<p>বর্তমান জীবনে সব থেকে বড় যদি কোনো বিষয় মানুষকে ভাবায় সেটা হলো মানসিক স্বাস্থ্য। এতো বছর যাবৎ আমরা শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে এসেছি এই গুরুত্বের অন্তরালে মানসিক স্বাস্থ্য নামক এক বিশাল পরিধিকে আমরা উপেক্ষা করে এসেছি।</p> <p>এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের যেতে হবে মনোবিজ্ঞানের দারপ্রান্তে। মনোবিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু বিষয় উপস্থাপন করা হলে এ ধারণা আমাদের কাছে হয়ে উঠবে আরো স্পষ্ট। মনোবিজ্ঞান মূলত দর্শনের গর্ভে ছিলো।এটাকে জন্ম ও যাত্রাপথ কেমন হবে তা নির্ধারনে এক এক সময়ে সমসাময়িক দার্শনিক বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় রেখে মতবাদ প্রস্তাব করেছেন। যাকে আমরা যাত্রার বর্ননা  বলতে পারি।</p> <p>এই মতবাদগুলোকে সাইকোলজি ইতিহাসের ভাষায় এক একটি প্যারাডাম বা স্কুল বলে। যেমন জন লকের অনুষঙ্গবাদ যা জন্ম নেয় মূলত জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত দার্শনিক সমস্যা থেকে। এর প্রেক্ষিতে জন লক বলেন, ‘মন হলো সাদা ফলক বিশেষ আমাদের অভিজ্ঞতা হলো এর মধ্যে রেখা পাত।’ এই ধারণা থেকে বেরিয়ে টিচেনার এবং উইলহ্যাম উন্ড (আধুনিক মনোবিজ্ঞানের জনক) মনোবিজ্ঞানকে চেতনার বিজ্ঞান বলেন যেখানে চেতনা হলো কোনো বিশেষ মুহূর্তে ব্যক্তির অভিজ্ঞতাসমূহের যোগফল। উন্ড এবং টিচেনারই সফলভাবে মনোবিজ্ঞানকে দর্শনের নাগপাশ হতে বের করে মনোবিজ্ঞানের যাত্রার পথকে সুগম করেন।  </p> <p>কাঠামোবাদের সমালোচনা করতে এসে সৃষ্টি হয় ক্রিয়াবাদের৷ মানুষ কি করে এবং কেন করে এর প্রণালীবদ্ধ আলোচনা করো ক্রিয়াবাদ। উইলিয়াম জেমস তার বিখ্যাত বই ‘দ্য প্রিন্সিপাল অব ফিলোসফি’-র মাধ্যমে সারা বিশ্বে মনোবিজ্ঞানকে জনপ্রিয়ভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ বইটি ছিল সে সময়ের সবচেয়ে থেকে বেশি বিক্রিত একটি বই। এর মাধ্যমে উইলিয়াম জেমস কাঠামোবাদকে উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ইউরোপিয়ানদের মনোবিজ্ঞান সংকীর্ণ, কেননা উন্ড এবং টিচেনারের মতবাদে শুধু চেতনা যা ব্যক্তির অভ্যন্তরীন বিষয়কেই আলোকপাত করা হয়েছে যা জ্ঞানের ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করে। </p> <p>এরপর আসে আচরণবাদ ,যেখানে ভূমিকা বিবেচনায় আচরণবাদীদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ক্লাসিক্যাল আচরণবাদী, নিউ (neo) আচরণবাদী।</p> <p>এভাবে সমগ্রতাবাদ, ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণবাদ,ও অস্তিত্ববাদ এবং অন্যান্য মতবাদের মাধ্যমে আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা ও বিভিন্ন উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে মনোবিজ্ঞান মানুষ ও প্রাণীর মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা ও তা পরিমাপের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।<br /> মনোবিজ্ঞানকে দার্শনিক ও সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা অনেকভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। তাদের ধারণার সামগ্রিকতা থেকে বলা যায় যে মনোবিজ্ঞান হলো মানুষ ও প্রাণীর আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার বিজ্ঞানসম্মত অনুধ্যান। </p> <p>এতক্ষণ মনোবিজ্ঞানের জন্ম সংক্রান্ত কথাবার্তা হলো। এবার দেখা যাক, এই মনোবিজ্ঞান বড় হয়ে যৌবনে কী অবস্থায় এলো। তার যৌবন কতটা সুন্দর তা বুঝতে হলে বর্তমানের সমস্যার সাথে মনোবিজ্ঞানের সমাধানের জ্ঞানকে তুলনা করতে হবে।</p> <p>বর্তমানে হতাশা, বিরক্তি, সুইসাইড, উদ্বিগ্নতা খুবই সাধারণ কতগুলো শব্দ যার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। যখনই আমাদের কোনো বন্ধু, পরিবারের সদস্য, জুনিয়র বা সমবয়সী আমাদের সামনে এসে আমাদের সম্বোধন করে বলে আমি খুব হতাশ তখন সাথে সাথেই কিছু কমন কথা পাইকারীভাবে হাজির থাকে আমাদের। সেগুলো হলো, ‘আরে কিসের হতাশা, চিল কর মামা, জীবনে এমন হবেই, তুই একটু বেশিই ভেঙে পড়িস, ছেলে হয়ে এতো ভাঙলে হবে, মেয়েদের মত কাঁদিস কেন, বাদ দে, মুভ অন কর’।</p> <p>ভুক্তভোগীকে এসব আমরা ভাবি বঙ্কিমচন্দ্র বিড়াল প্রবন্ধের শেষ লাইনের মতো, ‘একটি পতিত আত্মাকে অন্ধকার হইতে আলোকে আনিয়াছি, ভাবিয়া কমলাকান্তের আনন্দ হইল।’</p> <p>কিন্তু যারা এত আনন্দিত হলো তাদের জন্য দুঃখ ভরা মন নিয়ে বলতে হয়, আপনাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তির মনে হতাশা বা বিষাদের দাবানলের সৃষ্টি করে। কারন দাবানলের সৃষ্টি হয় খুব সাধারণ আগুন থেকে। হতে পারে দুটি শুকনো পাতা বা গাছের কাণ্ড থেকে। যখন বাতাসের কারনে ক্রমাগত ঘষা লাগতে থাকে তখন একটি স্ফূলিঙ্গের সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে গোটা বনকে জ্বালিয়ে দেয়। ঠিক তেমনি আপনাদের এই কথাগুলো তার মনে দাবানলের সৃষ্টি করে ।</p> <p>তার অভ্যন্তরের স্বত্ত্বাকে পুড়িয়ে একটা আবেগহীন জীবন্মৃত স্বত্ত্বা তৈরি করে। তাই, এমন পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয় সেজন্য প্রতিটি মানুষেরই মনোবৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং একজন মানসিকভাবে ভেঙে পড়া মানুষের সামনে কীভাবে কথা বলা দরকার, কোন শব্দ বলা দরকার, তা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। আপনি তাকে তথাকথিত কথাগুলো শুনিয়ে দিলে সে যদি তা বুঝেই যেত, তাহলে সে আপনার কাছে এসে কষ্ট ব্যক্ত করতো না। আপনাকে প্রথমেই অনুধাবন করতে হবে, আপনার কাছে কথা বলতে আশা ব্যাক্তি মানসিকভাবে স্থিতিশীল নয় এবং তার বিচার বুদ্ধি কিছু সময়ের জন্য শিথিল হয়ে আছে।</p> <p>এ অবস্থায় আপনাকে তার মত করেই মিশতে হবে। স্রোতের টানে গা ভাসানো যাকে বলে। তার হীনমন্যতা দূর করতে হবে তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করতে হবে। প্রতিটা মানুষেরই অভ্যন্তরীণ শক্তি আছে, হতাশা এই শক্তিটাকে তার চাদরে মুড়িয়ে ফেলে।<br /> হতাশাগ্রস্ত মানুষের ক্ষেত্রে প্রথম কথা শোনানোর জন্য তাকে সচেতন মানসিক অবস্থায় আনতে হবে। যাতে তার অন্তর্দৃষ্টি সক্রিয় হয় তারপর কথাগুলো বলতে হবে যাতে সে অনুধাবন করতে পারে। কিন্তু আমরা তার মানসিক অস্থিতিশীলতা দূর না করেই কথা বলে যাই আর যখনই সে কথা অনুধাবণ করে না,  তখনই তাকে পাগল, বেশি বোঝে, ও এমনই, সুধরাবে না  ইত্যাদি বলে বেড়াই।</p> <p>লেখক:  শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ<br />  </p>