<p>মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পর এ ঘটনায় নানাভাবে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনের নাম আসে। মামলার গুরুত্বপূর্ণ দুই আসামির আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও তাঁর নাম আসে, যাতে এ হত্যাকাণ্ডে তাঁর সম্পৃক্ততারই ইঙ্গিত দেয়। গত শুক্রবার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অবশেষে গতকাল শনিবার রুহুল আমিনকে নুসরাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থাটি।</p> <p>এদিকে নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সময় এ হত্যা মামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসামি জোবায়ের যে বোরকা পরেছিল, সেটা উদ্ধার করেছে পিবিআই। আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত আরো দুজন। এ ছাড়া আরো দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।</p> <p>গ্রেপ্তার দেখানোর পর রিমান্ডে রুহুল আমিন : পুলিশ সদর দপ্তরের পাঠানো তদন্তদল গত বৃহস্পতিবার মাদরাসায় ডেকে নিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল আওয়ামী লীগ নেতা ও সদ্য বিলুপ্ত সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি রুহুল আমিনকে। ওই দিন ফেনীতে জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তিনি যোগ দেননি। ওই সভার পর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেছিলেন, নুসরাত হত্যা মামলায় রুহুল আমিনকে জড়িয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এর পরদিন শুক্রবার বিকেলেই সোনাগাজী পৌর সদরের তাকিয়া সড়কের বাসা থেকে তাঁকে আটক করে পিবিআই। তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তারা তখন বলেছিলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রুহুল আমিনকে আটক করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।</p> <p>শেষ পর্যন্ত রুহুল আমিনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আদালতে সোপর্দ করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক মো. শাহ আলম। শুনানি শেষে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচার বিভাগীয় হাকিম শরাফ উদ্দিন আহমেদ পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহ আলম কালের কণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।</p> <p>গত ৬ এপ্রিল পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় গেলে আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে কৌশলে মাদরাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে গায়ের কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয় কয়েকজন। গত ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। আগুন দেওয়ার পর থেকেই নানাভাবে অভিযোগের আঙুল ওঠে বিতর্কিত আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের দিকে। নুসরাতের পরিবার শুরু থেকেই বলে আসছিল রুহুল আমিনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।</p> <p>এ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত পাঁচজনসহ এ পর্যন্ত অন্তত ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুই ছাত্রীও রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের মধ্যে আটজনের নাম আছে মামলার এজাহারে। ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে সাতজন।</p> <p>মামলার গুরুত্বপূর্ণ দুই আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম গত রবিবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে বলেছে, জেলে বসে নুসরাতকে হত্যার নির্দেশ দেন মাদরাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা। এরপর পরিকল্পনা করে তারা নুসরাতকে হত্যা করে।</p> <p>শামীম তার জবানবন্দিতে জানায়, নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর দৌড়ে নিচে নেমে উত্তর দিকের প্রাচীর টপকে বের হয়ে যায় সে। এরপর মোবাইল ফোনে বিষয়টি রুহুল আমিনকে জানায়। রুহুল আমিন তাকে বলেন, ‘আমি জানি। তোমরা সরে যাও।’ শামীমের সঙ্গে তাঁর ছয় সেকেন্ডের এ কথোপকথনের সত্যতা পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা।</p> <p>নুসরাতের পরিবার বলেছে, গত ২৭ মার্চ নুসরাতকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানির পর মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ রুহুল আমিনের কথা বলেই তাদের হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু নুসরাতের মায়ের করা মামলায় ওই দিন সিরাজকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ‘অধ্যক্ষ মুক্তি পরিষদ’ গঠন করে সিরাজের অনুসারীরা আন্দোলন শুরু করে। এতে ইন্ধন দেন রুহুল আমিন ও সোনাগাজী আওয়ামী লীগের আরেক নেতা ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলম। নুসরাতের পরিবার বলছে, সিরাজের পক্ষে যারা মানববন্ধন করেছে তাদের ব্যাপারেও কোনো ব্যবস্থা নেননি রুহুল আমিন। এর মধ্যে মাকসুদকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।</p> <p>আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য ও জবানবন্দি অনুযায়ী, সিরাজের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিতে রাজি না হওয়ায় নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় তাঁর অনুসারীরা। এর আগে ৪ এপ্রিল রাতে মাদারাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক ও ওই মাদরাসার ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাফেজ আব্দুল কাদেরের কক্ষে ১২ জনের বৈঠকে নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। সে বৈঠকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী, সিরাজের ভায়রার মেয়ে উম্মে সুলতানা পপি ঘটনার দিন শম্পা ছদ্ম নামে পরীক্ষার হল থেকে নুসরাতকে কৌশলে ডেকে নিয়ে যায়। ছাদে নেওয়ার পর শামীম, জোবায়ের, জাবেদ ও কামরুন নাহার মণি আগুন ধরিয়ে দেয় নুসরাতের শরীরে। তাদের সবাই বোরকা ও নেকাব পরা ছিল।</p> <p>মণি ও জাবেদের জবানবন্দি : হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া মামলার আসামি জাবেদ হোসেন ও কামরুন নাহার মণি গতকাল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। গত রাতে তাদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচার বিভাগীয় হাকিম শরাফ উদ্দিন আহমেদ। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।</p> <p>পিবিআই সূত্র জানায়, মণি ঘটনার দিন আগেই মাদরাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে অপেক্ষায় ছিল। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত তিনটি বোরকা সে সংগ্রহ করে এবং হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়। মামলার আরেক আসামি শামীম বোরকা কিনতে তাকে পপির মাধ্যমে দুই হাজার টাকা দেয়। ওই টাকায় তিনটি বোরকা ও তিন জোড়া হাতমোজা কেনা হয়। মণি জবানবন্দিতে বলেছে, নুসরাতের শরীরে আগুন দেওয়ার আগে সে তাকে মেঝেতে শুইয়ে চেপে ধরে। জাবেদ আগে থেকে বোরকা পরে ছাদে অবস্থান নেয় এবং নুসরাতের গায়ে আগুন দেয় বলে এর আগে শামীমের জবানবন্দিতে উঠে আসে।</p> <p>হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বোরকা উদ্ধার : নুসরাত হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৫ নম্বর আসামি রিমান্ডে থাকা জোবায়ের আহমেদ ওরফে সাইফুর রহমান জোবায়েরকে নিয়ে গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে আসে পিবিআই। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সোনাগাজী সরকারি কলেজের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের ডাঙ্গিখাল থেকে কালো রঙের পরিত্যক্ত বোরকাটি উদ্ধার করা হয়।</p> <p>মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক শাহ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, নুসরাত হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার জোবায়েরকে বুধবার পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই বোরকাটি উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পর সে তার পরনে থাকা বোরকা খুলে ডাঙ্গিখালে ফেলে যায়। তিনি আরো জানান, জোবায়েরসহ তিন ছাত্র বোরকা পরা অবস্থায় ছিল। বাকি দুজন ছিল ছাত্রী। তাদের মধ্যে একজন হলো পপি, অন্যজন মণি। জোবায়ের মাদরাসার ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সে তুলাতলী গ্রামের বাসিন্দা এবং সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী আবুল বশরের ছেলে।</p> <p>পরিকল্পনাকারী রানা ও পাহারায় থাকা মামুন গ্রেপ্তার : নুসরাত হত্যার পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম ইফতেখার উদ্দিন রানাকে (২১) গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পিবিআই। সংস্থার চট্টগ্রাম নগর অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈনউদ্দিন জানান, গতকাল ভোরের দিকে রাঙামাটি সদরের টিঅ্যান্ডটি আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সোনাগাজী পৌরসভার চরগণেশ এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে।</p> <p>মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহ আলম রানাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।</p> <p>এদিকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ইমরান হোসেন মামুন (২০) নামের আরেকজনকে। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সময় সে মাদরাসার ফটকে হাফেজ কাদেরের সঙ্গে পাহারায় ছিল। কাদেরের জবানবন্দিতে তার নাম এসেছে। রানা ওই মাদরাসা থেকে আলিম পাস করে এখন ফেনী সরকারি কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষে পড়ছে। সেও চরগণেশ এলাকার বাসিন্দা।</p> <p>রানাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার মা নেহার বেগম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, পিবিআই তাঁদের ফোন করে ছেলেকে আটকের বিষয়টি জানিয়েছে। তাঁদের বলা হয়েছে, কুমিল্লার পদুয়ার বাজারে ঢাকা থেকে ফেনীমুখী স্টার লাইন পরিবহনের একটি বাসে তল্লাশি চালিয়ে রানাকে আটক করা হয়েছে।</p> <p>সুবিচার পেতে আশাবাদী নুসরাতের পরিবার : শুক্রবার রুহুল আমিনকে আটকের পর নুসরাত হত্যা মামলার বাদী তার বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এখন প্রবলভাবে আশাবাদী, আমরা আমাদের বোনের হত্যার সুবিচার পাব।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তিনি প্রমাণ করেছেন অপরাধী দলের হলেও তাদের কোনো ছাড় নেই। অপরাধী যত শক্তিশালী হোক না কেন তাদের আইনের আওতায় আসতে হবে।’ একই রকম আশাবাদী নুসরাতের ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হানও।</p> <p>নুসরাতের বাবা এ কে এম মুসা বলেন, ‘সারাক্ষণ বুকের ভেতর প্রচণ্ড কষ্টের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। আমি আমার মেয়ের হত্যাকারীদের বিচার চাই, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। পাশাপাশি এটিও বলতে চাই, এমন দুর্বিষহ ঘটনা যেন আর কোনো পরিবারের ওপর নেমে না আসে।’</p> <p>স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও জনপ্রতিনিধি বলেছেন, জামায়াতের সাবেক নেতা সিরাজের মূল খুঁটির জোর ছিলেন রুহুল আমিন।</p> <p>জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রহমান (বিকম) বলেন, ‘নুসরাতের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা শোকাহত। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় কাউন্সিলর মাকসুদ আলমকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রুহুল আমিনের ব্যাপারেও অনেকে বলছে। প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’</p> <p>বিক্ষোভ-মিলাদ : গতকাল সোনাগাজীর ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা নুসরাত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে মানববন্ধন করেছে। উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের বহদ্দারহাটে এ কর্মসূচি পালিত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হলো আজিজুল হক-মায়মুনারা উচ্চ বিদ্যালয়, আল জামিয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা, পূর্ব চরচান্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আফসার উদ্দিন মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ-পূর্ব চরচান্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তালিমুল কুরআন সিদ্দিকিয়া মাদরাসা। এ ছাড়া সকালে আল-হেলাল একাডেমি নুসরাতের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল করেছে।</p>