<p>বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইবারের উপাচার্য, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক, মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত। খ্যাতিমান এই চিকিৎসক একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। এ জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন। প্রাণ গোপাল দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেছেন, একজন রাজনীতিবিদ বা সংসদ সদস্য সব সেক্টরে সেবা দিতে পারেন। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে তিনি তা পারছেন না। তাই সংসদ সদস্য হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দলের মনোনয়ন চেয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার গ্রিন রোডে গ্রিন লাইফ হসপিটালে নিজ চেম্বারে সাক্ষাৎকার দেন প্রাণ গোপাল। ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত প্রাণ গোপাল দত্ত আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসকও। ওয়ান-ইলেভেনের প্রতিকূল পরিবেশে রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চিকিৎসা করেছেন শেখ হাসিনার। উপাচার্য থাকার সময় আমূল বদলে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে। </p> <p>‘নাক, কান ও গলার খ্যাতিমান চিকিৎসক আপনি। হঠাৎ রাজনীতিতে এলেন কেন?’ এ প্রশ্নের জবাবে প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ‘না,  হঠাৎ করে নয়। ১৯৬৮-৭০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় ওই কলেজের নিউ হোস্টেল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। তখন ভিক্টোরিয়া কলেজে প্রথমবার ছাত্রলীগ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে হেরে যায় এবং পরের বছর জয়ী হয়। তিনি জানান, ১৯৬৮ ও ’৭০ সালে কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের কাউন্সিলর হয়ে তিনি ইকবাল হলে ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগ দেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে প্রচার সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পরে ছাত্রলীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। পেশাজীবী রাজনীতিতে এসে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদে যুক্ত হন। এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তিনি।</p> <p>কিন্তু কেন সংসদ সদস্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষা? প্রাণ গোপাল জানান, ২০০৩ সালে কুমিল্লায় তিনি গ্রামের বাড়িতে পৈতৃক সম্পত্তিতে একটি হাসপাতাল করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু সংসদ সদস্যের সেটা পছন্দ হয়নি। তাই তিনি হাসপাতাল করতে পারেননি। এরপর তাঁর ধারণা হয়, একজন সংসদ সদস্য যদি না চান, তাহলে ওই এলাকায় কেউ কিছু করতে পারবে না। সে যত বিত্ত, অর্থ বা সম্পদের মালিকই হোক না কেন।</p> <p>‘তাহলে সংসদ সদস্য হলে মানুষের সেবা করার অনেক সুযোগ রয়েছে?’ এই প্রশ্নে প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ‘হ্যাঁ, অনেক সুযোগ রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চারটি এজেন্ডা নিয়ে নেমেছি। আমার প্রথম এজেন্ডা হলো চান্দিনা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এটা একটা মাদকের চিহ্নিত পথ এবং আমি আশ্চর্য হই যখন গ্রামের বাড়িতে যাই, সেখানে দেখি ৮, ১০, ১২, ১৫ বছরের ছেলেরা মাদক নিচ্ছে ও মাদক বিক্রি করছে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা। একজন চিকিৎসক হিসেবে জানি, একটা পরিবারে যদি একজন মাদকাসক্ত ছেলে থাকে, ওই পরিবারটা ধ্বংস হয়ে যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি চিকিৎসক হিসেবে সমাজসেবা করছি। সেই সমাজসেবা চিকিৎসাসংক্রান্ত। রাজনীতিবিদ যদি সত্যিকার অর্থে সমাজসেবা করার জন্য রাজনীতি করে, তাহলে সে সব সেক্টরেই সাহায্য-সহযোগিতা এবং সেবা দিতে পারে। কিন্তু আমি চিকিৎসার বাইরে পারি না।’</p> <p>প্রাণ গোপাল দত্ত যখন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন তাঁর চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করছিল বিপুলসংখ্যক রোগী। মাঝেমধ্যে দরজায় টোকা পড়ছিল এবং রোগী-অন্তপ্রাণ এই চিকিৎসক বিচলিত হচ্ছিলেন। জানা গেল, তাঁর কাছে কোনো রোগী এসে টাকা না থাকার জন্য ফিরে যেতে পারে না। চেম্বারে সাদা কাগজে বড় করে লেখা ‘ফি না থাকলে দয়া করে বলবেন’। ‘আপনি সংসদ সদস্য হলে ব্যস্ততা বাড়বে। তখন কি এই দুস্থ ও গরিব রোগীরা বঞ্চিত হবেন না?’ এমন প্রশ্নে তাঁর দৃঢ় উত্তর—না, বাড়বে না। তিনি পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় রাজনীতিক প্রয়াত ডা. বিধান রায়ের উদাহরণ দেন। ডা. রায় কলকাতা পৌরসভার মেয়র ছিলেন। কলকাতা ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। প্রায় ১৫ বছর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু প্র্যাকটিস কখনো ছাড়েননি।</p> <p>প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ‘আমার রাশিয়ান বসকে বলেছিলাম আমি তো আর সময় পাচ্ছি না। তুমি বলছ এত দিনের মধ্যে এটা করতে হবে। আমি সময় বের করব কিভাবে?’ তখন তিনি বলেন, সময় ধার নিতে পারো। জানতে চাইলাম কিভাবে? তখন তিনি বললেন, ‘তোমার ঘুমের থেকে ধার নাও। তুমি এখন সাত ঘণ্টা ঘুমাও, সেখান থেকে দুই ঘণ্টা কমিয়ে দাও। এখনো আমি ৫টায় উঠে এসে এখানে (গ্রিন লাইফ হসপিটাল) অপারেশন করি। সংসদ সদস্যের কাজ কিন্তু ভোর ৫টায় শুরু হবে না। আমি ৫টা থেকে এসে যদি ৯টা পর্যন্ত রোগী দেখি ৬০-৭০টা রোগী দেখতে পারব। সন্ধ্যা ৭টায় এসে রাত ৯টা পর্যন্ত সকালের রোগীদের রিপোর্টগুলো দেখে দেব। নতুন রোগী থাকলে দেখব। অর্থাৎ আমি সেবা দিতে পারব। আর এলাকায় শুক্র, শনি ও রবিবার রোগী দেখতে পারব। কারণ এখনো এই তিন দিন ঢাকায় আমার চেম্বার বন্ধ থাকে।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘সংসদ সদস্য, মন্ত্রী যা-ই হই না কেন, আমি আমার চিকিৎসা পেশা ছাড়ব না। সারা জীবন ধরে মানুষের সেবা করে এসেছি। বাকি জীবনটাও মানুষের সেবা করে যেতে চাই।’</p> <p>ওয়ান-ইলেভেনের প্রতিকূল পরিবেশে জেলখানায় গিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যার চিকিৎসা করেন অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল শেখ হাসিনার শারীরিক অবস্থা কাউকে না বলার। কিন্তু তখনকার শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যার শারীরিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র অর্থাৎ গুরুতর অসুস্থতার কথা সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন। আর তারপরই শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলন আরো জোরদার হয়। শেখ হাসিনাকে একসময় মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেই সময়কার স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, “সেটা এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। হঠাৎ করে টেলিফোন আসত। মেজর হায়দার টেলিফোন করে বলতেন, ‘আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’ আমি জানতে চাইলাম কোথায়? তখন তিনি বললেন, ‘আপনি গেলেই দেখবেন।’ মেজর হায়দার বলতেন, ‘আপনি যন্ত্রপাতি রেডি করে রেখে দেন। আমি যন্ত্রপাতি রেডি করে রেখে দিতাম। উনি গাড়িতে ওঠাতেন। উঠিয়ে সরাসরি সংসদ ভবনের সাবজেলে না গিয়ে অনেক এলাকা ঘুরিয়ে নিয়ে যেতেন। নিয়ে ওনাকে দেখাতেন। দেখার সময় আপা (শেখ হাসিনা) ইশারা দিতেন বসে থাকার। কথা বলার জন্য। আমি বসে থাকতাম। গোয়েন্দা সংস্থার পাঁচ-ছয়জন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকত। আমার কাছে তখন শুধু রেহানা আপার (শেখ রেহানা) ফোন নম্বর ছিল। পরে উনি জয় ও পুতুলের নম্বর দেন। আপা তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেন। আমি বেরিয়ে আসতাম। মেজর হায়দারের নিষেধ ছিল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলার। কিন্তু সাংবাদিকরা এলে আমি নেত্রীর শারীরিক অবস্থার কথা জানাতাম। আমি রেহানা আপাকেও ফোন করে জানাতাম আপা ভালো আছেন। যদিও ওই সময় আপা খুবই অসুস্থ ছিলেন। জেলে থাকলে যা হয়, স্কিন ও আই ইনফেকশন। আমার মনে হয় তখনই ওনার গুরুতর অসুস্থতার শুরু হয়।” এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি ভয় পাইনি। যখন যেতাম সঙ্গে করে ওষুধও নিয়ে নিতাম।’</p> <p>কথার ফাঁকেই দুপুরের খাবার আসে চেম্বারে। সবাইকে নিয়ে খাওয়া শুরু করেন প্রাণ গোপাল দত্ত। অত্যন্ত সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত এই চিকিৎসকের খাবার মেন্যু ছিল দুই টুকরো মুরগির মাংস, করলা ভাজি আর সামান্য মিষ্টি কুমড়া। কথার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত খাবার শেষ করেন তিনি। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে কতটা আশাবাদী তিনি? জবাবে প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ‘আমি তো মনে করি আমার অতীত ও বর্তমান বিবেচনা করা হলে আমারই পাওয়া উচিত। বড় বিচারক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। শি ক্যান জাজ। তিনি যদি মনে করেন—না, আমাকে এখানে মানায় না, উনি দেবেন না। ২০০১ সালে আমি নির্বাচন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নেত্রী না করেছিলেন। ২০০৮ সালে নেত্রীর কাছে খবর যায় চান্দিনা আসনটি আমরা হারাব। তখন নেত্রী আমাকে ডেকে বললেন তুমি যাও, গেলেই দলের প্রার্থী জিতে যাবে। উনি আমাকে পাঠালেন, আমি গেলাম এবং দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করে আনলাম।’</p> <p>প্রার্থী হলে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সমর্থন কেমন পাবেন—এমন প্রশ্নে প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, এখনই তাঁর সঙ্গে এলাকার ৬০-৭০ শতাংশ নেতাকর্মী আছে। মনোনয়ন পেলে বাকিরাও চলে আসবে। সংসদ সদস্য হলে চান্দিনাকে মডেল থানা করে দেবেন। তিনি এও বলেন, ‘আমার নেত্রী আমাকে বা যাঁকেই মনোনয়ন দিন না কেন, আমি জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করব।’</p> <p>কালের কণ্ঠ’র এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা শেষ হতেই রোগীদের ডাকতে সহকারীদের নির্দেশ দেন অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত। আবার শুরু হয় রোগীদের নিয়ে নিত্যদিনের জীবন। </p>