আমাদের এতগুলো অর্জন বিফলে যাবে যদি আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, বিচারহীনতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ না হই। দেশের উন্নয়নকে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন একাত্তরের সেই ইস্পাতকঠিন ঐক্য
আমাদের এতগুলো অর্জন বিফলে যাবে যদি আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, বিচারহীনতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ না হই। দেশের উন্নয়নকে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন একাত্তরের সেই ইস্পাতকঠিন ঐক্য আজ ২৬ মার্চ শনিবার। আমাদের স্বাধীনতা দিবস।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে পাঠক-পাঠিকাকে অফুরন্ত অনাবিল শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁদের কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন : কেমন আছেন আপনারা? জবাবে কেউ বলবেন, ভালো আছি, খুব ভালো। কেউ বলবেন, খুব খারাপ আছি, খুবই খারাপ। আবার কেউ সেই পুরনো কায়দায় রসিকতা করবেন : কেটে যাচ্ছে, রক্ত পড়ছে না। আর যাঁদের রক্তক্ষরণটা মাত্রাতিরিক্ত তাঁরা কাতরাতে কাতরাতে বড়জোর উচ্চারণ করবেন : দেখতেই তো পাচ্ছেন কেমন আছি।
বলেই তাঁরা চাল-ডাল-তেল-নুন-পেঁয়াজ থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদির মূল্যের রকেটগতিতে ঊর্ধ্বগমনের কথা উল্লেখ করবেন, বলবেন, এই অবস্থায় ছানা-পোনা নিয়ে কেমন আছি বোঝেন না? কেউ আমাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করবেন : আপনি কেমন আছেন? আমিও চিরদিনের অভ্যাসমতো ত্বরিত জবাব দেব : আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আমার এই ট্রেডমার্ক বা পেটেন্ট জবাবের মূল যুক্তি হচ্ছে, অবস্থা এর চেয়েও তো খারাপ হতে পারত। চালের কেজি ৬০ টাকা না হয়ে ১০০ টাকাও তো হতে পারত। দ্বিতীয় যুক্তি হচ্ছে, আমাদের মহল্লায় বা শহরে অন্তত কয়েক লাখ লোক পাওয়া যাবে যাদের অবস্থা আমার চেয়ে অনেক অনেক খারাপ। আমি তো মাশাআল্লাহ পরিবার-পরিজন নিয়ে দুই বেলা নয়, তিন বেলা ভালো-মন্দ খেতে পারছি, মাথার ওপরে একটা শক্ত-সমর্থ ছাদ আছে, যার তলায় নিশ্চিন্তে (?) নিদ্রা যেতে পারছি, অথচ...।
এইটুকু বলে সুযোগ পেলেই শহরের মানুষ যারা আমার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে তাদের দুঃখ-কষ্টের ফিরিস্তি দিতে শুরু করি। এতে আমার ছেলেবেলায় শেখা ‘পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন/আপন অভাব-ক্ষোভ রহে কতক্ষণ’—এই মূলমন্ত্র ম্যাজিকের মতো কাজ করে। কিছু না পেলে, কিছু থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হলে, কিচ্ছু যায় আসে না আমার। এটা এক ধরনের চরম ঔদাসীন্য, নির্বিকারচিত্তে সব কিছু মেনে নেওয়ার বিধিপ্রদত্ত ক্ষমতা।
দর্শনশাস্ত্রে একে বলে ‘স্টয়সিজম’। এসব শিক্ষা আমার আব্বা-আম্মার কাছ থেকে সেই ছেলেবেলায় পাওয়া শিক্ষা। সেই যে মুখস্থ করেছিলাম: ‘...সেথা (উপাসনালয়ে) দেখি একজন পদ নাহি তার/অমনি জুতার খেদ ঘুচিল আমার।/পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন/আপন অভাব-ক্ষোভ রহে কতক্ষণ’।
এসব শুনে আপনারা বোধ হয় ‘বোর ফিল’ করছেন, ভাবছেন, এই লোকের আজ হলো কী! কোথায় স্বাধীনতা দিবসের এই শুভলগ্নে ভালো ভালো কথা বলবে, দেশ কী করে আরো এগিয়ে যাবে, কী করে ১৭ কোটি মানুষের বাড়ি (আশ্রয়ণ প্রকল্পের নয়)-গাড়ি, বিত্ত-বেসাত, গানম্যান-মাসলম্যান, ফুর্তি-ফার্তি, বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদি হবে, তা না শুরু করল দর্শনশাস্ত্রের কচকচানি। কষ্ট করে আপনার কলাম পড়ছি কি এই সব ওয়াজ-নসিহত শোনার জন্য? এসব শোনান গিয়ে অন্য কোথাও। নট হিয়ার, এখানে না।
আচ্ছা, ঠিক আছে। আমার একটা কথার জবাব দিন তো যাঁদের বয়স ষাটের বেশি তাঁরা। একাত্তরে আপনি বা আপনারা যাঁরা বাংলাদেশে ছিলেন তাঁরা কি এসব ধন-দৌলত আর ফুর্তি-ফার্তির কথা, বাসায় হাই-ফাই পার্টি বা আড্ডা-ইয়ার্কির কথা কল্পনাও করতে পারতেন? রাতে যখন আপনি আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে ঘুমাবার চেষ্টা করতেন তখন ইয়াহিয়া খান ও তার বশংবদেরাও আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিত। আর তাদের দু’আ ছিল কী করে বাঙালি নিধন করে ক্ষমতার মেড ইন পাকিস্তান কুরসিতে চিরকাল মুখে ইসলাম আর হাতে রঙিন পানীয় ভর্তি গ্লাস নিয়ে বসে থাকা যায় সেই দু’আ। তাদের কাছে পবিত্র আয়াতুল কুরসি ছিল পাশব বলে আসবমত্ত হয়ে ক্ষমতার কুরসিতে চিরকাল অধিষ্ঠিত থাকা।
আর আমরা, মানে তখনকার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির চিন্তা ছিল একটাই : আগামীকাল ভোরের সূর্যোদয়টা দেখতে পাব তো। আল্লাহপাকের অসীম করুণায় একাত্তরে আসুরিক শক্তির ঘটে শোচনীয় পরাজয়, আর ত্রিশ লাখ বাঙালির রক্তস্নাত স্বাধীনতা আসে তাদের ঘরে সদ্যোজাত সন্তানের মতো। ৯ মাসের যুদ্ধে যাঁরা রণাঙ্গনে, মাঠেঘাটে, গৃহকোণে এবং অন্যান্য স্থানে ওই পশুদের হাতে শহীদ হয়েছেন, যেসব মা-বোনের সম্ভ্রম হয়েছে লুণ্ঠিত, আজ সর্বাগ্রে তাঁদের উদ্দেশে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম, যে সালাম রোজ কিয়ামত পর্যন্ত বাঙালি জাতি তাদের অন্তরের সমস্ত শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা দিয়ে জানিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই, থাকতে পারে না।
আপনারা যাঁরা ক্ষমতাযুদ্ধে কেউ নিজেকে রাশিয়া, কেউ ইউক্রেন মনে করছেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে যত খুশি লড়াই চালিয়ে যান, কিন্তু ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তস্নাত ও দুই লাখ জায়া-মাতা-কন্যা-ভগিনীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতাকে এর মধ্যে টেনে আনবেন না। রোজ কিয়ামত পর্যন্ত মস্তকোপরি ধরে রাখার প্রাণের উত্তরাধিকার এই স্বাধীনতা। এটা শুধু আমার বা আমার মতো মুষ্টিমেয় খ্যাপা বাউলের তারস্বরের চিৎকার নয়, এটা প্রত্যেক বাঙালির হৃৎকন্দর থেকে উত্থিত আকুল প্রার্থনা।
৩.
কিন্তু চারপাশে যা ঘটছে তা কি স্বাধীনতা চিরজীবী হওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে? গত ৫০ বছরের অপরাধচিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখুন। চুরি-ডাকাতি বা প্রবঞ্চনার মতো চিরন্তন অপরাধই শুধু নয়, জঘন্য অপরাধ, আইনের ভাষায় ইংরেজিতে যাকে বলে ‘হেইনাস’ ক্রাইম—যেমন খুন-ধর্ষণ এবং ব্যাংকের টাকা মেরে উধাও হয়ে যাওয়া, বিদেশে টাকা পাচার, ইংরেজি নাম মানি লন্ডারিং, যা আজ থেকে ৫০ বছর আগে ছিল অপরিচিত, অজ্ঞাত একটি অপরাধ ইত্যাদিতে দেশ ছেয়ে গেছে। তার চেয়ে বড় চিন্তার কারণ দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়ে দেশকে অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করতে চলেছে। আর দুর্নীতি? ওটা তো না বলাই ভালো। নীতিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। আর দৃশ্যত দুর্নীতির হোতারা দিব্যি গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছে প্রশাসনের চোখের সামনে দিয়ে। সুশাসনের সু আসন ছেড়ে দিয়েছে দুঃশাসনের দুঃ-কে।
আবার ফিরে আসি প্রাক একাত্তরের জমানায়। পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশে সব রকমের দুঃশাসন কায়েম করেছিল বলেই দুই যুগের দুঃখ-কষ্ট-ভোগান্তির পর সাড়ে সাত কোটি বাঙালি একযোগে তাদের রুখে দাঁড়িয়েছিল সেদিন। সেটা সম্ভব হয়েছিল কারণ বাঙালি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিল বলেই। অন্যায়, অবিচার আর অসত্যের বিরুদ্ধে ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সেই ঐক্য আজ কোথায়? আজ যে আমাদের এতগুলো অর্জন—তার সবই বিফলে যাবে যদি আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, বিচারহীনতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ না হই। আমাদের ত্রিশ লাখ শহীদ প্রাণ দিয়েছিলেন একটি শোষণমুক্ত ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজের জন্য। আমরা যেন তা ভুলে না যাই।
আজ দেশের উন্নয়নকে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন একাত্তরের সেই ইস্পাতকঠিন ঐক্য। দেশের সব শ্রদ্ধেয় নেতা-নেত্রীর কাছে বিনীত আবেদন, আসুন, দেশের উন্নতিকে আপামর জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য কাজে লাগাই। এবং তা বিভাজন নয়, জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
mkarim06@yahoo.com