<p style="text-align: justify;">দেহ একেবারে স্বচ্ছ জলের মতো। বাইরে থেকে ভেতরের সব দেখা যায়। দেখতে ছাতার মতো। তবে শরীরের চারপাশ থেকে নিচের দিকে নেমে গেছে বেশ কয়েকটি শুঁড়। শুঁড়গুলো চিকন আর খুব ছোট ছোট। প্রাণীটি আয়তনেও তত বড় নয়। কুয়াকাটাসহ উপকূলের যেসব জেলে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরেন, সামুদ্রিক এই প্রাণীটিকে স্থানীয় ভাষায় তারা ডাকেন নোনা। কারণ শরীরের বেশির ভাগ অংশ পানি দিয়ে তৈরি, যা লবণাক্ত।</p> <p style="text-align: justify;">যে নামেই ডাকা হোক, বিশ্বজুড়ে সামুদ্রিক এই প্রাণীর পরিচিত (বৈজ্ঞানিক) নাম জেলিফিশ। উপকূলের জেলেরা মাছ ধরতে জাল ফেলছেন সাগরে, কিন্তু উঠে আসছে নোনা। যা মাছের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। যেহেতু অর্থনৈতিকভাবে এই মাছের ব্যবহার এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি, তাই সাগর থেকে তোলা মাছ আবার সাগরেই ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কুয়াকাটার জেলেরা বলছেন, জালপুরে জেলিফিশ তুলতে আর তা সাগরে ফেলতেই সময় চলে যায়। এতে করে জেলেরা জেলিফিশ নিয়ে নতুন সমস্যায় পড়েছেন।</p> <p style="text-align: justify;">এখানেই শেষ নয়, কুয়াকাটা সৈকতসহ উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় দুই সপ্তাহ ধরে অসংখ্য জেলিফিশ ভেসে আসছে। ভেসে আসা জেলিফিশ সৈকতে পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ফলে পর্যটকরাও কুয়াকাটা বিচে নামতে পারছেন না। এতে করে পর্যটন ব্যবসায়ীরা ঈদ মৌসুমে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন বলে তারা আশঙ্কা করছেন।</p> <p style="text-align: justify;">মাৎস্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, পানির লবণাক্ততা এবং তাপমাত্রার ওপরে জেলিফিশের সংখ্যা অনেকাংশে নির্ভর করে। গেল বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় সমুদ্রের পানিতে লবণাক্ততা বেশি ছিল, ফলে জেলিফিশেরও আধিক্য দেখা গেছে। তবে বৃষ্টিপাত ও নিম্নচাপ সৃষ্টি না হলে কুয়াকাটা সৈকত এলাকায় জেলিফিশ আসা কমবে না বলে জানিয়েছেন মৎস্য কর্মকর্তারা। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে জেলিফিশের এমন আধিক্য থাকতে পারে বলে তাদের ধারণা।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>জেলিফিশে আটকা জেলের পেশা </strong></p> <p style="text-align: justify;">গঙ্গামতী এলাকার জেলে আবদুল মন্নান মাঝি বলেন, ‘আমাগো মতন যেসব জাইল্যা ভাসা জাল বায়, তারা কয়েক দিন ধইর‌্যা সমুদ্রের গভীরে যাইয়া কোনো মাছই ধরতে পারছে না। অনেক জাইল্যা সাগরে গোনে চইল্যা আইছে। এই গুলানের দেহের লগে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের রেণু পোনা আটকাইয়াও মারা যাচ্ছে। এগুলা এমনই বিষাক্ত, জাইল্যাগো হাতে-পায়ে লাগলেও চুলকায়।’</p> <p style="text-align: justify;">গত কয়েক বছরে এমন পরিস্থিতি হয়নি বলে উল্লেখ করে জেলে টুনু মিয়া বলেন, এইবার হঠাৎ করে সমুদ্রের পানিতে ভেসে আসছে লাখ লাখ জেলিফিশ। কী যে এক অবস্থা, সমুদ্রে জাল ফালাইলেই জালের সঙ্গে জেলি মাছগুলা লাইগ্যা যায়। এ ছাড়া জালে লাগলে ওজন এত বেশি হয়, জাল তুইল্যা উডান যায় না। জাল পানির নিচের দিকে চইল্যা যায়।’</p> <p style="text-align: justify;">জেলেরা মাছ ধরতে না পারায় সরবরাহ কমে গেছে বলে মনে করছেন আলীপুর মৎস্য বন্দরের মেসার্স ধুলাসার ফিশের আড়তদার মো. বাচ্চু মিয়া। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রের কমপক্ষে ১০ কিলোমিটার গভীরে জেলিফিশ বেশি ভাসছে। গভীর সমুদ্রেও অনেক জেলের জালে জেলিফিশ আটকে জাল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোনো খুটা জেলেই সমুদ্রের উপকূলে জাল ফেলতে পারছেন না। জেলেরা বেকার হয়ে পড়েছেন।’</p> <p style="text-align: justify;"><strong>যে কারণে জেলিফিশের মিছিল</strong></p> <p style="text-align: justify;">বাতাসের চাপে এবং ঢেউয়ের কারণে জেলিফিশ কুয়াকাটা সৈকতে আটকে পড়েছে। কুয়াকাটা সৈকত, লেম্বুর চর, গঙ্গামতী, খালগোড়া ও ঝাউবন এলাকার বালুচরে লাখ লাখ জেলিফিশ পড়ে আছে। এসব জেলিফিশ পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সর্বত্র। মঙ্গলবারও বিচে জেলিফিশ ভেসে এসেছে। কিছু জেলিফিশ কুকুর খেয়ে ফেলছে, কিছু বালুর নিচে চাপা পড়ছে। অনেক জেলিফিশ বালুচরে পড়ে আছে। কিছু জেলিফিশ জোয়ারের পানিতে পুনরায় ভেসে গেছে। </p> <p style="text-align: justify;">কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ‘জেলিফিশ সাঁতার কাটতে পারে না। এরা স্রোতের  সঙ্গে ভেসে বেড়ায়। জোয়ারের সময় ঢেউয়ের সঙ্গে সৈকতের বালিয়াড়িতে আসে। পরে ভাটায় তারা সাগরে ফিরতে না পেরে আটকে পড়ে। আর বালিয়াড়িতে আটকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণীটি মারা যায়। তাপমাত্রার কারণে জেলিফিশের বংশবৃদ্ধি বেশি হয়। এবার এ বৃদ্ধিটা অতিরিক্ত হারেই হয়েছে। </p> <p style="text-align: justify;">অপু সাহা আরো বলেন, গত ১৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে সমুদ্রে এদের উপস্থিতি দেখা গেছে। গত ২০ থেকে ২৫ দিন জেলিফিশ একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। উপকূলে ভেসে আসা এসব জেলিফিশ ‘সাদা জেলিফিশ’ নামে পরিচিত। এ প্রজাতির জেলিফিশের কিছুটা চুলকানি সৃষ্টি করার ক্ষমতা রয়েছে। তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে কিংবা একটা নিম্নচাপ হলে বা বৃষ্টিপাত হলে থাকবে না। এপ্রিলের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।</p> <p style="text-align: justify;">গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকোফিশ-২ অ্যাকটিভিটির পটুয়াখালী জেলার সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি বলেন, জেলিফিশ বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রে কচ্ছপের আধিক্য কমে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, কচ্ছপের প্রধান খাদ্য হচ্ছে জেলি ফিশ। যদি কচ্ছপের আধিক্য বেশি থাকত, তাহলে হঠাৎ এত পরিমাণে জেলিফিশের উদ্ভব হতো না। এ ছাড়া সমুদ্রে জলজ বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে জলজ বাস্তুতন্ত্রেরও পরিবর্তন হচ্ছে। </p>