<article> <p style="text-align: justify;">শীতলপাটি বাংলার আবহমান লোকজ শিল্প তথা ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ জীবনের এক সমৃদ্ধ অনুষঙ্গ। এককালে গরমের সময় গ্রামের বাড়িতে অতিথি এলে তাকে শীতলপাটিতে বসতে দেওয়া হতো। মসৃণ বেতের ফালি দিয়ে সযত্নে তৈরি শীতলপাটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে বসলে ঠাণ্ডার অনুভূতিতে শরীর জুড়িয়ে যায়। এ কারণেই এর নাম শীতলপাটি।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">যুগের পরিক্রমায় জীবনযাত্রার ধরনে পরিবর্তন আসায় পাটির সে রকম বহুল ব্যবহার নেই। তবে স্থানীয় কিছু ব্যবহারের পাশাপাশি শৌখিন শহরবাসী এবং প্রবাসী ও বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদার কারণে এখনো তৈরি হয় নানা ধরনের পাটি ও মাদুর। তবে শীতলপাটি এখন শহরে মূলত শোপিস হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। গ্রামে এর ব্যবহার মাদুর কিংবা বিছানার চাদরের বিকল্প হিসেবে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">দেশের যেসব অঞ্চলে শীতলপাটি তৈরি হয় তার একটি দক্ষিণের ঝালকাঠি জেলা। দেশে-বিদেশে সিলেটের মতো ঝালকাঠির শীতলপাটিরও বেশ সুনাম রয়েছে। ঝালকাঠির বেশির ভাগ শীতলপাটি তৈরি হয় রাজাপুর ও নলছিটি উপজেলায়। ৮-১০ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৯০ বছরের বৃদ্ধরা পর্যন্ত শীতলপাটি তৈরির কাজ করেন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">যাঁরা পাটি তৈরির কাজ করেন অঞ্চলভেদে তাঁদের বলা হয় পাটিকর বা পাটিয়াল। ঝালকাঠিতে পাটি তৈরির উপাদানের গাছটি পরিচিত পাইত্রা বা মোতা নামে। বর্ষজীবী এই উদ্ভিদের কাণ্ড থেকে ‘বেতি’ তৈরি করা হয়। পরিপক্ব পাটিগাছ কেটে পানিতে ভিজিয়ে ও সিদ্ধ করার পর বেতি তোলা হয়। বেতির সেরা ওপরের অংশ থেকে তৈরি হয় শীতলপাটি। অন্যান্য অংশ দিয়ে বানানো হয় সাধারণ পাটি।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">পাটিকররা বর্ষা মৌসুমে পাইত্রা কিনে বেতি মজুদ করে রাখেন। বর্ষা চলে গেলে শুরু হয় পাটি তৈরির কাজ। ঝালকাঠি জেলায় চার শর বেশি পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। রাজাপুর উপজেলার হাইলাকাঠি ও নলছিটি উপজেলার কামদেবপুর ‘শীতলপাটির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত। এই গ্রাম দুটিতে বেশ কয়েক শ একর জমিতে রয়েছে বিশাল পাটিগাছের বাগান।</p> <p style="text-align: justify;">ঝালকাঠির পাটিকররা শীতলপাটি, নামাজের পাটি ও আসন পাটি নামে তিন ধরনের পাটি তৈরি করেন। একটি পাটি বুনতে তিন-চার জন কর্মীর সময় লাগে দুই-তিন দিন। স্থানীয় বাজারে এর দাম এক শ থেকে এক হাজার টাকা। পাটিশিল্পীরা তাঁদের পরিশ্রম ও নৈপুণ্যের তুলনায় আর্থিক লাভ পান কম। মহাজনসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটেই যায় লাভের একটা বড় অংশ। পাইত্রা কেনার জন্য যে পরিমাণ মূলধন প্রয়োজন হয় পাটিকরদের প্রায় কারোই সে সামর্থ্য নেই। এ জন্য তাঁরা মহাজন ও এনজিওর কাছে হাত পাততে বাধ্য হন।</p> <p style="text-align: justify;">ঝালকাঠির পাটিকররা বছরের ছয় মাস পাটি বুনে সারা বছরের জীবিকার সংস্থান করেন। তাঁদের তৈরি করা শীতলপাটি পাইকারদের মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশে যায়। কিছু রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশেও।</p> <p style="text-align: justify;">গত দুই বছর ধরে এসএমই ফাউন্ডেশন শীতলপাটি দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প পণ্য তৈরি করার প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর ঝালকাঠির পাটিকরদের আয় কিছুটা বেড়েছে। তাঁরা এখন শীতলপাটি দিয়ে কলমদানি, টিস্যু বক্স, ট্রেসহ নানা ধরনের পণ্যও তৈরি করছেন। এই শিল্পের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য মতে, ঝালকাঠি থেকে বর্তমানে বছরে প্রায় তিন কোটি টাকার শীতলপাটি সরবরাহ করা হচ্ছে।</p> <p style="text-align: justify;">রাজাপুরের হাইলাকাঠি গ্রামের সুদেব পাটিকর বলেন, ‘গরমের দিনে শীতলপাটির কদর বেশি থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে খরিদদার এসে আমাদের হাতে বোনা শীতলপাটি নিয়ে যাচ্ছে। তবে আর্থিক অভাবের কারণে চাহিদা মতো কাজ করতে পারছি না আমরা।’</p> <p style="text-align: justify;">শীতলপাটি ব্যবসায়ী মনীন্দ্র পাটিকর জানান, সারা দেশে ঝালকাঠির পাটির বেশ চাহিদা রয়েছে। বিদেশেও পাঠানো হচ্ছে এখানকার শীতলপাটি।</p> <p style="text-align: justify;">ঝালকাঠির পাটিশিল্পী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক অভিনাস পাটিকর বলেন, ‘চট্টগ্রাম দিয়ে এখানকার শীতলপাটি বিদেশে পাঠানো হয়। বিদেশে এই পাটির ভালো কদর রয়েছে।’</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক) ঝালকাঠির উপমহাব্যবস্থাপক ফয়জুর রহমান বলেন, ‘শীতলপাটি শিল্পের জন্য ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’</p> <p style="text-align: justify;">ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমই ফাউন্ডেশন) সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ মোরশেদ আলম বলেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই শীতলপাটির বিপণন, বহুমুখীকরণ, নকশা উন্নয়ন এবং অর্থায়নে সহযোগিতার লক্ষ্যে কাজ করছে এসএমই ফাউন্ডেশন।’</p> <p style="text-align: justify;">জেলার সুপরিচিত এই ব্র্যান্ড পণ্যের বিষয়ে নজর রাখার কথা জানালেন জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম। তিনি বলেন, ‘জেলার শীতলপাটির প্রসার এবং এর সঙ্গে যুক্তদের উন্নয়নে সচেষ্ট রয়েছে জেলা প্রশাসন।’</p> </article>