার নেই, বাড়িভাড়াও বাকি। এমন হাজার হাজার গল্প ছড়িয়ে আছে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ আর চট্টগ্রামের শিল্প এলাকায়। এই বেকার শ্রমিকদের কোনো সামাজিক নিরাপত্তা নেই। কোনো রেশন নেই, নেই প্রশিক্ষণের সুযোগ বা বিকল্প কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা।

বাংলাদেশি পোশাকের একটি বড় বাজার ছিল যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু গত জুলাইয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষিত নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ এই শিল্পকে আরো বড় ধাক্কা দিতে চলেছে। আগে এই শুল্ক ছিল গড়ে ১৬ শতাংশ। নতুন-পুরনো মিলিয়ে এখন শুল্ক দিতে হবে ৫১ শতাংশ। ফলে আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম বেড়ে যাবে, বিক্রি কমে যাবে এবং বাংলাদেশের রপ্তানিতে তার প্রভাব পড়বে। এই পরিস্থিতিতে ওয়ালমার্ট, জেসি পেনি, ওল্ড নেভির মতো অনেক বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে তাদের অর্ডার স্থগিত করেছে। এর মধ্যে ওয়ালমার্টের প্রায় এক মিলিয়ন সাঁতারসামগ্রীর অর্ডার বন্ধ হয়ে গেছে।

বিজিএমইএ জানিয়েছে, একদিকে ১১৩টি কারখানা বন্ধ হলেও অন্যদিকে ১২৮টি নতুন কারখানা চালু হয়েছে। কিন্তু এসব কারখানায় মাত্র ২২ হাজার শ্রমিক নিয়োগ পেয়েছেন। অর্থাৎ যাঁরা বেকার হয়েছেন, তাঁদের বিশাল অংশ এখনো কাজ পাচ্ছে না। অনেকেই বলেন, নতুন কারখানাগুলো প্রযুক্তিনির্ভর এবং দক্ষ শ্রমিক ছাড়া সেখানে কাজ পাওয়া কঠিন। ফলে আগে যাঁরা সাধারণ অপারেটর ছিলেন, তাঁদের আর জায়গা হচ্ছে না।

যেকোনো অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষ। পোশাক শ্রমিকরা তাঁদের উপার্জন দিয়ে শুধু নিজেদের নয়, গ্রামে থাকা সন্তান, মা-বাবা ও ভাই-বোনদের সহযোগিতা করেন। তাঁরা বেকার হয়ে গেলে গ্রামের অর্থনীতি, বাজার, দোকানদার থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালাও প্রভাবিত হন। ফলে এটি শুধু গার্মেন্টস খাতের সংকট নয়, এটি একটি সামাজিক বিপর্যয়ের সূচনা।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে এই সংকট মোকাবেলায় খুব জোরালো কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। কিছু ব্যাংকঋণ পুনঃ তফসিল, কিছু সাবসিডিএসব যথেষ্ট নয়। শ্রমিকদের জন্য পুনঃপ্রশিক্ষণ, বেকার ভাতা বা নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরির উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। অন্যদিকে মালিকদের একটি অংশ শ্রমিক ছাঁটাইকে সুযোগ হিসেবেও দেখছে। দীর্ঘদিন ধরে কারখানায় কাজ করা অনেক শ্রমিককে বিনা ক্ষতিপূরণে বিদায় করে দিচ্ছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ বন্ধ কারখানার নামে নতুন কারখানা খুলে নতুন কর্মী নিচ্ছেন পুরনোদের না জানিয়ে।

আমরা যদি এখনই এই সংকট সমাধানের দিকে গুরুত্ব না দিই, তাহলে এর প্রভাব আগামী এক দশকেও কাটবে না। একটি দেশের গার্মেন্টস খাত শুধু রপ্তানির মাধ্যম নয়, এটি সামাজিক স্থিতি এবং নারী-অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। একে রক্ষা করা মানে দেশের ভিত রক্ষা করা।

বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো কোনো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক অনেক কম। তারা প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে থাকবে। আমরা যদি এখনই না জাগি, তাহলে এই সোনালি খাত আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

 

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এবং দপ্তর সম্পাদক

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

মন্তব্য

উন্নয়নের আড়ালে কালো অর্থনীতির উদ্ভব

    আব্দুল বায়েস
শেয়ার
উন্নয়নের আড়ালে কালো অর্থনীতির উদ্ভব

কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের উন্নয়নকে বলা হতো উন্নয়ন ধাঁধা বা ডেভেলপমেন্ট প্যারাডক্স। বিগত দশকগুলোতে চোখ-ধাঁধানো উন্নয়ন না হয়ে থাকলেও যতটুকু অর্জিত হয়েছে, তা চোখে ধাঁধা লাগানোর মতোই বলা যেতে পারে। কার কাছে? নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে যারা, জেনে বা না জেনে, বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে শঙ্কিত ছিল; তারা ভাবতেও পারেনি যে কোনো এক সময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পৃথিবীতে খবর হয়ে উঠবে, সাড়া জাগাবে। কোনো দ্বিধাগ্রস্ত না হয়েই একসময় বাংলাদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা।

দুই

বাংলাদেশের উন্নয়নকে তুলনামূলক হিসাবে ন্যস্ত করা যায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে। বিশেষ করে জানতে ইচ্ছা হয়, সেই পাকিস্তানের তুলনায়  বাংলাদেশ ভালো, না খারাপ আছে? এমনকি প্রতিবেশী বিশাল দেশ ভারতের চেয়ে? পরিসংখ্যান দিয়ে পরিষ্কার করা যাক। ধরুন, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই পাকিস্তানের মাথাপিছু জিএনআইয়ের ৫৫ শতাংশ ছিল, অথচ ২০১০ দশকের শেষের দিকে পাকিস্তানের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ছিল ভারতের ৮৭ শতাংশ, পার্থক্যটা বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০ দশকে দাঁড়ায় ৭৪ শতাংশ, কিন্তু ২০১০ দশকের শেষ দিকে হ্রাস পেয়ে হয় ৮২ শতাংশ।

তিন

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/22-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgসব আশাব্যঞ্জক গল্পের একটা অন্ধকার দিক থাকে। বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রাকে তেমনি এক আলো-আঁধারির খেলা বললে বোধ করি ভুল হবে না। একদিকে উন্নয়নের ফলে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, অথচ  অন্যদিকে ধনী-গরিব বৈষম্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।  অর্থনীতিবিদ হারসম্যান ও রথচাইল্ড বলেছেন, টানেল প্রভাবের কথা : বিদ্যমান কাঠামোতে আয়বৈষম্যের প্রতি যদি সহনশীলতা কম থাকে, তাহলে আগে বাড়া, পরে বিতরণ এমন তত্ত্ব বিপজ্জনক হতে পারে।

বাংলাদেশের বিদ্যমান বৈষম্য সহগ (গিনি সহগ) বিপৎসীমার কাছাকাছি। বৈষম্য বেশি হলে দারিদ্র্য নিরসনে প্রবৃদ্ধির প্রভাব খাটো থাকে অর্থাৎ একই প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে কম বৈষম্যের সমাজে দারিদ্র্য হ্রাসের হার বেশি হবে বেশি বৈষম্যের সমাজের চেয়ে।

অন্যদিকে আশা ছিল কুজনেটসের চুইয়ে পড়া প্রভাব তত্ত্ব (বা ট্রিকল ডাউন ইফেক্ট থিওরি) কাজে দেবে, কিন্তু সে আশায় যেন গুড়ে বালি। ট্রিকল ডাউন ইফেক্ট  বলতে চায়, প্রবৃদ্ধির প্রারম্ভিক স্তরে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে চুইয়ে পড়া সুফলে বৈষম্য হ্রাস পায়। সেটা খুব একটা কাজ করছে বলে মনে হয় না কিংবা ভবিষ্যতে করবে এমন ইঙ্গিত আপাতত নেই বলে মনে হয়।

আর যদি ঘটেও থাকে, তা যে খুবই দুর্বল সে কথা বলা বাহুল্য। এদিকে আবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে ঠিকই, কিন্তু তা কাম্য স্তরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না।

গেল চার দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধাঁধার আড়ালে-আবডালে অভাবনীয় উত্থান ঘটেছে কালো এক অর্থনীতির (আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমি)। মূলত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে অর্থনৈতিক শয়তানের অভাবনীয় আবির্ভাব ঘটেছে। অন্ধকারে থাকা এই অর্থনীতি সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত রাখছে, রাজনীতিকে কলুষিত করছে, বিকৃত ভোগবাদী সমাজ সৃষ্টিতে জ্বালানি জোগাচ্ছে, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। মোটাদাগে, এটি টেকসই উন্নয়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।

ক্ষেত্রবিশেষে এর ভেতরে অথবা পাশাপাশি অবস্থান নিয়েছে সর্বব্যাপী চরম দুর্নীতি। যদিও এ দেশে দুর্নীতির ইতিহাস বেশ দীর্ঘ, তার পরও বিগত দশকগুলোতে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে উত্থান ঘটেছে এক শ্রেণির দাপুটে, ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজের। বলা যায়, সমাজের অভিভাবক এখন তাঁরাই। দুর্নীতি প্রতিবছর জিডিপির ২ শতাংশের মতো গিলে খায়। তা ছাড়া প্রতিবছর দেশ থেকে নাকি অবৈধ পথে পাচার হতো গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি ডলার; ২০০৬ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত নাকি ছয় হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে বলা হচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও গেল এক বছরে দুর্নীতির মচ্ছবের সংবাদ পত্রিকার পাতায় কিংবা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত।

সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা। এখন এমনকি রক্ষণশীল হিসাবেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন থেকে চার লাখ কোটি টাকা। এর একটি অংশ বিদ্যমান আইনের ফাঁকফোকরে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ। শেয়ারবাজার লুট করে উত্থান ঘটেছে এক শ্রেণির ধনী মানুষের, অথচ সেই কলঙ্কিত বাজার এখনো তা-ই আছে। দিনে-দুপুরে ব্যাংক ডাকাতির কথা আপাতত না হয় থাক। তবে বলতেই হবে যে ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী কিংবা ব্যাংক ডাকাতদের বেশির ভাগ দেশে অথবা বিদেশে দাপটে ও সুখে আছে। অথচ তাদের কেউ এই ১০ থেকে ২০ বছর আগেও হিমশিম খেতেন সংসার চালাতে। তাঁরা হয়ে উঠেছেন দানব। অর্থনীতির গ্রেসামস ল অনুযায়ী, মন্দ টাকা ভালো টাকাকে বাজারছাড়া করে, তেমনি আজ এই সমাজে মন্দ লোক ভালো লোককে কোণঠাসা করে রাখছে। রাজনীতি কলুষিত হয়েছে কালো টাকায়; এদের অস্ত্রের ভাষা কেড়ে নিয়েছে আমজনতার ভাষার অস্ত্র।

 চার

দুর্নীতির কালো থাবায় সমাজটা যখন ক্ষতবিক্ষত, দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে গেছে বলতে হয়, ঠিক তখন অন্তর্বর্তী সরকারের সরাসরি নির্দেশে চলছে অর্থপাচারের  বিরুদ্ধে অভিযানের মতো একটি মহতী পদক্ষেপ।  অভিনন্দন, ব্যাটার লেট দ্যান নেভার।

ওই অভিযানের ফলে কালো অর্থনীতির নায়কদের অভাবনীয় উত্থানের সম্যক নমুনা জাতির সামনে আজ উপস্থিত। পত্রিকার পাতা ওল্টালে অবৈধ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা পাওয়া যায়। কারো কাছে শত শত কোটি টাকার এফডিআর, কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স, ১০-১২টি ফ্ল্যাট, পাচার করা অর্থ দিয়ে বিদেশে আলিশান বাড়ি, গাড়ি, মোটা অঙ্কের ব্যাংক ব্যালান্স ইত্যাদি। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে এই কালো অর্থের প্রভাব অনেক। ভাতের হাঁড়ির কটা ভাত টিপলেই যেমন বোঝা যায় ভাত সিদ্ধ হয়েছে কি না, তেমনি চলমান অভিযানের ক্ষুদ্র নমুনা থেকে অনুমান করা যায় দেশব্যাপী অবৈধ সম্পদের পরিমাণ কত হতে পারে। শুধু বিদেশে নয়, দেশের ভেতরেও আরো অনেক কর্মকাণ্ডে অবৈধ ও অনৈতিক লেনদেন হয়, যা উইপোকার মতো উন্নয়নকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আর একটি কথা, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে ঠিকই, কিন্তু তাকে টেকসই করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার তেমন হচ্ছে না বিধায় চায়ের কাপ আর ঠোঁটের মধ্যকার ব্যবধান থেকেই যাচ্ছে।

পাঁচ

চলমান অভিযানের জন্য দেশের মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, তবে সংশয়মুক্ত হতে পারছে না। এর কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। দুর্নীতির ও কালো অর্থনীতির শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিস্তৃত, বিশেষত অতীতে মন্ত্রী, এমপি এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলারাও এ ক্ষেত্রে কম যাননি বলে অভিযোগ আছে। প্রধান উপদেষ্টার সব আন্তরিকতা সত্ত্বেও এত বড় একটি সাদা বিপ্লব ঘটবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকতেই পারে, যদি তাঁর নিজের লোকেরা দুর্নীতিমুক্ত না হন।

আমরা, আমজনতা, কায়মনোবাক্যে দুর্নীতি ও কালো অর্থনীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত এই অভিযানের সাফল্য কামনা করি। এর প্রধান কারণ আমরা একটি সাদা সমাজ চাই, যেখানে মেধাবী আর ভালো মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন; অর্থ, সম্পদ ও প্রতিপত্তি যেখানে প্রভু না হয়ে চাকর থাকবে। আমরা বর্তমান অবস্থার তথা অমানিশার দ্রুত অবসান চাই। আশায় আশায় তবু চেয়ে থাকি।

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেইপ্রীতি নেইকরুণার

আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি

এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়

মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিক্ষা অথবা সাধনা

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য তাদের হৃদয়।

(কবি জীবনানন্দ দাশ)

 

লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

ভয়াবহরূপে কিশোর গ্যাং : প্রতিকার প্রয়োজন

    ড. নিয়াজ আহম্মেদ
শেয়ার
ভয়াবহরূপে কিশোর গ্যাং : প্রতিকার প্রয়োজন

জনমনে এক আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। সাম্প্রতিক সময়ে ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যাসহ ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে গেছে কিশোররা। যদি এমন প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে বয়স বিবেচনায় অপরাধকে আলাদা করার আর কোনো সুযোগ থাকবে না কিংবা এখনই নেই বলা চলে। বগুড়ায় বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কিশোরীকে ছুরিকাঘাত এবং তাকে বাঁচাতে গিয়ে ওই কিশোরীর দাদি ও ভাবি নিহতের ঘটনা ঘটিয়েছে একটি কিশোর গ্যাং দ্বারা।

ঢাকার মোহাম্মদপুরের আদাবরে এক ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি খুন করেছে কিশোর গ্যাং। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতেই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য রয়েছে কয়েক হাজার। শুধু রাজধানী নয়, দেশের প্রতিটি বড় শহর, জেলা ও থানায়, এমনকি গ্রামেও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা রয়েছে। ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ৪০ শতাংশ করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা।
 

সহজভাবে বলতে গেলে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে। কেননা জন্মগতভাবে কেউই অপরাধী হয়ে জন্মলাভ করে না। বংশগতির কোনো না কোনো প্রভাব তার শরীরে থাকতেও পারে, কিন্তু তা যে ব্যাপক নয়, তা গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত। সমাজে আমরা স্বভাবতই ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বড় হই।

ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন সামাজিকীকরণ, ভিন্ন মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মধ্য দিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠা। আর এর প্রতিটি আমরা পরিবার, পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডল থেকে পেয়ে থাকি। কৃষ্টির প্রভাবে কোনো শিশুর ব্যক্তিত্ব হয়তো অপরাধীর ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিকাশ লাভ করতে পারে। পরিবেশ তার ওপর নানা ধরনের প্রভাব রাখে। চোরদের মধ্যে বড় হলে সেই পরিবেশের কারণেও কোনো শিশু চুরি করতে শিখতে পারে।
কাজ করে উপার্জন করার সুযোগ পেলেও চুরি তার কাছে সহজ বিকল্প মনে হবে। আবার ভদ্র ঘরে জন্মগ্রহণ করেও অপরাধমূলক পরিবেশ ও প্রভাবে একটি শিশু ধীরে ধীরে অপরাধীতে পরিণত হতে পারে। সমাজের মধ্যে কিছু উপকৃষ্টীয় অঞ্চল থাকে। যে উপকৃষ্টীয় অঞ্চলে অপরাধমূলক ব্যবহারের প্রাধান্য রয়েছে, সেখানকার শিশু-কিশোরদের অপরাধী হওয়ার আশঙ্কা বেশি। দলে মিলে খারাপ হওয়ার যে প্রবাদটি আমাদের দেশে প্রচলিত, তা এ কারণে হতে পারে।

একেক বয়সের শিশু ও কিশোরের চাহিদা একেক রকম। তাদের চাহিদা ও প্রয়োজন এবং তা পূরণের মাধ্যম উপযুক্ত ও মানানসই হওয়া উচিত। তাদের চাহিদা ও প্রয়োজন যেমন বস্তুগত, তেমনি অবস্তুগত। দুটিই পূরণ করতে হবে। মা-বাবার সামর্থ্য অনুযায়ী বস্তুগত চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা উচিত। সন্তানদের মা-বাবার সামর্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। অবস্তুগত চাহিদা পূরণে কোনো অবহেলা করা ঠিক নয়। শিশু-কিশোরদের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার পেছনে অবস্তুগত চাহিদা পূরণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবার কর্তৃক বস্তুগত প্রয়োজন পূরণের অভাব এবং মা-বাবার দায়িত্বশীলতার মধ্যে নিজেদের নিয়োজিত করতে না পারার বর্থ্যতা অপরাধপ্রবণতার জন্য দায়ী । এর সঙ্গে যুক্ত আধুনিক জীবনধারণের মোহ এবং মাদকাসক্তি ও অন্যান্য সামাজিক সমস্যার ব্যাপক প্রভাব। যখন পারিবারিক পরিবেশে শিশু-কিশোররা মা-বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়, তখন বাইরের পরিবেশ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। মা-বাবার স্নেহের বঞ্চনা শিশু-কিশোরদের মনে যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করে, তার সুযোগ নেয় কোনো না কোনো কিশোর গ্যাং কিংবা বড় ভাইয়েরা। এ ধরনের গ্যাং কিংবা বড় ভাইদের সঙ্গে মিশে শিশু-কিশোররা খুঁজতে চেষ্টা করে তাদের নিরাপত্তা। নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এমন সব আচরণ করে, যা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। 

সমাজ থেকে তৈরি হওয়া কিশোর গ্যাং সমস্যা সমাধানের উপায়ও সমাজ থেকেই চিন্তা করতে হবে। শিশু-কিশোররা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অনেক সময় বয়স্কদের দ্বারা শিখে থাকে। কাজেই বয়স্কদের অপরাধ ও অপরাধের নৃশংসতা যত বৃদ্ধি পাবে, কিশোরদের অপরাধও তত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। কাজেই বয়স্কদের অপরাধপ্রবণতা কমানোর প্রতি আমাদের জোর দিতে হবে। শিশুদের চাহিদা ও প্রয়োজনের প্রতি প্রতিটি পরিবারকে জোর দিতে হবে। বস্তুগত চাহিদার তুলনায় অবস্তুগত চাহিদার প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়া আমাদের বেশি করণীয়। আমরা বেশির ভাগ সময়ে আমাদের অবহেলা ও অসচেতনতার জন্য এই চাহিদাগুলোকে পূরণ করি না এবং এই চাহিদাগুলো পূরণের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি না। ফলে শিশু-কিশোররা অপূর্ণ চাহিদা ও প্রয়োজন নিয়ে বেড়ে ওঠে। আমাদের দরকার পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, পর্যাপ্ত সুস্থ বিনোদন এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক ও পারস্পরিক মেলামেশার পর্যাপ্ত সুযোগ। অবসর সময় কাটানোর জন্য দরকার একটি সুন্দর পরিবেশ, যে পরিবেশটি হবে বিনোদন, গঠনমূলক, আনন্দদায়ক ও শিক্ষণীয়; যেখানে শিশু-কিশোররা চিন্তা করার সুযোগ পাবে। তাদের মধ্যে কোনো বিষয় চিন্তার খোরাক জোগাবে।

শুধু তা-ই নয়, শৈশব থেকেই নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। মা-বাবার দায়িত্ব সন্তানদের নিয়মিত অনুসরণ এবং পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ করা। কোথায় যায়, কী করে এবং কাদের সঙ্গে ওঠাবসাএসবের খোঁজ রাখতে হবে। সন্তানদের কথাবার্তা, চালচলন, আচার-ব্যবহার বিশেষভাবে খেয়াল করতে হবে। কেননা বাইরের জগৎ এখন বিশাল এবং ব্যাপক। অনেক কিছুই এখন সহজলভ্য। যেকোনো খারাপ কাজে যুক্ত হওয়া অনেক সহজ। সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং পর্যবেক্ষণ আমাদের শিশু-কিশোরদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। তাদের মধ্যে অপরাধমূলক সংঘবদ্ধতা রোধ করতে পারে।

 

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

neazahmed_2002@yahoo.com

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ