<p>সময়টা ছিল ১৮০৮ সাল। পশ্চিমবঙ্গের পূর্বস্থলীর বহড়া গ্রামে বাস করতেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। সে সময় মিশনারি পাদ্রিরা খ্রিষ্টধর্মীয় নানান বই বিলি করত ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। বইগুলো ছাপানো ছিল বাংলায়। সেসব বই হাতে পেয়ে গঙ্গাকিশোর এক নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। তার ইচ্ছে ছিল বাংলা গল্পকে বই হিসেবে বাঙালির ঘরে পৌঁছানো। ধর্মীয় বই বই বিলি করতে আসা পাদ্রিদের জিজ্ঞাসা করে গঙ্গাকিশোর জানতে পারেন, এই বইগুলো ছাপানো হয়েছে শ্রীরামপুর মিশনারি ছাপাখানায়।</p> <p>এ সময় গঙ্গাকিশোরের আগ্রহ দেখে একজন পাদ্রি তাকে শ্রীরামপুর মিশনারিতে যোগদানের পরামর্শ দেন। কিন্তু শ্রীরামপুর মিশনারি যুবক গঙ্গাকিশোরকে কাজ করার সুযোগ দেবে কেন?</p> <p>এ সময় বহড়া গ্রামের বাসিন্দা কৃষ্ণনগরের রাজ পুরোহিত ত্রয়োনিধি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেন গঙ্গাকিশোর। গঙ্গাকিশোরের আগ্রহের কথা কৃষ্ণনগরের রাজার কাছে জানান রাজ পুরোহিত। সে সে সময় স রাজপরিবারের সঙ্গে শ্রীরামপুর মিশনারির বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। শ্রীরামপুর মিশনারি ছাপাখানার কাজের জন্য বাংলা, সংস্কৃত এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষ পণ্ডিতের প্রয়োজনীয়তা ছিল প্রবল। তাই রাজা গিরিশচন্দ্রের অনুরোধে সেখানে যোগ দেন গঙ্গাকিশোর। </p> <p>তৎকালীন শ্রীরামপুর ছিল ড্যানিশ শাসনাধীন। ব্যাপটিস্ট মিশনারি পরিচালনা করতেন বাংলা ভাষা অনুরাগী কয়েকজন ভিনদেশি পণ্ডিত। যোওয়া মার্শম্যান, ফেলিক্স কেরি, উইলিয়াম ওয়ার্ডসহ কয়েকজন বাংলা ভাষায় ধর্মীয় পুস্তক ছেপে সারা বাংলায় বিলি করার কাজে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন। এসব গুণী মানুষের কাছে কাজ শিখতে শুরু করেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। </p> <p>বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ হওয়ায় অন্যদের সুনজরে পড়েন গঙ্গাকিশোর। সে সময় জন ক্লার্ক মার্শম্যান আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রীরামপুর মিশন পরিচালনার সদস্য নিযুক্ত করা হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। স্বভাবতই গঙ্গাকিশোরের সঙ্গে গাঢ় হয় তার সম্পর্ক। </p> <p>এর মধ্যে ১৮১৬ সালে শ্রীরামপুর মিশনে থাকাকালীন জুলাই মাসে কলকাতার ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানি থেকে সচিত্র ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন গঙ্গাকিশোর। বাঙালি লেখকের প্রথম সচিত্র বই ছিল এটি। বইটির বিক্রিও ছিল বেশ ভালো। দিনে দিনে ছাপাখানার দক্ষ কারিগর হয়ে উঠছিলেন গঙ্গাকিশোর। </p> <p>নিজেই ব্লক, টাইপ করতে পারতেন। ১৮১৬ সালের নভেম্বর মাসে ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানি থেকে আরও একটি বই মুদ্রণ করেন গঙ্গাকিশোর। এ আগ্রামার ইন ইংলিশ অ্যান্ড বেঙ্গলি। বইটিতে ইংরেজি বর্ণমালা এবং বিভিন্ন শব্দের উচ্চারণ দেয়া হয়েছিল। বইটির প্রাপ্তিস্থান হিসেবে ঠিকানা দেয়া হয় কলকাতা অফিস ও শ্রীরামপুর কাছারিবাড়ি। এ ছাড়া ঘরে ঘরে বই পৌঁছে দিতে কমিশনের ভিত্তিতে গ্রামগঞ্জে প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। </p> <p>বই ব্যবসা যখন জমে উঠল তখন ১৮১৭ সালে কলকাতার চোরাবাগানে দপ্তরসহ বিক্রয়াকেন্দ্রও খুলেছিলেন তিনি। এর মাধ্যমে প্রথম বাঙালি বই ব্যবসায়ী হিসেবে কলকাতার বুকে পরিচিতি পেয়েছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য।</p> <p>গঙ্গাকিশোরের বইয়ের চাহিদা দিন দিন বাড়তে শুরু করল। ১৮১৮ সালের মে মাসে বন্ধু হরচন্দ্র রায়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েয়ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র কোনটি সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। <br /> সমাচার দর্পণ নাকি বঙ্গাল গেজেট? প্রথম বাংলা সংবাদপত্র হিসেবে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের বঙ্গাল গেজেটকেই ধরা হয়। এটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৮১৮ সালের ১৫ মে। তবে এখন পর্যন্ত এর প্রথম সংখ্যার কোনো হদিস মেলেনি। এমনকি প্রাচীন কোনো গ্রন্থাগারেও মেলেনি এ সম্পর্কিত কোনো প্রমাণ।</p> <p>তবে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গঙ্গাকিশোরের জীবনীগ্রন্থে বঙ্গাল গেজেটি পত্রিকার ব্যাপারে রয়েছে পরিষ্কার তথ্য। সেই বইয়ে বঙ্গাল গেজেটির প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত দুটি বিজ্ঞাপনেরও উল্লেখ আছে।</p> <p>ভারতে বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্রের জনক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য সফল বই ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভের পর আরও দুই বই ব্যবসায়ী প্রতিযোগী হয়ে উঠেছিলেন। সেই ব্যবসায়ীর নাম বিশ্বনাথ দেব এবং লাল্লুজি। তবে গঙ্গাকিশোরের নাম বেশ ভালোভাবেই লেখা আছে ইতিহাসে।</p>