<article> <p style="text-align: justify;">দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ডলার সংকট বিরাজ করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একসময়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছালেও, তা এই সংকটের কারণে হ্রাস পেয়ে ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছে বিরাজ করছে। ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতনের পর এখন ১১০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। এই ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">বর্তমান গভর্নর মার্চের মধ্যে ডলার সংকট কেটে যাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাবে মর্মে আশার বাণীও শুনিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ডলার সংকট কেটে গেছে—এমন দাবি যেমন করা যাবে না, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে বৃদ্ধি পায়নি, তা তো দৃশ্যমান। আসলে এবারের ডলার সংকট সমাধানের উপায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের হাতে নেই।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কেননা এই সংকটের কারণ বিশ্বব্যাপী মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ সুদের হার এবং ডলার শক্তিশালী হয়ে ওঠা। সম্প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের ধনী দেশগুলো তাদের সুদের হার হ্রাস শুরু করবে মর্মে বাজারে জোরালো আলোচনা ছিল। কিন্তু সব ধনী দেশই তাকিয়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করার সিদ্ধান্ত বিলম্বিত করেছে, তাই অন্য দেশগুলোও সেটাই অনুসরণ করছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;"><img alt="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/05.May/07-05-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpg" height="342" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/05.May/07-05-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpg" width="400" />উচ্চ সুদের হার, মূল্যস্ফীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মক এক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে বলেই প্রতীয়মান হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এখন বেকারত্বের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে এবং নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় চাকরির বাজার বেশ চড়া। যুক্তরাষ্ট্রের দাপ্তরিক হিসাব অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি তাদের কাঙ্ক্ষিত ২ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রায় না নেমে এলেও অফিশিয়াল মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২.৮ শতাংশ। অবশ্য এই অফিশিয়াল মূল্যস্ফীতির হার হিসাবের মধ্যে কিছু শুভংকরের ফাঁকি আছে। কেননা এখানে অতি মূল্য সংবেদনশীল পণ্য, অর্থাৎ যেসব পণ্যের মূল্য মাত্রাতিরিক্ত ওঠানামা করে, সেসব পণ্য মূল্যস্ফীতি হিসাব করার ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতি সুদ হার বা বেঞ্চমার্ক রেট হ্রাস করা শুরু করবে মর্মে বাজারে বদ্ধমূল ধারণা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ফেডারেল রিজার্ভ তাদের রেট-কাটের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। এরই মধ্যে নতুন করে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে এ বছর ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় তৈরি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে আগামী আরো কিছুদিন ডলার হার্ড কারেন্সি (প্রকট চাহিদার মুদ্রা) হিসেবেই বিরাজ করবে। ফলে যেসব দেশ আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় ডলারের ওপর নির্ভরশীল, তাদের ডলার সংকট যে আরো কিছুদিন অব্যাহত থাকবে, তা খুব সহজেই অনুমেয়।</p> <p style="text-align: justify;">যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার এবং ডলারের বিনিময় মূল্যের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে উচ্চ সুদের হারের সময় ডলারের বিনিময় মূল্যও অনেক বেশি থাকে। বিপরীত অবস্থা ঘটে কম সুদের হারের সময়। এ কারণেই দেখা যায় যে যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে ডলারও হার্ড কারেন্সিতে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে ফেডারেল রিজার্ভ যখন সুদের হার হ্রাস করতে থাকে, তখন ডলারও দুর্বল হতে থাকে। টানা দুই বছর যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ সুদের হারের কারণে ডলার শক্ত অবস্থানে থাকার পর এবারই দুর্বল হওয়ার এক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, যখন মার্কেটে জোর আলোচনা ছিল যে ফেডারেল রিজার্ভ চলতি বছর কমপক্ষে চারবার তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করবে। তাদের এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার কথা ছিল গত মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটি বা নীতি সুদ হার নির্ধারণ কমিটির সভায়। কিন্তু রেট-কাটের ব্যাপারে যথেষ্ট সম্ভাবনা এবং আশাবাদ থাকা সত্ত্বেও সেই কমিটির সভায় সুদহার হ্রাসের ব্যাপারে কোনো রকম সিদ্ধান্ত হয়নি। এই কমিটির পরবর্তী সভা আগামী জুনে অনুষ্ঠিত হবে এবং তখনো রেট-কাটের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ হয়ে গেছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। প্রথম দিকে অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক বিশ্লেষকরা অনুমান করেছিলেন যে এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদ হার কম করে হলেও চারবারে ১ থেকে ১.৫০ শতাংশ হ্রাস পাবে। এখন তারা তাদের পূর্বাভাস বা বিশ্লেষণ পুনর্নির্ধারণ করে মাত্র ০.৬২ শতাংশ হবে বলে ধারণা দিতে শুরু করেছে। এমনকি ফেডারেল রিজার্ভ যদি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চলতি বছরে কোনো রকম সুদহার হ্রাসের সিদ্ধান্ত না নেয়, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।</p> <p style="text-align: justify;">অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির পুনরায় ঊর্ধ্বগতি ফেডারেল রিজার্ভকে আরো কিছুদিন উচ্চ সুদের হার বহাল রাখতে বাধ্য করবে। এর ফলে উচ্চ সুদের হার এবং ডলারের মধ্যকার যে অবস্থা, তা ২০২২ সালের পূর্বাবস্থায় বিরাজ করবে আরো অনেক দিন। যে ডি-এক্স-ওয়াই ডলার ইনডেক্সের (DXY Dollar Index) মাধ্যমে নির্ধারিত কিছু আন্তর্জাতিক মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মূল্য পরিমাপ করা হয়ে থাকে, সেই ইনডেক্স ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ  ৯৮.৮৪ হতে পারে এবং ৯৭.৮৪ হতে পারে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ। অথচ বছরের শুরুতে এই ডি-এক্স-ওয়াই ডলার ইনডেক্স ছিল ১০৪.২৯, যা ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার হ্রাসের প্রত্যাশায় সর্বোচ্চ ১০৫.১০ পর্যন্ত উঠেছিল গত এপ্রিলের শুরুতে। উল্লেখ্য, এই ডি-এক্স-ওয়াই ডলার ইনডেক্স বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে ডলার দুর্বল হবে, অন্যান্য মুদ্রা শক্তিশালী হবে। ঠিক বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ ডলার শক্তিশালী হয় এবং অন্যান্য মুদ্রা দুর্বল হয়, যখন এই ডি-এক্স-ওয়াই ডলার ইনডেক্স কমতে থাকে।</p> <p style="text-align: justify;">এর বাইরে আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় আছে, তা হছে যুক্তরাষ্ট্রে হাস্যোজ্জ্বল ডলার তত্ত্ব (Dollar Smiling Theory), যার অর্থ হচ্ছে ডলার শক্তিশালী হয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সময় অথবা আর্থিক অনিশ্চয়তার সময়, কিন্তু দুর্বল হয় তখনই, যখন অর্থনীতি মধ্যম প্রবৃদ্ধির পর্যায়ে থাকে। এত সব কিছু ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ তাদের নীতি সুদ হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি বিখ্যাত সূত্র,  টেইলরবিধি (Taylor Rule) প্রয়োগ করে থাকে। এই টেইলরবিধি হচ্ছে এমন একটি সমীকরণ, যেখানে বেকারত্ব এবং মূল্যস্ফীতির ওপর ভিত্তি করে উপযুক্ত সুদের হার নির্ণয় করা হয়। ফেডারেল রিজার্ভ তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস-বৃদ্ধির সময় এই টেইলরবিধি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে থাকে। এই রুল অনুযায়ী সুদের হার বাড়ানোর কথা ছিল ২০২১ সালের শুরু থেকেই, কিন্তু ফেডারেল রিজার্ভ সেটি না করে প্রায় এক বছর অপেক্ষার পর তাদের নীতি সুদ হার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কার্যকর করে। ফলে এই টেইলরবিধি অনুযায়ী যে সুদের হার বিরাজ করার কথা ছিল, সেখান থেকে ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদ হার অনেক পিছিয়ে থাকে। আর এটিকে কাভার করতে গিয়ে ফেডারেল রিজার্ভকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় এক ডজনেরও অধিকবার সুদের হার বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ ৫.৫০ শতাংশ করতে হয়, যা এককথায় নজিরবিহীন। অল্প সময়ের ব্যবধানে ব্যাপক সুদের হার বৃদ্ধির কারণে জনগণকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় এবং ফেডারেল রিজার্ভকেও যথেষ্ট সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়।</p> <p style="text-align: justify;">এদিকে আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড) ধনী দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তাদের নীতি সুদ হার এত দ্রুত হ্রাস করার বিপক্ষে মত দিয়েছে। আইএমএফের গত বসন্ত সভায় সুদহার হ্রাসের বিষয় নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে এবং দ্রুত সুদহার হ্রাস না করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন যে সুদের হার হ্রাসের যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তার ফাঁদে পা দেওয়া মোটেই সমীচীন হবে না। ক্রিস্টালিনার মতে, সঠিক সময়ের আগে সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিলে এর সুফল তো পাওয়া যাবেই না, উল্টো হিতে বিপরীত হতে পারে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি পুনরায় বেড়ে যেতে পারে এবং সে রকমটা হলে পরিস্থিতি তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এ কারণেই আইএমএফের প্রধান আপাতত সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে এর উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিয়েছেন।</p> <p style="text-align: justify;">যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া, যেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার হ্রাস করে, সেগুলোর ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হতে না পারা এবং সর্বোপরি আইএমএফের সুপারিশের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার এ বছর হ্রাস হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। যেহেতু আগামী নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন, তাই তার আগ দিয়ে হয়তো সুদের হার হ্রাস শুরু হতে পারে এবং আগামী বছর হয়তো নিয়মিত বিরতি দিয়ে অব্যাহত থাকতে পারে। তেমনটি হলে এর প্রভাব যে তাৎক্ষণিক পড়বে তেমন নয়। এ বছর যদি সুদের হার হ্রাস শুরু হয়ে অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী বছরের শেষে গিয়ে এর প্রভাব কিছুটা বোঝা যাবে। তাই আরো বছর দুয়েক যে দেশে ডলার সংকট অব্যাহত থাকবে, তা আর বুঝতে কারো বাকি নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুই বছর বসে থাকা ঠিক হবে কি না। মোটেই না। দেশের ডলার সরবরাহ বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব ব্যতিক্রমী পদক্ষেপের বিষয় সম্পর্কে যাঁদের ভালো ধারণা আছে এবং যাঁরা এগুলো নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত দ্রুত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই আরো দুই বছর বা তারও বেশি সময় এই ডলার সংকট নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। সেই সঙ্গে দেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মানুষের জীবনযাত্রা সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক : </strong>সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</p> <p style="text-align: justify;">nironjankumar_roy@yahoo.com</p> </article>