অলংকরণ : দেওয়ান আতিকুর রহমান
পানিতে ডুবে গেছে শালিকপাড়া গ্রাম। ঘরে খাবার নেই। বাবা বাবুই চুপচাপ বসে আছে একটা ডালে।
‘বাবুই ভাই, বুবুন ভাবি কোথায়?’
তিড়িংবিড়িং উড়ে এলো টুনি।
বিজ্ঞাপন
‘ও দানাপানির খোঁজে গেছে। আমি ছানাদের পাহারা দিচ্ছি। ’ বলল, বাবা বাবুই।
‘পানি তো অনেক। এখন দানা পেলেই হয়। ’
‘খুব কথা শিখেছিস দেখি। ’
‘গান শুরু করব নাকি। গান শুনলে তোমার ছানাদের কান্না থামে কি না...। ’
‘একদম প্যানপ্যান করবি না! এমনিতে ছানাদের চেঁচামেচিতে কান গরম। ’
বাবুইয়ের কথায় কাজ হলো না। টুঁ টুঁ করে গান ধরল টুনি। কান্না থামাল ছানারা। খুশিই হলো বাবা বাবুই। কিন্তু গান দিয়ে কি আর পেট ভরে। একটু পর আবার টেঁ টেঁ জুড়ে দিল।
বাবা বাবুই বলল, ‘এখন দানা পাই কোথায় বল তো। ’
‘যাই তাহলে। দেখি কিছু পাই কি না। ’
উড়তে লাগল টুনি। দূরে একটা উঁচু জায়গায় মানুষের ভিড়। একদল মানুষকে খাবার দিচ্ছে কয়েকজন মানুষ। একটা বড় নৌকায় অনেক খাবার। সেটাকে ঘিরে জটলা।
‘যাই ওখানে। দেখি দু-চারটা দানা পাই কি না। ’
নৌকার সামনের দিকটা, যেটাকে বলে গলুই, ওতে গিয়ে বসল টুনি।
‘হুশশশ’। হাত নাড়ল একজন মানুষ। রাগ হলো টুনির। একদম নড়ল না। বিড়বিড় করে বলল, ‘এত এত খাবার। আমাদের একটুখানি দিলেই বা কি। ’
মানুষজন চলে গেল। নৌকায় যে কয়টা চাল-ডাল পড়ে ছিল সেগুলো খেলো টুনি। উড়ে গিয়ে খবর দিল বাবা বাবুইকে। বাবুইও উড়ে এসে দানা নিয়ে গেল ছানাদের জন্য। আরেকবার এসেই দেখে নৌকাটা চলে গেছে।
বাড়ি ফিরল মা বাবুই। খুব ক্লান্ত। কোথাও কিছু নেই।
‘যেদিকে তাকাই শুধু পানি। মানুষজন একজন আরেকজনকে এটা-ওটা দিচ্ছে। আমাদের খাবার দেওয়ার কেউ নেই। ’
তালগাছের আগায় বসে টুনি ভাবছে। মানুষগুলোর কাণ্ড দেখে অবাক সে। ক্যামেরা হাতে সাংবাদিকও দেখেছে। কেউ কথা বলে, কেউ পানিতে দাঁড়িয়ে ভিডিও করে। টুনি গালে হাত রেখে বলতে লাগল, কী করা যায়, কী করা যায়।
বিকেলে শালিকপাড়া গ্রামে বিশাল বড় এক নৌকা এলো। সেটায় বসে মানুষজনকে খাবারের প্যাকেট দিচ্ছে বড়সড় এক লোক। চোখে সানগ্লাস।
পাশে থাকা একজন পাখা হাতে বাতাস করছে, আরেকজন ছাতা ধরে আছে মাথায়।
লোকটার দিকে গোটা দশেক ক্যামেরা তাক করা। সবাই লাইভ ভিডিও করছে। ওই লোকটা আবার একটা করে প্যাকেট দিচ্ছে আর হাত নেড়ে কী কী যেন বলছে।
হঠাৎ একটা পাখি এসে বসল লোকটার মাথায়। এই যাহ...হুশশ হাশশ...শুরু হয়ে গেল চেঁচামেচি। পাখিটাও দুষ্টু। একটুখানি উড়ে আবার বসল। লোকটার মাথার ওপর বসেই ডানা নেড়ে কিচিরমিচির করে কী যেন বলল পাখিটা। লোকটা তো শেষে ভয় পেয়ে নৌকার ছইয়ের ভেতরই ঢুকে গেল।
এদিকে পাখির সাহস দেখে সবাই অবাক। যারা এ ভিডিও দেখল তারাও অবাক।
সন্ধ্যা হতে না হতেই ভিডিওটা ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। পথে-ঘাটে সবার হাতে হাতে পাখির সেই কিচিরমিচির। লোকটাকে ভয় পেতে দেখে সবার সে কী হাসি।
রাতে টুনি গেল বাবুইয়ের বাসায়। শেষ খাবারটুকুও ছানাগুলোকে খাওয়াল মা আর বাবা বাবুই। মা বাবুই বলল, কাল এ বাসা ছেড়ে আমরা চলে যাব। তুই আমাদের সঙ্গে যাবি টুনি?
টুনি কিছু না বলে মন খারাপ করে নিজের বাসায় গেল। তার কোথাও যেতে মন চায় না। কিন্তু বাবুইরা চলে গেলে সে একা হয়ে যাবে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল টুনি আর বাবুইদের। দূর আকাশে দেখল কালো কী যেন ছুটে আসছে।
‘আবার ঝড়টড় নাকি!’
ভয়ে ভয়ে বলল বাবা বাবুই।
‘নাহ, ঝড় তো এভাবে ঝাঁক বেঁধে আসে না। ’ বলল মা বাবুই।
টুনি খানিকটা উড়ে গেল। তারপর ফিরে এসে বলল, ঝাঁক বেঁধে কাক আর চিল আসছে! মনে হয় ওরা ঢাকা থেকে আসছে।
একটু পরই শালিকপাড়া গ্রামে অবাক করা ঘটনা ঘটল। শয়ে শয়ে পুঁটলি পড়ল আকাশ থেকে। ছোট ছোট পুঁটলি। গাছের পাতা আর খড়কুটো দিয়ে বানানো। পুঁটলিগুলো ডুবল না। ভাসছে সব কটি।
একটু পর শালিকপাড়া গ্রামে যেসব পাখি ছিল তারা উড়ে এলো। ভাসতে থাকা পুঁটলি কুড়িয়ে নিতে শুরু করল। কারণ কাক আর চিলেরা জোরে জোরে বলছে, কা কা চিঁ চিঁ। মানে পুঁটলিতে চাল-গম আছে। যার লাগবে নিয়ে নাও।
টুনি আর বাবুইও ছুটল দানার পুঁটলি কুড়াতে। অনেক পুঁটলি কুড়ালো। এমন সময় একটা কাক দেখল টুনিকে।
‘তুমিই না? আরে! তুমিই তো সেই টুনটুনি। কী কাণ্ড!’
‘তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। এত দূর উড়ে এলে। ’
‘আরে, তোমার ভিডিও তো ভাইরাল হয়ে গেছে। না এসে কি আর পারি। ’
কোন ভিডিও? আরে ওই যে নৌকায় যে পাখি নিয়ে হৈচৈ হলো, সেটাই। ওই সাহসী পাখিটা আর কেউ নয়, আমাদের টুনি।
পাখির কথা তো আর মানুষরা বোঝে না। বুঝলে তারা শুনত যে ভিডিওতে টুনি বলেছে, ‘পাখি ভাইয়েরা, আমাদের বড় দুর্দিন। ঘরে দানাপানি নেই। আপনারা চাল, গম নিয়ে আসুন। ছানারা না খেয়ে আছে। ’
এটা শুনে কাক ও চিলের দল মিলে রাতারাতি জমানো চাল-গম পুঁটলিতে ভরে রাতেই রওনা দেয়।
আকাশ থেকে পাখিদের পুঁটলি ফেলার দৃশ্যটা অনেক মানুষ দেখেছে। তবে ভিডিও করার কেউ ছিল না। মুখে মুখে সেদিনের ঘটনাটা তাই বেশি দূর গড়ায়নি।