<p>শিশুদের জন্য যে পরিমাণ খেলার মাঠ থাকা দরকার সেটি আমাদের দেশে নেই। আমরা সব সময় বলি, শিশুদের প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে হবে, খেলাধুলা করাতে হবে। কিন্তু সেটি কি আমরা করতে পারছি? মাত্র কয়েক দশক আগেও মাঠ ছাড়া স্কুল-কলেজ কল্পনা করা না গেলেও এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাণ খুলে দৌড়ানোর, খেলাধুলা করার জায়গা নেই বললেই চলে। শিশুরা এখন বিদ্যালয়ে গিয়েও ঘরবন্দি, আবার বাড়িতেও ঘরবন্দি। মুক্ত বাতাসে, সবুজ ঘাসে ঘুরে বেড়ানো, খেলাধুলা—কোনোটিই করতে পারছে না শিশুরা।</p> <p>আমি আমার শিশুসন্তানকে তার ক্লাস শুরু হওয়ার প্রায় এক ঘণ্টা আগে বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিই, যাতে সে তার বন্ধুদের সঙ্গে খোলামনে অনেকটা সময় খেলতে পারে। ক্লাস ছুটি হওয়ার পর আমি বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের পাশে যতটা সময় সম্ভব দাঁড়িয়ে থাকি। যতক্ষণ তার বন্ধুরা মাঠে একসঙ্গে খেলতে পারে, ততক্ষণ আমি তাকে সুযোগ দিই খেলার জন্য। আমি লক্ষ করেছি, খেলতে পারলে আমার শিশু খুব প্রাণবন্ত থাকে। আনন্দিত হয়। বাসায় আসতে আসতে তার শ্রেণিকক্ষে কী পড়াশোনা হলো, সেই আলাপের চেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তার খেলার অভিজ্ঞতা বেশি বেশি শুনতে চাই। সে খুব আনন্দের সঙ্গে আমাকে তার খেলার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—দেশের সব শিশু কি আনুষ্ঠানিকভাবে খেলার মাঠ পাচ্ছে? কিংবা শিশুদের মা-বাবা কি শিশুকে খেলার দিকে মনোযোগ দেওয়াতে পারছে?</p> <p>খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, রাজধানীসহ সারা দেশে এখন কোচিং সেন্টারের মতো বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেগুলোতে কোনো ধরনের খেলাধুলা করার সুযোগ নেই। এমনকি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বহু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ন্যূনতম খেলার মাঠ নেই।</p> <p>অথচ সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও খেলাধুলার গুরুত্ব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা-বিবৃতি আমরা শুনে থাকি। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে, বিশেষ করে অভিভাবকদের তাঁদের শিশুদের বাইরে খেলাধুলা করতে উৎসাহিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে সহায়ক হবে এমন কিছু নির্দেশনাও ছিল তাঁর বক্তব্যে। কিন্তু এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের কোনো পরিবেশই দেখা যাচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে সামনে খোলা জায়গা না থাকায় কোমলমতি শিশুরা ছোটাছুটি করতে বা দৌড়াতে পারে না। শিশুরা মা-বাবার হাত ধরে এসে ক্লাসরুমে প্রবেশ করে এবং ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে যায়।</p> <p>রাষ্ট্রচিন্তাবিদ প্লেটোর মতে, ‘শৈশবকালীন খেলা হচ্ছে পরবর্তী জীবনের জ্ঞানের ভিত্তি।’ শিশুর বিকাশের জন্য খেলা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাটনি স্মিথ বলেছেন, ‘অনুকরণ, অনুসন্ধান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গঠন—এই চারটি মূল প্রক্রিয়ায় আমরা পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি, শিশুর খেলা সেই চারটি প্রক্রিয়া নিয়েই গঠিত। শারীরিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মানসিক, সামাজিক, আবেগ বিকাশেও খেলাধুলার গুরুত্ব অনেক। খেলার মাধ্যমে শিশুর সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি, সামাজিক জ্ঞানবোধ, সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব এবং নেতৃত্বগুণ বিকশিত হয়।’</p> <p>বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী প্রতিটি শিশুর জন্য দিনে অন্তত এক ঘণ্টা বাইরে খেলাধুলা করার পরামর্শ দিয়ে থাকে। আমাদের প্রতিটি সন্তান কি সেই সুযোগ পাচ্ছে? আর এই সুযোগ পাচ্ছে না বলে অভিভাবকরাও অনেকটা দুশ্চিন্তায় থাকেন।</p> <p>প্রাথমিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো নৈতিক, মানসিক, সামাজিক আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিক বিষয়ে শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ও উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সামর্থ্য, প্রবণতা ও আগ্রহ অনুসারে তাকে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা এবং পরবর্তী স্তরে শিক্ষালাভের উপযোগী করে গড়ে তোলা আবশ্যক। আর এসবের জন্য মূলত যেটি প্রয়োজন সেটি হলো নিয়মিত খেলাধুলা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দিন দিন আমাদের দেশের খেলার মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। সুন্দর সুন্দর বাড়ি তৈরি হচ্ছে। রাস্তার পাশে জমি ভরাট করে কমিউনিটি সেন্টার তৈরি হচ্ছে। মফস্বল এলাকায় বিভিন্ন শপিং সেন্টার হচ্ছে। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য কোনো খেলার মাঠ তৈরি হচ্ছে না।</p> <p>ব্যাহত হচ্ছে শিশুর সৃজনশীলতা। নৈতিক চরিত্রের বিকাশও চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ইদানীং দেশে যে কিশোর গ্যাং কালচার শুরু হয়েছে, সেটিও মূলত শিশুদের খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ-সবল যুবসমাজ প্রয়োজন। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এতে তারা যেমন সম্মানিত হবেন, তেমনি জাতিও বেড়ে উঠবে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে।</p> <p>একসময় বিকেলবেলাটা শিশুর খেলাধুলার জন্য বরাদ্দ থাকলেও এখন পড়াশোনার চাপ সামলাতে পড়ন্ত বিকেলেও শিশুকে বই-খাতা নিয়ে এ কোচিং থেকে সে কোচিং ছুটতে হয়। অন্যদিকে যখন সময় পায় তখনো মাঠ কিংবা খোলা জায়গার অভাবে শিশুরা খেলাধুলা করতে পারে না। খেলাধুলা না করায় বর্তমানে শিশু-কিশোরদের অবসর কাটে টিভি, মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা ভিডিও গেমসে, যা শিশুর বিকাশের পথে অন্তরায়।</p> <p> </p> <p>লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>sultanmahmud.rana@gmail.com</p>