অনেক সময় সঙ্গীহীন বা একক অবস্থানের মাধ্যমে স্থিতাবস্থা রক্ষা করা যেতে পারে। বিশেষ করে এ ধরনের অবস্থান এমন একসময়ে প্রয়োজন, যখন জনতুষ্টিবাদী ও বাকপটু নেতাদের হাতে রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। কূটনীতিতে সর্বোত্তম বিকল্প হলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিষয়গুলো যেভাবে আছে সেভাবে রাখা। এমনকি এর অর্থ যদি হয় অসংগতি ও অনিশ্চয়তাকে মেনে নেওয়া, তাহলেও তা-ই করতে হয়।
বিজ্ঞাপন
ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর এই ভারসাম্য নষ্ট করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের এই স্পিকার ১৯৯৭ সালের পর দ্বীপটিতে পা রাখা সবচেয়ে প্রবীণ মার্কিন রাজনীতিক। প্রণালিজুড়ে চীনের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে তাইওয়ানের প্রতি সংহতির প্রকাশ হিসেবে তাঁর সফরটি তাইওয়ানের স্থিতির বিষয়ে ওয়াশিংটনের ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’র লঙ্ঘন বলেই মনে হচ্ছে। তাইওয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত নয়, কিন্তু একটি সার্বভৌম দেশ (আত্মরক্ষায় সশস্ত্র) হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।
অতীতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কিছু বক্তব্যও এই কৌশলগত অস্পষ্টতাকে আঘাত করেছে এই প্রশ্নে যে আগ্রাসনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান রক্ষায় কত দূর অগ্রসর হতে পারে। তবে পেলোসির এই সফর এই অস্পষ্টতার সীমা মারিয়ে রীতিমতো একটি সংকট তৈরি করেছে। বেইজিং তাঁর এই সফরকে আক্রমণাত্মক উসকানি হিসেবে বিবেচনা করে এর নিন্দা জানিয়েছে। তারা তাইওয়ান দ্বীপের চারপাশের জলসীমায় লাইভ-ফায়ার মিলিটারি এক্সারসাইজের (বাস্তবিক গোলাবর্ষণ মহড়া) মাধ্যমে সফরের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে।
সম্ভবত এই মহড়া সর্বাত্মক আক্রমণের কোনো পূর্বাভাস দিচ্ছে না। কিন্তু তাইওয়ান উদ্বিগ্ন হওয়ার যৌক্তিক কারণ রয়েছে, বিশেষ করে যখন উপকূলের এত কাছে অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যায়। ভুল-বোঝাবুঝি বা অতি উৎসাহী প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে খুব বেশি কিছু লাগে না। বাইরের পর্যবেক্ষকদের জন্য অস্বস্তিকর বাস্তবতা হলো তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের হিসাব-নিকাশ অস্বচ্ছ।
চীনের দীর্ঘ অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ হঠাৎ ধীর হয়ে গেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের কর্তৃত্ব এখনো অনেক, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য নয়। এটি স্পষ্ট নয় যে এই পরিস্থিতি সামরিক অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে তাঁর জুয়া খেলার সম্ভাবনা কম বা বেশি করে তোলে কি না। ইউক্রেনে ভ্লাদিমির পুতিনের ভূমি দখল বন্যতা পশ্চিমা বিশ্লেষকদের নিজস্ব পূর্বাভাসের প্রতি আস্থাকে নষ্ট করে দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের বেশির ভাগই ভেবেছিলেন, পুতিন জাতীয় স্বার্থের যৌক্তিক মূল্যায়নের মাধ্যমে ইউক্রেন আক্রমণ থেকে সংযত থাকবেন।
তুলনা সব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় না। রাশিয়া হলো একটি আঞ্চলিক উত্পীড়ন, যে পতনে ক্ষিপ্ত। চীন হচ্ছে একটি বৈশ্বিক পরাশক্তি। মার্কিন মিত্রের বিরুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্রাসনের যুদ্ধের সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিগুলো অপরিমেয়ভাবে বেশি। এমনকি যদি পশ্চিমা দেশগুলো চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির প্রত্যক্ষ সামরিক তৎপরতা রুখে দিতে পারে, তার পরও ঝুঁকি কমে না।
হোয়াইট হাউস চেয়েছিল মিসেস পেলোসি যাতে কূটনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করেন, কিন্তু সফরটি একবার নির্ধারিত হয়ে যাওয়ায় সেটা এগিয়ে নিতে হয়েছিল। কারণ সফল বাতিল করার অর্থ হতো, তাইওয়ানে কে যেতে পারবে বা পারবে না, সে ব্যাপারে চীনকে বৈশ্বিক ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা দেওয়া। আর কোনো সম্পর্ক দীর্ঘকাল ধরেই এই ধরনের ক্রমাঙ্কন দ্বারা নির্ণয় করা হচ্ছে। শান্তি কিভাবে বজায় থাকে? শান্তি বজায় থাকে, কারণ এটি কূটনৈতিক সুক্ষ্মতা ও হিসাব-নিকাশ করা অনিশ্চয়তার মধ্যে উত্তেজনাহীন দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়।
তাইওয়ান প্রণালিতে বর্তমান দুই পক্ষের বাদানুবাদ ও সর্বাত্মক যুদ্ধের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ার অনেক পর্যায় রয়েছে। বেইজিং সাইবার নাশকতার মাধ্যমে তাইওয়ানকে অতিষ্ঠ করে তুলতে পারে। সামরিক মহড়াগুলো অর্থনৈতিক অবরোধের মতোই দীর্ঘায়িত হতে পারে। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে যেখানে উত্তেজনা বাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে, সেখানে উত্তেজনা প্রশমনের ক্ষেত্রও রয়েছে। তাইওয়ান প্রণালির আগের সংকটগুলো অস্বস্তিকর ভারসাম্য আনয়নের মাধ্যমে সুরাহা করা গেছে। এখনো এটাই সর্বোচ্চ ভালো ফল দিতে পারে এবং সহজলভ্যও, যদি ঠাণ্ডা মাথা ও অনাকাঙ্ক্ষিত পছন্দ বজায় রাখা যায়।
সূত্র : সম্পাদকীয়, দ্য গার্ডিয়ান (যুক্তরাজ্য), ভাষান্তরিত