<p>সাধারণত প্রতিবছর রমজান এলেই দেশের ছোট-বড় প্রায় সব ব্যবসায়ী বাড়তি মুনাফা করতে চান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের প্রফিটিয়ারিং তথা অন্যায্য মুনাফা করতেও দেখা যায়। তাঁরা সুযোগ পেলে অতিরিক্ত মুনাফা করার উপায়গুলো কাজে লাগান। আমরা দেখি, রমজানে চাহিদা বেশি এমন সব পণ্যেরই মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। এ সময় মাছ, মাংস, চাল, ডাল, ইফতারসামগ্রী, ভোজ্য তেল, চিনি ও ফলের দাম বেড়ে যায়। খুচরা পর্যায়ে বিক্রেতারা দাম যা বাড়ান, তার চেয়ে বেশি মূল্যবৃদ্ধি ঘটে পাইকারি পর্যায়ে। অর্থাৎ উৎপাদনকারী, আমদানিকারক ও সরবরাহকারীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। তখন ব্যবসায়ীরা একটা অভিন্ন কথা বলে থাকেন যে আমদানি পর্যায়ে ব্যয় বেড়ে গেছে। অথচ বাস্তবতা হলো আন্তর্জাতিক বাজারে দাম না বাড়ালেও তাঁরা দেশে দাম বাড়ান এবং এটা হরহামেশাই ঘটছে। এর সঙ্গে এবার যোগ হচ্ছে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি।</p> <p>দেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে বরাবরই সরবরাহকারীদের মধ্যে কার্টেল বা জোট গড়ে উঠতে দেখা যায়। কিছুসংখ্যক সরবরাহকারী একজোট হয়ে উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রি অব্যাহত রাখার যে জোট গড়ে তোলেন, সে প্রক্রিয়ার নামই কার্টেল। এটা আমাদের স্বাভাবিক আইন-কানুনের পরিপন্থী। আমাদের আইনে বলা আছে, কোনো গোষ্ঠী নিজেরা সুবিধা নেওয়ার জন্য খুশিমতো বাজার ম্যানুপেলেট করতে পারবে না। কৃত্রিমভাবে পণ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ বা পণ্যের সংকট সৃষ্টি করতে পারবে না। আমাদের আইনে মজুদদারি নিষিদ্ধ। দুঃখজনকভাবে এই আইনের বাস্তবায়ন খুব কমই দেখা যায়।</p> <p>রমজান এলে দেখা যায়, আমাদের প্রশাসন ম্যাজিস্ট্রেট নামিয়ে দোকানে দোকানে গিয়ে তদারকি করে। কোথাও অতিরিক্ত মূল্য চাওয়া হচ্ছে কি না তা দেখা হয়। দোকানগুলোতে মূল্যতালিকা রাখা হলো কি না এবং সে অনুযায়ী দাম রাখা হচ্ছে কি না, তা দেখে এবং কিছু জরিমানা করে। বাস্তবতা হচ্ছে, মূল্য নিয়ন্ত্রণের এই পদ্ধতি বলতে গেলে কাজে লাগে না। আসল ব্যাপারটা ঘটে সরবরাহের পর্যায়ে। এক ডজন আমদানিকারক যদি একসঙ্গে হাত মেলান, তাহলে সহজেই তাঁরা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, মূল্যবৃদ্ধি ঘটাতে পারেন। এটাই সরকারকে দেখতে হবে। যাঁরা আমদানি করেন, তাঁদের আমদানি ব্যয় কেমন এবং তাঁরা কোনো কারসাজি করছেন কি না, বেআইনি কিছু করছেন কি না সেটাই গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।</p> <p>আরেকটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। এখন যে অবস্থা চলছে, সামনের দিনগুলোতে আরো বেশি পণ্যসামগ্রীর উচ্চমূল্য ঘটতে পারে। কারণ মূল্যস্ফীতি এখন একটা গ্লোবাল ফেনোমেনা বা বৈশ্বিক বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। বিশ্বে সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হয়েছে, দেশে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, কাঁচামালের দাম বাড়ছে, বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধ হচ্ছে বা হবে হবে অবস্থা চলছে, তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমদানিকারকদের আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে। অনেকে সলিড অ্যাসেট কিংবা ফরোয়ার্ড মার্কেটে অপরিশোধিত তেলের মতো পণ্য ধারণ করার দিকে ঝুঁকছে। এসব কারণে অগ্রসর অর্থনীতিগুলোতে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতি ওপরের দিকে রয়েছে।</p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/02.February/25-02-2022/121/1.gif" style="float:left; height:259px; margin:12px; width:331px" />বিশ্বে গত ৩০ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি এখন ওপরের দিকে। একসময় প্রায় ‘জিরো ইনফ্লেশন’ বা শূন্য মূল্যস্ফীতি ছিল। এই গ্লোবাল ফেনোমেনা আমাদের এখানেও আসবে। কারণ বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয় বা বিচ্ছিন্ন কোনো অর্থনীতিও নয়। সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে আমরা যখন আমদানি করি, তখন বেশি দরে পণ্য ক্রয় করতে হয়। সেটা সরাসরি আনা পণ্য হোক কিংবা কাঁচামাল এনে আমাদের তৈরি করা পণ্যই হোক—সব কিছুর দামই বাড়বে। এটা ঠিক যে সামনের দিনগুলোতে হয়তো আমাদের উচ্চতর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বসবাস করার চিন্তা করতে হবে এবং আমাদের সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে।</p> <p>সমস্যা হচ্ছে, এরই মধ্যে আমাদের যে মূল্যস্ফীতি ঘটে গেছে, এই পরিস্থিতিটা আমরা কিভাবে মোকাবেলা করব, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে নিচের দিকে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ লোকের অবস্থানকে আমাদের বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। এই অতিদরিদ্র বা নিম্ন আয়ের লোকের পাশাপাশি নিম্নমধ্যবিত্তের অবস্থাও ভালো নয়। সব মিলিয়ে সমাজের ৪০ শতাংশ মানুষের এখন টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। তাদের আয় বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই, তাদের অনেকের আয় খুবই কম বা অনেকে সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করে কোনো রকমে চলছে। এর অর্থ হচ্ছে অর্থনীতিতে যে পরিমাণ ইনকাম জেনারেট বা আয় উৎপন্ন হচ্ছে, সেই আয়ের সঙ্গে সমাজের এই শ্রেণির মানুষের কোনো সংযুক্তি নেই। অর্থাৎ তাদের কাছে আয়টা প্রবাহিত হচ্ছে না। এখন তাদের তো কষ্টটা বেশিই হবে। এখন মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের দুর্ভোগ কিভাবে কমানো যায়, সেদিকে সরকারকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে।</p> <p>এ অবস্থায় টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহের যে ব্যবস্থা করেছে, তা নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। শহরাঞ্চলের কয়েকটা স্থানে টিসিবিকে খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে। দিন দিন এই লাইন আরো লম্বা হতেও দেখা যাচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোকজন দাঁড়িয়ে থাকে। ভোজ্য তেল, চাল, চিনি, পেঁয়াজ ইত্যাদি পণ্য কম মূল্যে নেওয়ার জন্য তারা এভাবে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। চিন্তার বিষয় হচ্ছে, দুই বছর আগেও কম মূল্যে জিনিসপত্র কেনার জন্য এভাবে ট্রাকের পেছনে মানুষ দাঁড়াত না। এখন কেন দাঁড়াচ্ছে? কারণ তারা দরিদ্র হয়ে গেছে। নিম্নমধ্যবিত্তের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে এবং সেটা দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। এসব লোকের ভিড়েই লাইনগুলো লম্বা হচ্ছে।</p> <p>টিসিবির ট্রাকের পেছনে এই বিশাল লাইনের বার্তাটা কী? দরিদ্র মানুষ স্বল্প আয়ে চলতে পারছে না কিংবা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। সুতরাং বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এসব দরিদ্র লোকের জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে হবে, তাদের সরকারি সহায়তা দিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় হচ্ছে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি আরো বাড়ানো। এটাকে উপজেলা পর্যায়ে নিতে হবে, গ্রামগঞ্জের হাট-বাজারে নিতে হবে। রেশন পদ্ধতি চালুর কথা আমি বলব না। কারণ এটা পুরনো জিনিস। তবে সাময়িকভাবে হোক, বছর দেড়-দুয়েকের জন্য হোক, বর্তমান প্রক্রিয়াটা চালু রাখতে হবে এবং এর আওতা বৃদ্ধি করতে হবে। এটার জন্য সরকারকে নিজে আমদানি করতে হবে, খোলাবাজার থেকে ক্রয় করতে হবে এবং হ্রাসকৃত মূল্যে দরিদ্র মানুষকে দিতে হবে। তাহলে কিছুটা হলেও উপশম হবে। না হলে এসব লোকের হাহাকার বৃদ্ধি পাবে এবং আমরা যে উন্নতি করছি, সেটা প্রশ্নবোধক হয়ে পড়বে। প্রশ্ন উঠবে যে বাংলাদেশ উন্নয়ন করছে, কিন্তু কাদের জন্য উন্নয়ন করছে? শুধু কি শীর্ষ ১০ শতাংশের জন্য এই উন্নয়ন? নিচের ৪০ শতাংশের অবস্থা কেন পরিবর্তন হচ্ছে না?</p> <p>আমি মনে করি, সরকারের অনেক জায়গায় অর্থের অপচয় হচ্ছে। যেমন সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে—এমন কিছু প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভালোভাবে চলার কথা। হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে সেগুলো চালাচ্ছে। সরকারকে এ ধরনের কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে এগুলোর তহবিল স্থানান্তর করে দরিদ্র লোকদের জন্য খাদ্য বিতরণে ব্যয় করতে হবে। মোটকথা, খাদ্য বিতরণকে আরো শক্তিশালী করা উচিত। পথে-ঘাটে এত দরিদ্র লোক এই সময়ে বাংলাদেশে দেখার কথা নয়। যেখানে বাংলাদেশ গড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, এই পরিস্থিতি কাম্য নয়। তাই যেখানে সরকারি পর্যায়ে অর্থের অপচয় হচ্ছে, অর্থ লুট হচ্ছে, সেগুলো বন্ধ করে জনকল্যাণে কাজ করতে হবে।</p> <p>একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে চলছে বিশ্ব। কভিডের সময় এবং কভিড-পরবর্তী এক-দুই বছর অনেক দেশই অসুবিধার মধ্যে আছে। বাংলাদেশও আছে। এটা ঠিক যে এখনই সময়টাকে সংকটকাল হিসেবে না দেখলেও ‘গুরুত্বপূর্ণ সময়’ হিসেবে গণ্য করতে হবে। চিন্তা করতে হবে যে দরিদ্র লোকদের কিভাবে কম মূল্যে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। সরকারের কলকবজাগুলোকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। এখন যা করা হচ্ছে, তার মাত্রা আরো দশ গুণ বাড়াতে হবে। না হলে আসন্ন একটা ‘ব্ল্যাকমেইলের’ শিকার হতে হবে আমাদের। আমরা দেখি, আমাদের দেশে যখনই কোনো সংকট দেখা দেয়, তখন এখানে কিছু লোক ব্ল্যাকমেইল করে। সরবরাহ ঘাটতিকে ব্যবহার করে সুবিধা নেওয়ার জন্য পুরো মার্কেটকেই তারা আতঙ্কে ফেলে দিয়ে সুবিধা আদায় করে নেবে। এটা যেন সরকার হতে না দেয়।</p> <p>লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়</p>