যুগোস্লাভিয়ার জনগণের ওপর ন্যাটোর বোমা হামলার ২৩ বছর পূর্তিতে গত ২৩ মার্চ সার্বিয়ার হাজার হাজার মানুষ অশ্রুসজল চোখে মোমবাতি প্রজ্বালন করে। বাস্তবিক অর্থে চীনও এ যুদ্ধের শিকার। ১৯৯৯ সালের ৭ মে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট যুগোস্লাভিয়ার চীনা দূতাবাসে বোমা হামলা করে তিন চীনা সাংবাদিককে হত্যা করে এবং এ হামলায় ২০ জনেরও বেশি চীনা কূটনীতিক আহত হন। তবে এটা বেশ বিভ্রান্তিকর যে ইউরোপ ও আমেরিকার সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও মতমোড়লদের উল্লেখযোগ্য অংশ নির্লজ্জভাবে ১৯৯৯ সালে যুগোস্লাভিয়ায় হামলার পক্ষে যুক্তি দেখায় এবং ‘ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ’-এর কৌশলটির মাধ্যমে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্য গর্বের সঙ্গে ন্যাটোর ভূমিকাকে সমর্থন করে।
বিজ্ঞাপন
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মার্কিন ‘কনটেইনমেন্ট’ কৌশলের জনক জর্জ এফ কেনান ১৯৯৭ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি নিবন্ধে এ মর্মে সতর্ক করেন যে ‘ন্যাটোর সম্প্রসারণ পুরো স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে আমেরিকান নীতির সবচেয়ে প্রকট সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ’ কেননা তিনি আগে থেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেন ন্যাটোর ভূমিকা কী হতে পারে এবং এ বিষয়টি এখন একটি কঠিন বাস্তবতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ইউরোপের এই নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থাকে একসময় এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বাকি দেশগুলোর জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখা হতো; কিন্তু আজ এ বিষয়টি শান্তি ও ঐক্য বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউক্রেন সংকট বিশ্বকে দেখিয়েছে, সংকটের সূত্রপাত হয়েছে অনেক আগেই। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে মোকাবেলা করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ন্যাটোর দিকে ঝুঁকেছেন। অথচ বর্তমানের পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় বলা যায়, অতীতে সংকটের সমাধান না করাটাই বর্তমানের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জার, উইলিয়াম বার্নস, ম্যালকম ফ্রেজার, জ্যাক ম্যাটলক, এডওয়ার্ড লুটওয়াক, ওয়েন হ্যারিস, স্যাম নান, পল নিেজ, উইলিয়াম পেরিসহ নীতিনির্ধারক ও কৌশলবিদরা ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য পদ লাভের বিরুদ্ধে ছিলেন। ১৯৯৯ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মার্কিন ‘কনটেনমেন্ট’ কৌশলের জনক জর্জ এফ কেনানের সতর্কবার্তা ছিল, ন্যাটো সম্প্রসারণ করা স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে আমেরিকান নীতির সবচেয়ে প্রকট সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সেটি এখন সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।
বিশ্ব শান্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য কেনান ও কিসিঞ্জারের মতো উদারপন্থী আন্তর্জাতিকতাবাদী ও বাস্তববাদীরা ইউক্রেনকে ন্যাটোর বাইরে রাখার পক্ষে ছিলেন; একই সঙ্গে একটি যৌথ নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। শক্তিধর দেশগুলো বিভক্ত হতে পারে এমন পরিস্থিতি এড়াতে তাঁরা এ অনুরোধ করেন। কারণ এতে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো দুটি জোটে ভাগ হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর এর ন্যাটো মিত্রদের রাশিয়া ও চীনের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করাবে। দায়িত্ব গ্রহণের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ‘তাদের জোটকে পুনর্গঠন এবং আবারও বিশ্বের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন’, কিন্তু বর্তমানে এই সংকট নিরসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ অবস্থান প্রত্যক্ষ করে এটি বিশ্বের জন্য দিবাস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে।
ইউক্রেন সংকট এখন বহু হুমকির কারণ। এটি ইউরোপজুড়ে শান্তিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক কৌশলগত লক্ষ্যগুলোকে পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। পুতিন একটি সতর্কবাণী জারি করে বলেন, যে দেশগুলো রাশিয়ার বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তারা এমন পরিণতির মুখোমুখি হবে, ‘যা কেউ ইতিহাসের কোনো পর্যায়ে মুখোমুখি হয়নি। ’ এটি বাল্টিক অঞ্চলের নতুন ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোসহ ইউরোপের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাইডেন এর আগে তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন, ‘ইউক্রেনে যুদ্ধ করার জন্য আমেরিকান সেনা পাঠানোর কোনো ইচ্ছা তাঁর ছিল না’ এবং তিনি আরো বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সরকারকে সামরিক সরঞ্জাম, বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যাতে তারা যেকোনো আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে। ’ এর মাধ্যমে তিনি একটি সুস্পষ্ট বার্তা প্রদান করেন যে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সঙ্গে মিলে ন্যাটো অঞ্চলের প্রতি ইঞ্চি ভূমি রক্ষা করবে। ’ সুতরাং তিনি যদি ন্যাটো অঞ্চলের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করতে চান, তাহলে এটি ভিলনিয়াস, রিগা ও তালিনের মতো বাল্টিক রাজ্যগুলোকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য একটি পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি শুরু করবে। যুক্তরাষ্ট্র কি এ ঝুঁকি গ্রহণ করবে?
তাহলে এ পরিস্থিতি এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য কী কী জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে? সর্বোপরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার দিকে ভারসাম্য বজায় রাখতে কোন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল এবং এখন তথাকথিত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সূচনা করছে? এখন তারা কোয়াড নামে ‘এশিয়ান ন্যাটো’ প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ পদক্ষেপগুলো বিশ্বকে ক্রমবর্ধমান দুটি শিবিরে বিভক্ত করে তুলছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকা বা না থাকার প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। একটি আফ্রিকান প্রবাদ রয়েছে—‘বড়রা যখন যুদ্ধে লিপ্ত হয় তখন ছোটরাই এর ভুক্তভোগী হয়। ’ এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে যে তাদের অঞ্চলটি কি বড়দের লড়াইয়ের তীর্থস্থান হবে কি না।
লেখক : ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক। ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব বাংলাদেশ
স্টাডিজের পরিচালক