<p>কক্সবাজার-ঘুমধুম-রামু রেল লাইনের জন্য কক্সবাজার সদর উপজেলায় অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণের সাড়ে ৮ শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে মাঠে নেমেছে একটি প্রতারক চক্র। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কিছু কর্মচারী, জেলা জজ আদালতের পেশকার, ভূমি অফিসের নাম ব্যবহারকারী কিছু দালাল, প্রশাসনের নিকট তদবিরকারী কিছু পেশাজীবী-ধান্ধাবাজ ও শহরের কয়েকজন অর্থশালী ব্যক্তি এই চক্রে সরাসরি জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রেল লাইনের অধিগ্রহণ করা জমির টাকা হাতিয়ে নেয়া ছাড়াও সরকারের উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিও চক্রটির লক্ষ্য বলে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা মনে করছেন।</p> <p>এমন অভিযোগ পেয়ে মঙ্গলবার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে পুলিশ ও ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অভিযান চালিয়ে এই চক্রের তিন সদস্যকে আটক করে। তাদের নিকট থেকে জব্দ করা হয়েছে ছয় বস্তা ভূয়া নাম জারির সৃজিত খতিয়ান। জালিয়াত চক্রের আটক ব্যক্তিরা হলেন- কক্সবাজার সদর উপজেলা পিএমখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ নয়া পাড়া এলাকার মকবুল আহমদের ছেলে তৌহিদুল ইসলাম, একই ইউনিয়নের মাইজ পাড়া এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে নুরুল আবছার ও লিংকরোডস্থ ছাদুর পাড়া এলাকার ছৈয়দুল হক।</p> <p>কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নোমান হোসেন বলেন, 'গত সোমবার রাতে পুলিশ ও ঝিলংজা ইউপি চেয়ারম্যান টিপু সোলতানকে সঙ্গে নিয়ে কক্সবাজার বাস টার্মিনাল এলাকার 'এম আর বড়ুয়া (সুমন)' নামে একটি দোকানে অভিযান চালাই।</p> <p>অভিযানে এই দোকানের একটি ফাইল থেকে কিছু ভূয়া ওয়ারিশ সনদ জব্দ করা হয়েছে।' পরে বাস টার্মিনালস্থ পূর্বলার পাড়ার জনৈক বাবুলের ভাড়াবাসা থেকে তৌহিদুল ইসলামকে আটক করা হয়। এ সময় তার রুম থেকে দুই বস্তা ভূয়া খতিয়ান ও ওয়ারিশ সনদ জব্দ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান ও প্রশাসনের সীল এবং সাক্ষর জাল করে খতিয়ান ও ওয়ারিশ সনদগুলো তৈরি করা হয়েছে। এরপর তৌহিদুলের প্রাথমিক স্বীকারোক্তি মোতাবেক আটক করা হয় নুরুল আবছার ও ছৈয়দুল হককে।</p> <p>আটক ব্যক্তিরা প্রাথমিক স্বীকারোক্তিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, তারা শুধু খতিয়ান ও ওয়ারিশ সনদ বহনকারী। তাদের এই চক্রের অন্যতম গডফাদার হলো- শহরের উত্তর রুমালিয়ার ছড়া এলাকার আবুল ফজলের ছেলে শামসুল হুদা ও শহিদুল হুদা। এই গডফাদারের নেতৃত্বে রয়েছে- ঝিলংজা জানারঘোনা এলাকার এনামুল হকের ছেলে আমিন উল্লাহ, জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার মাসুদ পারভেজ নামে এক ব্যক্তি, জজ কোর্টের পেশকার মুফিজ ও শহিদ উল্লাহ, সদর ভূমি অফিসের ওমেদার নামদারী দালাল শহিদ, জয়নাল ও জানারঘোনা এলাকার মৃত জামাল হোসেনের ছেলে সাত্তার।</p> <p>এদিকে আটক তৌহিদুল ইসলামের বোনের জামাই হলো দালাল সাত্তার। প্রশাসনের কাছে এসব স্বীকারোক্তি দেয়ার পর পুনরায় অভিযান চালিয়ে সাত্তারের বাড়ি থেকে দুই বস্তা ও আমিন উল্লাহর বাড়ি থেকে দুই বস্তা ভূয়া খতিয়ান জব্দ করা হয়েছে।</p> <p>এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রনজিত কুমার বড়ুয়া বলেন, 'ভূয়া খতিয়ান, চেয়ারম্যান সনদ ও ওয়ারিশ সনদ জাল করার অভিযোগ পেয়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তিনজনকে আটক করেছে। তাদের দু'জনের বাড়ি থেকে চার বস্তা ভূয়া খতিয়ান জব্দ করা হয়েছে।' তিনি জানান, এ ব্যাপারে তিনজনের নাম উল্লেখ করে আজ মঙ্গলবার বিকালে থানায় জালিয়াতি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে অনেক জনকে।</p> <p>কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানিয়েছেন, 'জালিয়াত চক্রটি এমন প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা না পড়লে অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণের কোটি কোটি টাকা নিয়ে ভয়াল ঘটনা ঘটতে পারত। এ ঘটনার পর আমি ইতিমধ্যে ক্ষতিপূরণের টাকার চেক প্রদানে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছি।'</p> <p>জানতে চাইলে সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাজিম উদ্দীন বলেন, জাল ও ভূয়া খতিয়ানে ভূমি অফিসের কেউ জড়িত রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মূলত একটি দালাল চক্র দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে যাচ্ছে খতিয়ান নিয়ে। এই চক্রের তিন সদস্যকেও আটক করা হয়েছে। এমনটি এই প্রতারক চক্রের গডফাদার উত্তর রুমালিয়ারছড়া এলাকার শামসুল হুদা বলে জানা গেছে।<br />  <br /> নাজিম উদ্দীন আরো বলেন, শামসুল হুদা নামে এই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে একটি ভূয়া খতিয়ান তৈরি করে কলাতলী বাইপাস সড়কের পাশে বিশাল একটি পাহাড়সহ সরকারি জমি দখল করে খোরশেদ নামে এক ব্যক্তিকে বিক্রি করেন। সেখানে পাহাড় কেটে স্থাপনাও নির্মাণ করা হয়।</p> <p>এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত চারদিন আগে সেখানে অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রতারক চক্রের সদস্যরা ভূয়া খতিয়ান গুলো আসল খতিয়ান বলে প্রশাসনের নামে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে।</p> <p>এমনকি ভূয়া খতিয়ানের মাধ্যমে সরকারি জায়গা হাতিয়ে নেয়ার কৌশল হিসেবে প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করতে বিভিন্নভাবে ভূয়া সংবাদ পরিবেশে করতে সহযোগিতা করে এই জালিয়াতি চক্রের সদস্যরা।</p> <p>কক্সবাজার ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টিপু সোলতান বলেন, সরকার রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেল প্রকল্পের জন্য সদরে ১ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। অধিগ্রহণভূক্ত জমির সাড়ে আট শত কোটি  টাকা আত্মসাৎ করতে এই সিন্ডিকেট গড়ে উঠে।</p> <p>তাদের টার্গেট ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া। সে জন্য রাতারাতি খতিয়ান সৃজন করতে খতিয়ান প্রতি ব্যয় করেছে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। এমনকি আমার সীল ও সাক্ষর জাল করে তারা তৈরি করেছে চেয়ারম্যান সনদ ও ওয়ারিশ সনদও। তন্মধ্যে ৩১৩টি ওয়ারিশ সনদ জব্দ করা হয়েছে।</p>