বাঁ থেকে দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা নাফিস ফয়সাল এবং মুহিমিনুল ইসলাম
বর্তমানে ভিডিওর যুগ চললেও ওয়েবসাইটের লেখাগুলোর ওপর ভিত্তি করেই সার্চ ইঞ্জিনগুলো কাজ করে। অনলাইনে লেখালেখির বিকল্প নেই, হোক সেটা ভিডিও কনটেন্টের বিবরণ বা সফটওয়্যারের টেকনিক্যাল ডকুমেন্টেশন, ব্যক্তিগত ব্লগ বা লিংকড-ইনের প্রফাইল। শব্দের সঠিক ব্যবহার অনলাইন ক্যারিয়ারকে করে সফল।
লেখালেখির সবচেয়ে কঠিন অংশ হচ্ছে শুরু করাটা।
বিজ্ঞাপন
যেভাবে শুরু
ধরুন কয়েকজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী মিলে একটি ছোট ফার্ম করলেন। সব ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু কনটেন্ট মার্কেটিং নিয়ে পড়লেন বিপদে। টেকনিক্যাল ডকুমেন্টেশন, সফটওয়্যার নিয়ে ব্লগ থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং—সব কিছুই সমানভাবে চালাতে না পারলেও নিজেদের তৈরি করা সফটওয়্যার পৌঁছাতে পারছেন না কাঙ্ক্ষিত গ্রাহকদের কাছে। অথচ নিজেদের সেই সময় ও সামর্থ্যও নেই যে নিজেরাই সেগুলো করার বা একজন দক্ষ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার। এসব সমস্যা কিভাবে প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাধান করা যায় সেই ভাবনা থেকেই আসলে ‘কপিরাইটারপ্রো’-এর সূচনা। একসময় কপিরাইটারপ্রোর মূল সেবাই হয়ে ওঠে কপিরাইটারপ্রো, নিজেদের কাজের পাশাপাশি সেটি অন্য ব্যবহারকারীদের জন্যও উন্মুক্ত করে তারা। এআইচালিত নানা ধরনের লেখাভিত্তিক কনটেন্ট তৈরির টুলস নিয়ে এরই মধ্যে বেশ কিছু সংস্থা কাজ করছে, যদিও তাদের লক্ষ্য এআই দিয়ে নিখুঁত লেখা তৈরি, তবে কপিরাইটারপ্রোর লক্ষ্য এসইওকেই প্রাধান্য দিয়ে করা কনটেন্ট লেখা।
পেছনের মানুষেরা
কপিরাইটারপ্রো তৈরির পেছনে আছে মাত্র চারটি নাম। দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা নাফিস ফয়সাল এবং মুহিমিনুল ইসলাম মূল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে শুরু করেন এই প্রজেক্ট। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সবুজ আলী এবং অ্যানালিস্ট হিসেবে আবু রায়ান। মুক্ত সোর্স কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রজেক্ট ‘ওপেনএআই’-এর ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব ভাষার মডেল ব্যবহারে তাঁদের এআইকে মেশিন লার্নিং পদ্ধতিতে ট্রেনিং দেওয়া হয়। মজার বিষয়, তাঁদের এআই প্রতিবার ব্যবহারের সময়ই হয়ে ওঠে আরো নিখুঁত। যত বেশি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়বে, ততই কপিরাইটারপ্রো হয়ে উঠবে আরো কার্যকর।
লেখকের সাহায্যকারী
বিষয়বস্তুর মূল শব্দগুলো বা কি-ওয়ার্ড প্রবেশ করিয়ে সেবাটির মাধ্যমে তৈরি করা যাবে হেডলাইন, সেবা ও পণ্যের বিবরণ থেকে শুরু করে আস্ত ব্লগ আর্টিকল। এমনকি তাদের সেবার মাধ্যমে পরবর্তী ব্লগের সম্ভাব্য বিষয়বস্তুর
তালিকাও পাওয়া যাবে। তবে বর্তমানে লেখার মানের পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ এর এসইও ঠিক আছে কি না সেটা দেখা। যদি এসইও ঠিক না থাকে, তাহলে ওয়েবসাইটটি গুগল বা বিংয়ের মতো সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছবে না। শুধু এসইও ঠিক না থাকায় সঠিক পণ্য থাকার পরও কাঙ্ক্ষিত ক্রেতাদের কাছে না-ও পৌঁছতে পারে ই-কমার্স সাইটগুলো। সেটির সমাধানেও আছে কপিরাইটারপ্রোর এসইও টুলস। পণ্য ও সেবার বিবরণ বিশ্লেষণ করে এসইও ঠিক করার কাজটি করতে সক্ষম এই টুলস।
সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং প্রতিটি ব্র্যান্ডের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেই কাজেও কপিরাইটারপ্রো অত্যন্ত কাজের। ফেসবুক, টুইটার থেকে শুরু করে ইউটিউব ও টিকটকের ভিডিওর জন্য ক্যাপশন ও ডেসক্রিপশন তৈরিতেও সিস্টেমটি কাজ করে। সঙ্গে আছে লিংকড-ইন প্রফাইলের জন্য টেক্সট তৈরিও। অনলাইনে যেখানেই লিখিত কনটেন্ট প্রয়োজন, সেখানেই সাহায্য করবে কপিরাইটারপ্রো।
তবে কয়েকটি শব্দ প্রবেশ করিয়ে দিলেই কাজ শেষ, বিষয়টি তা কিন্তু নয়। এখনো এআইর লেখা শতভাগ নির্ভুল নয়, প্রথম চেষ্টায়ই প্রাসঙ্গিক লেখনীও সব সময় পাওয়া যায় না। এটা মূলত এআইর ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের সীমাবদ্ধতা, যেটা দ্রুতই তাঁরা কাটিয়ে উঠবেন বলে জানিয়েছেন এটির নির্মাতারা। ফলে কপিরাইটারপ্রো সরাসরি লেখক নয়, বরং লেখকের সাহায্যকারী বলাটাই শ্রেয়।
আপাতত ইংরেজিতেই
আপাতত শুধু ইংরেজি নিয়েই কাজ করছে কপিরাইটারপ্রো দল। তাঁদের এ সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে মূলত দুটি কারণ, প্রথমত বাংলায় সার্চ করার পরিমাণ এখনো এত অল্প যে, এসইওর ক্ষেত্রে বাংলা খুব একটা কাজের নয়। যেহেতু তাঁদের লক্ষ্য এসইও আগে, তাই স্বল্প পরিসরে চালু করা সেবার একাধিক ভাষা সমর্থন করার দায়িত্ব নিতে তাঁরা প্রস্তুত নন। দ্বিতীয় এবং আরো বড় সমস্যা—ইংরেজি ভাষার যে পরিমাণ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে, তার ধারে-কাছেও নেই বাংলার ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল। বাংলা ভাষার ধরন, ব্যাকরণ এবং পরিব্যাপ্তি ইংরেজির চেয়ে বহু গুণ বেশি, ফলে কপিরাইটারপ্রো দিয়ে বাংলা কনটেন্ট তৈরি করতে হলে শুরুতেই বাংলার জন্য জটিল এবং শ্রমসাধ্য ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল তৈরি করতে হবে। সেটা ভবিষ্যতে হয়তো সম্ভব, তবে এখনই নয়।
যেভাবে মিলবে সেবা
সেবাটি চালু করার এক বছরের মধ্যেই কয়েক শ গ্রাহক কপিরাইটারপ্রো ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ইয়েলো র্যাপ্টর, স্ক্রিবলারসের মতো বড়সড় আন্তর্জাতিক কম্পানিও আছে। এখন পর্যন্ত সেবাটিকে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা হয়নি বলে দাবি করেছেন এটির নির্মাতারা, বিশেষ করে ইন্টারফেসে বড়সড় পরিবর্তন আসছে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই। সেবাটি সবার জন্য এখনই উন্মুক্ত করে দেওয়ার মূল কারণ এআইকে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য বাস্তব তথ্য সংগ্রহ, যাতে দ্রুতই সেটি হয়ে ওঠে আরো নির্ভুল।
কপিরাইটারপ্রো নিজে চালিয়ে দেখতে চাইলে ওয়েবসাইট www.copywriterpro.ai-তে প্রবেশ করে তৈরি করতে হবে অ্যাকাউন্ট। প্রথম সাত দিন বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যাবে, এরপর ব্যবহার করতে চাইলে কিনতে হবে সাবস্ক্রিপশন। প্রায় সব ফিচার এখনই ব্যবহার করে দেখা যাবে, তবে সবচেয়ে কাজের বলা যায় ই-কমার্সের জন্য প্রডাক্ট ডেসক্রিপশন তৈরি করা, ব্লগের জন্য হেডলাইন তৈরি এবং ভিডিও ও লিংকডইনের জন্য ডেসক্রিপশন জেনারেট করা।
ব্লগ ঘোস্টরাইটার ফিচারটিও চমৎকার, ব্লগ পোস্টের জন্য হেডলাইন তৈরি থেকে শুরু করে কি-ওয়ার্ড এবং নিজের লেখা কিছু অংশ ব্যবহার করে বড়সড় প্যারাও লিখে ফেলা যাবে এআইর মাধ্যমে। যাঁরা ব্লগিং করেন, তাঁদের অনেক সময় একঘেয়ে প্যারাগ্রাফ লিখতে বিরক্ত লাগতে পারে—সেই সময় এআইয়ের মাধ্যমে কাজ এগিয়ে নেওয়া যাবে সহজেই।
ওয়েবসাইটের পাশাপাশি কপিরাইটারপ্রো অ্যানড্রয়েড এবং আইওএস থেকেও অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহার করা যাবে, সেগুলোর লিংকও পাওয়া যাবে মূল ওয়েবসাইটেই।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে সহপ্রতিষ্ঠাতা নাফিস বলেন, ‘আপাতত আমরা গ্রাহকসংখ্যা বাড়ানো, ফিচারগুলোকে আরো নিখুঁত করা এবং এটির মার্কেটিং প্ল্যান নিয়ে কাজ করছি। আমরা বিনিয়োগকারীও খুঁজছি, দেশি-বিদেশি বেশ কিছু বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কাজ চলছে। ভবিষ্যতে মার্কেটিং ফার্মগুলোর সঙ্গেও কাজ করার আশা আছে আমাদের। তবে সবার আগে আমাদের করতে হবে টুলটি ব্যবহারের মূল্য নির্ধারণ করা এবং পেমেন্ট সিস্টেম আরো সহজ করা। আপাতদৃষ্টিতে দেখে খুব সাধারণ ইন্টারফেসের একটি ওয়েবসাইট মনে হলেও এর চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং জটিল সার্ভার, ফলে কপিরাইটারপ্রো বিনা মূল্যে দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়—তবে এই সেবার কার্যপরিধির তুলনায় অবশ্যই ফি ধরা হয়েছে যথেষ্ট কম। একদিন বাংলা এবং আরো নতুন সব ভাষায়ও কাজ করবে এই সেবা, সে ব্যাপারেও তিনি আশাবাদী।