<p>ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ খ্যাত ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সেবিকা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিনকে বেছে নেওয়া হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক নার্স দিবস’ হিসেবে। ১৯৬৫ সাল থেকে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেস’ তাই প্রতিবছরের ১২ মে স্বাস্থ্যসেবা খাতের এই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পেশাটি উদযাপন করে আসছে।</p> <p>যদিও ইংরেজি নার্স শব্দের অর্থকে বাংলায় গড়পড়তা স্ত্রীবাচক ‘সেবিকা’ হিসেবে গণ্য করলেও কথাটি সর্বার্থে ঠিক নয়। কারণ এই পেশায় পুরুষ ও নারী উভয়ে নিয়োজিত হতে পারেন। সে হিসেবে নার্স শব্দের ‘সেবক’ অর্থ যুক্তিসম্মত।</p> <p>এই বছর নার্স দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘নার্সিং পরিষেবায় বিনিয়োগ এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতি যত্নবান হওয়া।’ বিশেষ করে কভিডকালে সারা বিশ্বে নার্স সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এমনতর বাস্তব উপলব্ধির সম্মুখীন হতে হয়েছে। যার জন্য নীতিনির্ধারকরা হাসপাতালে সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং তা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে সেবক/সেবিকার সংখ্যা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, সে লক্ষ্যে আগামী দিনে বিভিন্ন কার্যকর নির্দেশনা প্রকাশ করতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক নার্সিং সংস্থাগুলো।</p> <p>বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নার্সিং পেশা নিয়ে এখনো নেতিবাচক মনোভাব চালু রয়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা সরাসরি নার্সিং পেশাকে বেছে নিতে চান না। যদিও সরকার নার্সদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় উন্নীত করার কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থীরা নার্সিং ও মিডওয়াইফারি পেশা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।</p> <p>বর্তমানে সরকারি তালিকাভুক্ত নার্সের সংখ্যা ৭০ হাজার। এর মধ্যে সরকারি নার্স রয়েছেন ৪০ হাজারের মতো। জনসংখ্যার অনুপাতে আমাদের প্রয়োজন প্রায় আড়াই লাখ দক্ষ নার্স। যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী প্রতি একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন করে নার্স থাকা রীতি।</p> <p>কভিড মহামারিতে চিকিৎসকদের পাশাপাশি এই খাতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক নার্সের শূন্যতা অনুভব করলেও এই পেশাকে আধুনিকায়নের জন্য যথাযথ উদ্যোগের অভাব লক্ষণীয়। বিশেষ করে নার্সিং কারিকুলাম সংস্কার এবং উন্নত, নিরাপদ কাজের পরিবেশের পাশাপাশি এই পেশায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়নি। এখন দিতে হবে।</p> <p>বর্তমানে আমাদের দেশে সরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৪৩টি এবং বেসরকারি ১২০টি। এর মধ্যে সরকারি নার্সিং কলেজের সংখ্যা ১৭টি এবং বেসরকারি ৬০টি।</p> <p>আশার বিষয়, দেশের জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসক-রোগী অনুপাতের বিপরীতে নার্সিং ইনস্টিটিউট ও কলেজগুলোর চাহিদা দিন দিন ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিবছর নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের প্রবল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ভর্তি হতে হচ্ছে।</p> <p>সম্প্রতি নার্সিং পেশার প্রতি আগ্রহ তৈরি হওয়ার পেছনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, বর্তমানে বিএসসি নার্সিং কোর্স শেষ করে বিসিএস দেওয়া যায়। অনেকেই বিএসসি নার্সিং শেষ করে বিসিএস দিয়ে পুলিশ, প্রশাসন কিংবা ব্যাংকে কাজ করছেন। এ ছাড়া মেধাবীরা নার্সিং শেষ করে পিএসসির অধীনে দশম গ্রেড বা দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির সুবিধাসহ বিদেশে এমএসসি এমপিএইচ বা পিএইচডি করার জন্য যেতে পারছেন।</p> <p>নার্সিংয়ের তিনটি কোর্স বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। প্রথমটি বিএসসি ইন নার্সিং, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি এবং ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি।</p> <p>তিনটা কোর্সে মেধাভেদে ভর্তির জন্য কিছু আলাদা আলাদা যোগ্যতা লাগে। চার বছরমেয়াদি বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং কোর্স করলে সরাসরি বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারা যায়।</p> <p>ডিপ্লোমা ইন নার্সিং কোর্স করলে দুই বছরমেয়াদি পোস্ট বেসিক বিএসসি নার্সিং কোর্সে ভর্তি হতে হবে এবং বিএসসি ইন নার্সিং কোর্সে ভর্তি হতে হলে এইচএসসি পাস হতে হবে। এসএসসি ও এইচএসসি মিলে জিপিএ ৭ থাকতে হবে। এর মধ্যে বিএসসি ইন নার্সিং চার বছরমেয়াদি কোর্স। ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি এবং ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্সে আপনার এসএসসি ও এইচএসসি মিলে ৬.৩০ থাকতে হবে। ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি ব্যতীত বাকি দুটি কোর্সে ১০ শতাংশ ছেলে ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকেন।</p> <p>পৃথকভাবে কারিগরি বোর্ড থেকে একটি নার্সিং চালু আছে।</p> <p>তিনটা কোর্স মিলে পরীক্ষা দেন প্রায় ৬০ হাজার ছাত্র-ছাত্রী। এর মধ্যে সরকারিতে সুযোগ পাবেন চার হাজার শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৩৬০ জন ছেলে শিক্ষার্থী সরকারি নার্সিংয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন। ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট ও জিপিএ হিসাব করে একজন শিক্ষার্থীকে বিবেচনা করা হয়। ভর্তি পরীক্ষায় ১০০ নম্বরে হয় ও রেজাল্ট থেকে ৫০ নম্বর থাকে।</p> <p>চরম বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে নার্সিং পেশার শিক্ষাগত যোগ্যতার মানদণ্ড যেমন হোক, কর্মক্ষেত্রে তার প্রতিফলন নিয়ে সাধারণ রোগীদের সন্তুষ্টি মোটেও আশাপ্রদ নয়। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে নার্সদের প্রতি সাধারণ রোগীদের দূরত্ব চোখে পড়ার মতো। এর জন্য মূলত দায়ী সঠিক হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার অভাব।</p> <p>দেশের নার্সিংয়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের গুণগত পার্থক্য অনেক। বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইনের নার্সিং শিক্ষা এবং সেবা মানের চেয়ে আমরা কেন এখনো পিছিয়ে আছি তা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার। যেহেতু হাসপাতাল প্রশাসনে নার্সিং কোনো একক পরিষেবার অংশ নয়, এর সঙ্গে জড়িত চিকিৎসক এবং অন্য অপরিহার্য বিষয়গুলো। চিকিৎসক এবং নার্সের সমন্বিত অংশগ্রহণ এবং রোগীর প্রতি জবাবদিহির সংশ্লিষ্টতা ছাড়া সেবা খাত অসম্পূর্্ণ।</p> <p>বাংলাদেশে নার্সরা এখনো ব্যস্ত তাঁদের পেশার সার্বিক মূল্যায়নের দাবি আদায়ের সংগ্রামে। মূলত নার্সিং শিক্ষায় সরাসরি প্রথম শ্রেণির টিচার নিয়োগের মৌলিক দাবি ছাড়াও বিএসসি নার্সদের উচ্চ পর্যায়ে নিয়োগ দেওয়া, নার্সিং কলেজগুলোর অধ্যক্ষদের প্রথম শ্রেণিতে পদোন্নতি দেওয়া, ওয়ার্ড ইনচার্জদের প্রথম শ্রেণির পদ দেওয়া, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে নার্সদের সর্বনিম্ন বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা ইত্যাদি দাবির মধ্যে প্রকারান্তরে লুকিয়ে আছে এই পেশার প্রতি নিষ্ঠা, আন্তরিকতার প্রতিবন্ধকতাগুলো।</p> <p>আন্তর্জাতিক মানের সেবাদানের ক্ষেত্রে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মতো রোগী অন্তঃপ্রাণ সেবিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কেন পিছিয়ে আছি তা সরেজমিনে গিয়ে খতিয়ে দেখতে পারলেই এই বিশেষ দিবসের উদ্দেশ্য কিছুটা সার্থক হতে পারে।</p> <p> লেখক : তথ্যচিত্র নির্মাতা, লেখক ও চিকিৎসক</p> <p>mirajulislam1971@gmail.com</p> <p> </p>