<article> <p style="text-align: justify;">ভারতে অষ্টাদশতম জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারত। জনসংখ্যার নিরিখে এটি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। এ দেশের চরিত্র অভিমুখ, গন্তব্য বহুমুখী ও জটিল।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">১৯ এপ্রিল ভারতের বেশ কিছু প্রান্তে প্রথম ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ এলাকায় ছিল তিনটি লোকসভা কেন্দ্রের ভোট। এরপর আসছে ২৬ এপ্রিল দ্বিতীয় দফার ভোট। এভাবে ধাপে ধাপে সাত দফায় ভারতের ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২৬ এপ্রিলের পর ৭ মে, ১৩ মে, ২০ মে, ২৫ মে, ১ জুন এবং সব শেষে ৪ জুন হবে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">১৯৫২ সাল থেকে এই বিশালকায় দেশে বিস্ময়কর দক্ষতার সঙ্গে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। কিন্তু ২০২৪-এর এই লোকসভা নির্বাচন নানা দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এবার এই নির্বাচনে প্রশ্ন উঠেছে যে এবারের নির্বাচন বুঝিয়ে দেবে ভারতে নির্বাচনী গণতন্ত্র থাকবে, নাকি ক্রমেই নির্বাচনী গণতন্ত্র নির্বাচনী একনায়কতন্ত্রে পরিণত হবে? সুইডেনের গুটেনবার্গের খ্যাতনামা গণতন্ত্র নজরদারি প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারত এখন বিশ্বের সংকটময় একনায়কতন্ত্র। গোটা পৃথিবীর প্রতীক্ষা ২০২৪-এর ভোটের ফলাফল জানতে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদি আবার ফিরে আসবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা ২০১৯ সালে যা ছিল, ২০২৪ সালে তার থেকে কম হতে পারে। কিন্তু সংখ্যা কমে গেলেও নরেন্দ্র মোদির সংখ্যাগরিষ্ঠতা যে থাকবে এবং সরকার যে বিজেপিরই হবে—এটি নিয়ে সাধারণভাবে অন্য ধারণা নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশের ভোট এই বছরেই হচ্ছে। প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ ভোটে অংশ নেবে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু সুকুমার সেনের মতো একজন বাঙালিকে প্রথম নির্বাচন কমিশনার পদে নিযুক্ত করেন। ভারত নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভকে কার্যকর করার দায়িত্বটি তিনি পেয়েছিলেন। নেহরু চেয়েছিলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভোট হোক। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র চালু হলো। কয়েক মাসের মধ্যেই যাতে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশরা চলে গেছে। তখন স্বাধীনভাবে একটি দেশের লোকসভা নির্বাচন করা, কাজটি সহজ ছিল না। সুকুমার সেন আরো সময় চাইলেন। ১৯৫১ সাল থেকে শুরু হলো আধুনিক গণতান্ত্রিক ভারতের পথচলা। আজ ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, আমরা গণতন্ত্রের একটি বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছি। আগামী দিনে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান, বাকস্বাধীনতা, বহুত্ববাদ—এসব কী পরিণতি পাবে, সেটি দেখার জন্য নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর এটিই বোধ হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হতে চলেছে। কারণ এবারের নির্বাচনে তরুণ প্রজন্মের ভোটাররাও একটি বিপুল অংশে প্রতিনিধিত্ব করছেন। বহু তরুণ নেতা এবারের ভোট পরিচালনার কাণ্ডারি। যেমন—সোনিয়া গান্ধী নন, তাঁর পুত্র রাহুল গান্ধী। লালুপ্রসাদ যাদব নন, তাঁর পুত্র তেজস্বী যাদব। মুলায়ম সিং যাদব নন, প্রয়াত মুলায়ম যাদবের পুত্র অখিলেশ যাদব। ফারুখ আবদুল্লা নন, তাঁর পুত্র ওমর আবদুল্লা। এভাবে দেখতে গেলে একঝাঁক তরুণ-নবীন প্রজন্ম কিন্তু এবারের ভোট পরিচালনা করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে এই নবীন প্রজন্মের নেতৃত্ব এখনো অনেক দুর্বল। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন ইন্ডিয়া জোটে কংগ্রেসের সঙ্গে থাকলেও তাঁর বয়স কিন্তু ৭০-এর ওপর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তো নবীন প্রজন্মের নেতা বলা যায় না। তিনি সাতবার লোকসভায় জয়ী সংসদ সদস্য ছিলেন। তারপর তিনি মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছেন। বরং তৃণমূল কংগ্রেসের নবীন প্রজন্মের দায়িত্ব নিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।</p> <p style="text-align: justify;">এভাবে একটি নতুন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভারতের গণতন্ত্র চলেছে। তবে এবারের নির্বাচনে একটি শঙ্কাজনক ঘটনা হলো, ১৮ বছর বয়সে যাঁরা নতুন ভোটার, সেই বিপুল জনসংখ্যার মাত্র ৩৮ শতাংশ নিজেদের ভোটার হিসেবে রেজিস্ট্রিভুক্ত করেছে। বাকি প্রায় ৬২ শতাংশ নতুন ভোটার নিজেদের রেজিস্ট্রিভুক্ত করেননি। এই ঘটনা নিয়ে নির্বাচনী বিশেষজ্ঞরা ভারতে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। কেননা এই ধারণা প্রতিপন্ন হচ্ছে যে নতুন প্রজন্ম ভোট নিয়ে যথেষ্ট বোর হয়ে গেছে। তারা বিরক্ত। তাদের কাছে এই নির্বাচন মানেই হিংসা, রাজনৈতিক দলাদলি, কুবাক্য প্রয়োগ, রিগিং, একটি রক্তক্ষয়ী হিংসা। এসব তাদের পছন্দ নয়। তাদের মনে হচ্ছে যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাতে শ্রেণি চরিত্রে কোনো বদল হবে না। শাসকের চরিত্র বদল হবে না।</p> <p style="text-align: justify;">প্রথম কিস্তির ভোটটা একদম ভারতের উত্তর প্রান্তে উধমপুর থেকে দক্ষিণের কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রথম যে নির্বাচনটি হলো, তার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল তামিলনাড়ু রাজ্য। তামিলনাড়ু রাজ্যে ৩৯টি লোকসভা আসন আছে। বহু আসনে হাই ভোল্টেজ ত্রিপক্ষীয় লড়াই হয়েছে, যেখানে ডিএমকের মতো আঞ্চলিক দল শক্তিশালী। এবারও অন্য আঞ্চলিক দল জয়ললিতার এডিএমকে থেকে ডিএমকের রমরমা বেশি। বিজেপির সঙ্গে এডিএমকের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন ভীষণভাবে মোদি এবং বিজেপির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন। তিনি মোদিকে ফ্যাসিস্ট বলে অভিহিত করছেন। এডিএমকে তামিলনাড়ুতে ২০১৯ সালে ৩৯টি আসনের মধ্যে ৩৮টি আসন পেয়েছে। এবার বিজেপি চেষ্টা করছে স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে অ্যান্টি ইনকমবেন্সিকে কাজে লাগিয়ে একটি সিরিয়াস লড়াই লড়ে কিছুটা আসন যাতে করায়ত্ত করা যায়। একইভাবে রাজস্থান, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড—এসব স্থানেও অনেকগুলো আসনে লোকসভা নির্বাচন হয়ে গেল। এই এলাকায় বিজেপি খুব বেশি ভালো ফল করবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে হিন্দি বলয়ের একটি বিরাট অংশ, যেখানে বিজেপি প্রতিনিধিত্ব করছে, সেখানে কিন্তু এখনো ভোটপর্ব বাকি আছে। </p> <p style="text-align: justify;">প্রথম দিনের ভোটপর্বে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দুটি রাজ্য অরুণাচল ও সিকিম রয়েছে। এই দুটি রাজ্যে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন একই সঙ্গে হয়। জম্মু-কাশ্মীরেও ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত হওয়ার পর প্রথম লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে। বিজেপি ও কংগ্রেস উধমপুরে সরাসরি লড়েছে। তবে বেশির ভাগ নির্বাচনী সমীক্ষা বলছে, কমবেশি যা-ই তফাত থাকুক, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসবেন। কিন্তু নির্বাচনী সমীক্ষা যেটি বলছে, সেটিই চূড়ান্ত ঘোষণা, এটি তো বলা যায় না। ভোটের ফলাফলের জন্য বরং ৪ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভালো, যখন নির্বাচন কমিশন ভোটের ফলাফল ঘোষণা করবে। এমনকি ভোটের পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরে যখন এগজিট পোল হবে, যাকে বলে বুথফেরত সমীক্ষা, সেটিও সব সময় কিন্তু মেলে না।</p> <p style="text-align: justify;">অনেকে বলছে, মোদি চার শর বেশি আসন পাবেন বলে সংসদে যেটি বলেছেন, সেটি একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। সেটি যে সম্ভব নয়, সেটি মোদিও জানেন। কেননা মোদির বিরুদ্ধে কিন্তু বিভিন্ন আঞ্চলিক দলও বিরাটভাবে প্রচার করছে। এনফোর্সমেন্ট, সিবিআইয়ের যে তদন্ত, সেটিও এই আঞ্চলিক দলগুলোকে আরো মোদিবিরোধী করে তুলেছে। তৃণমূল কংগ্রেস থেকে শুরু করে এআইএডিএমকে, ডিএমকে, বিজেডি, ভারত রাষ্ট্র সমিতি, শিবসেনা, শারদ পাওয়ারের এনসিপি, কেজরিওয়ালের আপ—এই আঞ্চলিক দলগুলো কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে মোদি এবং বিজেপির বিরুদ্ধে সক্রিয়। বিশেষ করে কেজরিওয়ালকে জেলে নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতায় কিছুটা একাট্টা হয়েছে বিরোধী দলগুলো। এই জেলে যাওয়ার ফলে একটি ভিকটিম মর্যাদা কেজরিওয়াল পাবেন কি না এখন, তার ভিত্তিতে ভোটাভুটিতে তার প্রভাব পড়বে কি না, সেটিও একটি মস্ত বড় প্রশ্ন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ভোটের শরিকদের মধ্যে ভোট স্থানান্তর কতটা সম্ভব? যেমন—সমাজবাদী পার্টি আর কংগ্রেসের মধ্যে জোট হয়নি। মহারাষ্ট্রে উদ্ভবের একটি হিন্দু ভোট ব্যাংক কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দেবে কি না। শারদ পাওয়ার এবং কংগ্রেসের মধ্যেও টেনশন আছে। তাহলে ভোটটি কি জোটের ভোট হবে, নাকি হবে না—সেটিও একটি মস্ত বড় বিষয়।</p> <p style="text-align: justify;">একটি রাজ্যের ভেতরেও বিভিন্ন এলাকার মধ্যে নানা রকম ভোট হয়। নাগরিকত্ব বিলের প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে যে রকমভাবে প্রভাব পড়েছে, হিন্দি বলয়ে তা নয়। হিন্দি বলয়ে এটি বিলের পক্ষে যেতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আবার যেখানে মুসলমান সংখ্যালঘুর একটি বিরাট সমাজ আছে, তারা কিভাবে এই আইনকে দেখবে, এর জন্য বিজেপিবিরোধিতা তীব্র হবে কি না, সেটিও একটি বিরাট বিচার্য বিষয়। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের দিনটিতে আর যা-ই হোক, হিংসার প্রকোপ যেন না হয়। ভোট শান্তিপূর্ণ হোক, ভোটে অশান্তি না হোক, এটি প্রত্যেক ভারতবাসীর একমাত্র কাম্য।</p> <p style="text-align: justify;">প্রথম দফায় ভোটের প্রচার শেষ হয়েছিল যেদিন, সেদিন ছিল ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব রাম নবমী। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি রাম নবমীকে কেন্দ্র করে রামমন্দির ঘিরে একটি আবেগ তৈরি করতে চেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বিহার, পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক জনসভায় মনে করিয়ে দিয়েছেন রাম নবমীর রাজনীতির কথা। তিনি এটিও বলেছেন, এই প্রথম অযোধ্যায় রামমন্দিরে রামলালার দর্শন পাওয়া গেল। রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে গরহাজির থাকার জন্য বিরোধী জোটকেও তিনি দুষেছেন। অবশ্য কংগ্রেস তথা বিরোধী মঞ্চ ইন্ডিয়া মনে করছে, রাম ইস্যু নিয়ে সে রকম কোনো হাওয়া তৈরি হয়নি।</p> <p style="text-align: justify;">একটি কথা মানতেই হবে, বিজেপির পক্ষে যদি হাওয়া তৈরি না-ও হয়, মোদি সরকারের পক্ষে যদি হাওয়া না ওঠে, তার বিরুদ্ধ হাওয়াও তেমন একটা তৈরি হয়নি। বিরোধীরা কিন্তু বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, মহিলাদের ওপর নির্যাতন—এসব ইস্যু নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী জনমত তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। ভোটের ফলাফল কী হবে, জানি না। কিন্তু বিরোধীরা একটি নির্বাচনী ইস্যু তৈরি করবে, গোটা দেশে যে একটি আন্দোলন হবে সরকারের বিরুদ্ধে, সেটিও কিন্তু ২০২৪-এর আগে দেখা গেল না।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক : </strong>নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি</p> </article>