<p>পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে মহান মে দিবস পালন করছে মেহনতি শ্রমজীবী মানুষ। এর সূচনা ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে। শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে প্রেরণা দানকারী এই দিনটি সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিকদের রক্তপাতের মাধ্যমে যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণি মে দিবসকে শোষণমুক্তির দিশারি হিসেবে গর্ব ও প্রত্যয়ের সঙ্গে পালন করে আসছে। উন্নত দেশগুলোতে শ্রমিকরা তাদের অধিকারকে আরো সংহত করার আওয়াজ তোলে এই দিনে। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই দিবস এখনো শ্রমিকদের নিছক অস্তিত্ব রক্ষার দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।</p> <p>আমাদের দেশের শ্রমিক-কর্মচারীরা এখনো তাঁদের ন্যূনতম অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। আমাদের দেশের শ্রমিক-কর্মচারীরা এই দিবসে আন্দোলন-সংগ্রাম করেন তাঁদের অর্জিত অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ জীবনধারণের জন্য নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বাড়িভাড়া, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়ে যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, তাতে সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে পরিবার-পরিজনসহ অসহায় ও মানবেতরভাবে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন ও যৌথ দর-কষাকষির অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।</p> <p>বাংলাদেশের শ্রমিকরা ১৯৬৯ সালের শিল্প সম্পর্কিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারসহ যেসব সুযোগ-সুবিধা পেত, এখন তা থেকেও বঞ্চিত। আইন অনুযায়ী আলোচনার মাধ্যমই হলো শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন। আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের সমস্যার সমাধান না হলে সরকার, মালিক ও শ্রমিক—এই ত্রিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করার বিধান রয়েছে। আলোচনা ব্যর্থ হলে চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে শ্রমিকদের শতকরা ৮০ ভাগের হ্যাঁ সূচক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে আইনগতভাবে ধর্মঘট ডাকার প্রথা বিদ্যমান। অথচ আমাদের দেশের সরকার ও লুটেরা মালিকগোষ্ঠী নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় না গিয়ে ছলেবলে কৌশলে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করা থেকে বিরত রাখার জন্য সব সময় তৎপর। ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের একমাত্র সংগঠন ও শক্তি। শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ ও সংহত করাই হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়নের কাজ। ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণি সচেতন হয়ে অর্থনৈতিক দাবি আদায়ের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন গড়ে তোলা এখন সময়ের চাহিদা।</p> <p>মানবসভ্যতা যত এগিয়েছে, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শ্রমিকদের ভূমিকা তত বেড়েছে। বিকাশমান গণতন্ত্রে প্রতিটি পেশার মানুষের তাদের নিজ নিজ অধিকার উপস্থাপন, আদায় ও সংরক্ষণ করার জন্য নিজস্ব সংগঠন থাকা অপরিহার্য। শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের সে রকম একটি সংগঠন, যার মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষ তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার তুলে ধরতে পারে এবং তা আদায় ও সংরক্ষণের জন্য মনোবল সৃষ্টি করে প্রয়োজনে ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলন বেগবান করতে পারে। ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের সুসংগঠিত করে। শিল্প-কারখানায় সুষ্ঠু শিল্প সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অবস্থা তৈরি করে। এ ছাড়া যেকোনো রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিকাশ এবং তাকে শক্তিশালী ও টেকসই করতে রাষ্ট্রের উৎপাদিকা চালিকাশক্তি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণের অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে ট্রেড ইউনিয়নের এখনো কোনো বিকল্প নেই।</p> <p>বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এমন শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে যে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অথচ আমাদের দেশে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এখনো তার প্রাথমিক স্তরও অতিক্রম করতে পারেনি। তাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে সঠিকভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮-র ধারা অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন হলো শ্রমিক-মালিক উভয় পক্ষের সমস্যা সমাধানে বিধিবদ্ধ স্বীকৃত প্রক্রিয়া। আইএলও কনভেনশন ৮৭-র মাধ্যমে একদিকে যেমন শ্রমিকদের অবাধ সংগঠন করার কথা বলা হয়েছে, অন্যদিকে আইএলও কনভেনশন ৯৮-এর মাধ্যমে যৌথ দর-কষাকষির অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে শ্রমিকদের আস্থাভাজন সংগঠন বা নেতা নির্বাচন করা দূরের কথা, কোনো শ্রমিক ওই কারখানায় চাকরি হারালে বা অবসরে গেলে সেই শ্রমিককে তার অনুসারীরা নেতা মনে করলেও তাকে নেতা নির্বাচন করতে পারে না। এটা শ্রমিক-কর্মচারীদের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী। </p> <p>আমাদের দেশের মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক বিরাজ করে, যা কোনোভাবেই শিল্প বিকাশের জন্য অনুকূল বা সহায়ক পরিবেশ হতে পারে না। অথচ ইতিহাস বলে, শ্রমজীবী মানুষের অবদানের জন্যই শিল্প ও কৃষি বিপ্লব হয়েছে। সুস্থ ধারার ট্রেড ইউনিয়ন মালিকদের শিল্প সম্প্রসারণের যে একটি সহযোগী হাতিয়ার, আমাদের দেশের মালিকদের সেই চেতনাবোধ এখনো তৈরি হয়নি। কারণ আমাদের দেশের বেশির ভাগ মালিক এখনো শিল্পোদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারেননি। ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে তাঁদের মনোভাব অত্যন্ত নেতিবাচক, যার কারণে তাঁরা কোনোভাবেই শ্রমিকদের ন্যায়সংগত অধিকার মেনে নিতে রাজি নন। আমাদের দেশের মালিক শ্রেণি এটা মানতে রাজি নয় যে শ্রমিক শ্রেণি শুধু উৎপাদনব্যবস্থারই অংশ নয়, দেশের রাজনৈতিক,  সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনেরও অন্যতম কারিগর। </p> <p>একসময় আমাদের দেশে বড় বড় শিল্প-কারখানা, যেমন—পাটকল, সুতাকল, চিনিকল ছিল। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের প্রেসক্রিপশন এবং সরকারের ভ্রান্ত নীতির ফলে দেশের বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো এক এক করে বন্ধ বা বিক্রি করে দিয়ে দেশকে বিশিল্পায়ন করা হয়েছে। ভ্রান্ত অর্থনীতির ফলে বেকার হয়েছে লাখ লাখ দক্ষ শ্রমিক। আমাদের দেশের শিল্প-কারখানার পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। বিশেষ করে গার্মেন্ট, নির্মাণ, ওয়েল্ডিং, শিপ ব্রেকিংসহ এমন অনেক শিল্প ও কারখানা রয়েছে, যেখানে প্রতিনিয়ত শ্রমিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে জীবন দিচ্ছে।</p> <p>শোভন কাজ ও অনুকূল কর্মপরিবেশ শ্রমিকদের মৌলিক দাবি হলেও আজও তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পোশাকশিল্পে এক ধরনের নৈরাজ্য বিরাজ করছে। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে নীতিহীনতা, অমানবিকতা, শ্রমিক নিরাপত্তাহীনতা সর্বাধিক। সেই সঙ্গে রয়েছে সর্বনিম্ন মজুরি ও সর্বনিম্ন সুযোগ-সুবিধা। শ্রমিকদের আস্থায় নিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে যেমনভাবে শিল্প বিকাশ হয়েছে, আমাদের দেশেও সেভাবে শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। এ জন্য দেশ, জাতি ও শিল্প বিকাশের কথা মাথায় রেখে আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ এবং অন্যান্য শ্রমিক স্বার্থ রক্ষাকারী ধারা কার্যকর করার মাধ্যমে শ্রমিক-কর্মচারীদের আস্থায় নিয়েই শিল্পের উন্নয়ন এবং শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক উন্নয়নে শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত হতে পারে। অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত হলে শিল্পায়নের অনেক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সুষ্ঠু উৎপাদনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত হবে। দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের ওপর মানুষের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে সুখী, সমৃদ্ধ একটি প্রগতিশীল শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে মালিক-শ্রমিক সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে মে দিবসের তাৎপর্য এ দেশে বিকশিত হবে, গড়ে উঠবে সোনার বাংলাদেশ। জয় হোক মেহনতি মানুষের।</p> <p> </p> <p> লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র</p>