১৪ বছরের এক কিশোর এত ভয়ংকর হতে পারে? অভিযোগ রয়েছে, একটি মোবাইল ফোনের জন্য পরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় সে প্রথমে বন্ধুকে খুন করে এবং লাশ গুম করার চেষ্টা করে। এরপর মোবাইল ফোনসেট বিক্রির টাকায় হোটেলে বান্ধবীকে নিয়ে সময় কাটানো। এখানেই শেষ নয়, অন্য বন্ধুকে ফোনে ডেকে এনে বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটানোরও সুযোগ করে দিয়েছে সে। তারপর মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় খুনি কিশোরকে টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তার করেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা।
বিজ্ঞাপন
বলছি, বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার স্কুলছাত্র নওফেল শেখ (১৪) হত্যাকারী কিশোরের কথা। বগুড়া পুলিশ সুপারের সংবাদ সম্মেলন শেষে গত ২৮ জুন বিকেলে প্রথমে খবরটি বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যমে আসে। প্রকাশিত সংবাদে অভিযুক্ত কিশোরের নাম প্রকাশ করা হয়নি!
খুনের সব ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণ করে কি কারো মনে হবে এটা শিশুর কাজ? কোনো শিশুর পক্ষে এ ধরনের ভয়ংকর ঘটনা ঘটানো সম্ভব! তাই পুরো বিষয়টি ভাবতেই অবাক লাগে।
আইনের দৃষ্টিতে সে শিশু, কিন্তু অপরাধ বিবেচনায় নিলে রীতিমতো ভয়ংকর। যদিও গত কয়েক বছরে দেশে শিশুরা অনেক ভয়াবহ ঘটনার জন্ম দিয়েছে, যা রীতিমতো গা শিউরে ওঠার মতো। এর মধ্যে কিশোর গ্যাং কালচার সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক ও আতঙ্কের নাম। গ্যাং কালচার নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরাও হিমশিম খাচ্ছেন।
গত ২৭ জুন সকালে সভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার এঙ্গেলদানি গ্রামের মৃত অজিত সরকারের ছেলে উৎপল কুমার সরকার (৩৫)। তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের কলেজ শাখার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ছিলেন।
২৫ জুন দুপুরে স্কুলমাঠে শিক্ষককে স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক মারধর করে এই স্কুলের এক শিক্ষার্থী। পুলিশ বলছে, নিহত উৎপল কুমার সরকার প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি থাকায় নিয়ম-কানুন মানাতে শিক্ষার্থীদের শাসন করতেন। তিনি ওই শিক্ষার্থীকেও শাসন করায় এ ঘটনা ঘটায়।
স্থানীয়রা বলছেন, অভিযুক্ত দশম শ্রেণির ওই শিক্ষার্থী এলাকার কিশোরদের নিয়ে একটি ‘কিশোর গ্যাং’ পরিচালনা করে। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে কলেজে একাধিকবার তার বিচারও হয়েছে।
গত মঙ্গলবার বগুড়ায় বন্ধুর হাতে বন্ধু খুনের ঘটনা উল্লেখ করে পুলিশ সুপার বলেন, ‘গ্রেপ্তার কিশোর পড়াশোনা না করলেও নওফেল ছিল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা দাড়িগাছা গ্রামের বিভিন্ন জঙ্গলে গিয়ে মাঝেমধ্যেই ধূমপান করত। দুই মাস আগে জমি বিক্রি করে ১৮ হাজার টাকায় একমাত্র ছেলে নওফেলকে স্মার্টফোন কিনে দেন বাবা। এর পর থেকেই নওফেলের ফোনটি হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে তার বন্ধু। ’
তিনি আরো বলেন, ‘১৮ জুন নওফেলের জন্মদিন ছিল। এদিন সকাল ১১টার দিকে নওফেলকে ধূমপানের কথা বলে কৌশলে জঙ্গলে নিয়ে যায় তার ওই বন্ধু। জঙ্গলের একটি ইউক্যালিপটাসগাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে ধূমপানের সময় নওফেলের গলায় মাফলার পেঁচিয়ে গাছের সঙ্গে ফাঁস দেয় বন্ধু। নওফেল নিস্তেজ হয়ে পড়লে তার বন্ধু পাশের জমি থেকে একটি বাঁশের খুঁটি এনে নওফেলের মাথায় আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর মরদেহ গভীর জঙ্গলে ফেলে দিয়ে মোবাইল সেটটি নিয়ে সেখান থেকে চলে যায় সে। ’
পুলিশ সুপার বলেন, ‘ওই কিশোর বগুড়ার শেরপুর থেকে তার এক বান্ধবীকে শহরে ডেকে নেয়। দুজন একত্রে নিজেদের ভাই-বোন পরিচয় দিয়ে শহরের সাতমাথায় একটি দোকানে পাঁচ হাজার টাকায় মোবাইল ফোনটি বিক্রি করে। সেখান থেকে তারা দুজন বগুড়া শহরের গালাপট্টির একটি আবাসিক হোটেলে গিয়ে একটি রুম ভাড়া করে। ’
হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর ২০ জুন বিকেলে জঙ্গল থেকে দুর্গন্ধ বের হলে স্থানীয় লোকজন গিয়ে নওফেলের মরদেহ শনাক্ত করে। এর পর থেকেই তার বন্ধু পলাতক ছিল। উদ্ধার হওয়া ফোনের সূত্র ধরে আটক করা হয় নিহতের বন্ধুর কথিত বান্ধবীকে। পরে পুলিশের একটি দল নিহতের বন্ধুকে ঢাকার টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তার করে।
প্রশ্ন হলো, বয়সের কারণে একটি শিশু বা কিশোর তো তার স্বভাবসুলভ কাজটি করছে না। সে ভয়ংকর পথে পা বাড়িয়েছে। এই সর্বনাশা পথ নিজেকে যেমন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তেমনি সঙ্গদোষে তার সঙ্গে অনেকেই অন্ধকার পথে আসছে। পরিবারও পথে বসছে। অথচ শিশু-কিশোররা এ রকম বেপরোয়া পথে যাচ্ছে কি এক দিনে। এ জন্য কি পরিবারের কোনো দায় নেই?
যদিও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মাদকসহ নানা কারণ রয়েছে। প্রশ্ন হলো, কারণ যাই থাক না কেন, অপরাধী হওয়ার আগেই বিপজ্জনক পথ থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হবে। তেমনি তারা যেন নষ্ট জগতে পা না রাখতে পারে সে জন্য সতর্ক দৃষ্টি রাখার বিকল্প নেই। এ জন্য অভিভাবক থেকে শুরু করে সমাজের সবার অংশগ্রহণ জরুরি।
আইনে নানাভাবে শিশুদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তেমনি অপরাধ করা শিশুদের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা। বাস্তবতা হলো, এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিশোর অপরাধীদের বিচারের দাবি উঠেছে। এ জন্য আমেরিকা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে শিশু আইনে নানা রকম সংস্কারও আনা হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে, একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধী প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তার বিচার শুরু হতে পারে। তেমনি দণ্ডের ক্ষেত্রে পূর্ণবয়স্কদের মতো না হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন। এ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারকদের কপালে রীতিমতো চিন্তার ভাঁজ। অন্তত ভয়ংকর অপরাধের ক্ষেত্রে কিশোর অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার বিষয়ে অনেকে এখন একমত।
শেষ পর্যন্ত সাভারে ছাত্রের হাতে শিক্ষক হত্যা ও বগুড়ায় বন্ধুর হাতে বন্ধু খুনের ঘটনার বিচার হয়তো শিশু আইনেই হবে। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে আইনের ক্ষেত্রে কিছু সংশোধনী আনা প্রয়োজন বলে অনেকেই মনে করেন। এ ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানীদের আরো বেশি কাজ করার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ কিভাবে কিশোর অপরাধকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যায় এ নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক