<p style="text-align: justify;">চলচ্চিত্র এক শক্তিশালী গণমাধ্যম। বিশ্বব্যাপী মানুষের অবচেতনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে তা। মূলধারার চলচ্চিত্রে নারীকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই ছকে উপস্থাপন করা হয়। ঘর সামলানো, মাতৃত্বের জন্য আত্মত্যাগ আর প্রেম ও যৌনতাঘটিত বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করে নারীকে উপস্থিত করা হয় পর্দায়। মোটের ওপর নারীকে তুলে ধরা হয় কামনা-বাসনার বস্তু হিসেবে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।</p> <p style="text-align: justify;">২২তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের দ্বিতীয় দিনে আয়োজিত ‘চলচ্চিত্রে নারী’ বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উঠে এসেছে এসব কথা। দুই দিনের এই সম্মেলনের গতকাল রবিবার ছিল প্রথম দিন।</p> <p style="text-align: justify;">এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনটি আলোচনা পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, এখনো নারীর শরীরী আবেদন ব্যবহার করে দর্শক টানাই বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রধান প্রবণতা। তবে সব দেশেই স্বাধীন ধারার নির্মাতারা মানুষ হিসেবে নারীর সম্ভাবনাকেও চলচ্চিত্রে দেখাচ্ছেন।</p> <p style="text-align: justify;">গতকাল সকালে মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে ‘টেনথ ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন উইমেন ইন সিনেমা ২০২৪’ শীর্ষক আয়োজনের উদ্বোধন করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর।</p> <p style="text-align: justify;">রাজধানীর ঢাকা ক্লাবের স্যামসন লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চলচ্চিত্র উৎসবের চেয়ারপারসন অধ্যাপক কিশওয়ার কামাল। আয়োজক প্রতিষ্ঠান রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির প্রেসিডেন্ট আহমেদ মুজতবা জামালের সঞ্চালনায় এতে উপস্থিত ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম। এ সময় আলোচনায় অংশ নেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন স্টাডিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জুনায়েদ হালিম।</p> <p style="text-align: justify;">সম্মেলনের উদ্বোধন-পরবর্তী বক্তব্যে শর্মিলা ঠাকুর বলেন, বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের কিছু জায়গা আছে, যেখানে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষদের সুযোগ বেশি। যেমন—মারামারি বা লাফঝাঁপের দৃশ্যে পুরুষরাই থাকে। তার পরও এই অঞ্চলের বহু নারী অভিনেত্রী এখন তারকা অভিনেতার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়।</p> <p style="text-align: justify;">মাত্র ১৩ বছর বয়সে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’-এ অভিনয় করে নজর কাড়া শর্মিলা ঠাকুর ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা চলচ্চিত্রের একজন নেতৃস্থানীয় অভিনেত্রী। অনন্য অভিনয়, স্টাইল ও ব্যক্তিত্বের জন্য অনেক অভিনেত্রীর আইকন এই অভিনয়শিল্পী ২০১৩ সালে পেয়েছেন ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ।</p> <p style="text-align: justify;">হাল আমলে অনলাইনে চলচ্চিত্র উপভোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ওটিটি সম্পর্কেও গতকাল ছোট্ট মন্তব্য করেন শর্মিলা ঠাকুর। তিনি বলেন, চলচ্চিত্র ও মঞ্চ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এখন ভারতসহ সারা বিশ্বেই ওটিটি প্ল্যাটফরম ব্যাপকভাবে প্রসারিত হচ্ছে। সেখানেও নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।</p> <p style="text-align: justify;">উদ্বোধন পর্বের পর চা-বিরতি দিয়ে সকাল ১১টা থেকে শুরু হয় সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন। এতে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক সাদেকা হালিম। এতে ‘নেভিগেটিং ডুয়াল আইডেনটিটি: অ্যান এক্সপ্লোরেশন অব ইন্টারসেকশনালিটি ইন মাদারহুড অ্যান্ড ফিল্মমেকিং’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের গণযোগাযোগ ও ভিডিওগ্রাফি বিভাগের প্রধান ড. ইপ্সিতা বারাত। প্রবন্ধটির ওপর আলোচনায় অংশ নেন নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এজেকে গণযোগাযোগ গবেষণা কেন্দ্র’-এর সাজ্জাদ জহির, অধ্যাপক ড. সোহিনী ঘোষ, লেখক, অনুবাদক ও শিল্প সমালোচক আলম খোরশেদ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাতেমা আমিন।</p> <p style="text-align: justify;">প্রবন্ধকার ফারাহ খান, অপর্ণা সেন, কঙ্কণা সেনশর্মা, নন্দিতা দাস এবং কিরণ রাওয়ের মাতৃত্ব ও পেশাগত জীবনের দ্বৈত অবস্থার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন ভারতের নারী চলচ্চিত্র নির্মাতারা, মাতৃত্বের দায়িত্ব নিয়ে পেশাগত জীবনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। গবেষক দেখিয়েছেন, পুরুষের কর্তৃত্বে থাকা চলচ্চিত্রজগতে কাজ করতে গিয়ে নারীরা এখনো অপরাধ বোধ, সামাজিক প্রত্যাশা আর পারিবারিক ও পেশাগত জীবনের ভারসাম্য রক্ষার জটিল সমস্যার ভেতর পড়ে যান।</p> <p style="text-align: justify;">প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে আলম খোরশেদ বলেন, যেসব নারী নির্মাতার সাংসারিক জীবনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, প্রবন্ধকার বেছে বেছে তাঁদেরকেই উদাহরণ হিসেবে নিয়েছেন। ভবিষ্যতের তরুণ নির্মাতাদের উৎসাহব্যঞ্জক নমুনা নেই।</p> <p style="text-align: justify;">অধ্যাপক ড. সোহিনী ঘোষ বলেন, মানুষ নারীদের নিজেদের মতো সাধারণ ব্যক্তি হিসেবে না দেখে ‘সুপার উইমেন’ হিসেবে দেখতে পছন্দ করে। যাঁরা ঘর সামলে চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো কঠিন পেশা বেছে নিয়েছেন, তাঁদের দুকুল রক্ষা করতে হলে সেটাই করতে হয়। সাদেকা হালিম বলেন, ‘আমাদের চারপাশের বিভিন্ন দেশে নানাভাবে এখনো পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরাজমান। সিনেমা হলো সেই মাধ্যম, যা আমাদের সমাজ বাস্তবতাকে দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে অতি বাস্তব এবং ভবিষ্যৎও দেখায়। এ কারণে সিনেমা দেখে বোঝা যায় কোন সমাজে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার গভীরতা কতটুকু।’</p> <p style="text-align: justify;">এই অধিবেশন শেষে মধ্যাহ্ন বিরতির পর দুপুর ২টা থেকে শুরু হয় আরেকটি অধিবেশন। এতে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীরের সভাপতিত্বে ‘স্টিয়ারিং থ্রু দ্য সিনিস্টার হুইস্পার্স অব মডার্নিটি’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ধারাবাহিকের স্বাধীন (ফ্রিল্যান্স রিভিউয়ার) সমালোচক সামারাহ জান্নাতি জামাল। এই পর্বে আলোচনায় অংশ নেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফিফা আক্তার, ডকুমেন্টারি বিভাগে আন্তর্জাতিক পুরস্কারজয়ী পর্তুগালের নির্মাতা ফিলিপা কারদোসো।</p> <p style="text-align: justify;">দিনের শেষ অধিবেশন শুরু হয় বিকেল ৪টায়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের অভিনেত্রী ক্যাটেরিনা ক্রামোভা মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম ‘দ্য রোল অব কনটেম্পোরারি সিনেমা ইন এম্পাওয়ারিং ইয়াং গার্লস: এ ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিস অব ফিল্মস দ্যাট ইন্সপায়ার কনফিডেন্স, অ্যাম্বিশন অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স’। এতে আলোচনায় অংশ নেন ভারতীয় অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জি এবং বাংলাদেশি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক তাহরিমা খান।</p> <p style="text-align: justify;">আজ সোমবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে একই জায়গায় অনুষ্ঠিত হবে আরো তিনটি অধিবেশন। এসব অধিবেশনে কথা হবে বাংলাদেশের ওটিটি প্ল্যাটফরমে নারী নির্মাতাদের কাজ, শ্রীলঙ্কার চলচ্চিত্রে নারী চরিত্র এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে।</p> <p style="text-align: justify;">গত শনিবার বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব মিলনায়তনে ২২তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। দেশ-বিদেশের আড়াই শতাধিক সিনেমা নিয়ে এই উৎসবের আয়োজন করেছে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি। রাজধানীর ছয় মিলনায়তনে আগামী ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত বিনা মূল্যে দেখানো হবে সিনেমাগুলো।</p> <p style="text-align: justify;">১৯৯২ সাল থেকে ‘নান্দনিক চলচ্চিত্র, মননশীল দর্শক, আলোকিত সমাজ’ স্লোগানকে সামনে রেখে নিয়মিত এই চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করে আসছে ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি।</p>