<p>করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশে অনেকাংশেই কমে এসেছে করোনা প্রকোপের হার, কমেছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। এর পেছনে যে বিষয়গুলো মূল ভূমিকা পালন করছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো দেশে টিকাদানের হার বৃদ্ধি পাওয়া। বিশ্বব্যাপী টিকাদান শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশের জনগণকে টিকার আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। টিকার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে সরকারের পাশাপাশি কাজ করেছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সংস্থা। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর থেকে এরই মধ্যে টিকাগ্রহীতার সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে পাঁচ কোটি। ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ের সব মানুষকে টিকার আওতায় আনতে কমিউনিটি ক্লিনিকে টিকাদান কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। ফলে দেশের সব প্রান্তের মানুষ সহজেই টিকা গ্রহণ করতে পারছে। গণপর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে টিকা গ্রহণের প্রতি মানুষের আগ্রহও বৃদ্ধি পেয়েছে।</p> <p>করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরের বাইরে গেলে, বিশেষ করে গণপরিবহন, শপিং মল ইত্যাদি জায়গায় মাস্ক পরিধানকে শুরু থেকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ যেসব দেশে আগে থেকে মাস্ক ব্যবহারের প্রবণতা বেশি ছিল, সেসব দেশে সংক্রমণের হার তুলনামূলক কম। মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাও করোনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ দেশের মানুষের মধ্যে মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তুলতে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তবে সংক্রমণের হার কমার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মাস্ক পরার হারও দিন দিন কমতে দেখা যাচ্ছে।</p> <p>টিকাদান কর্মসূচি চালু থাকার পরও সংক্রমণের হার বৃদ্ধির নজির পাওয়া যাচ্ছে বিশ্বের নানা স্থানে। অস্ট্রেলিয়ায় নতুন করে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ায় দেশটির কয়েকটি অঞ্চলে চলতি মাসে ঘোষণা করা হয়েছে কঠোর লকডাউন। এ ছাড়া সম্প্রতি আবারও লকডাউন দেওয়া হয়েছে চীনে। পাশাপাশি ফ্লাইট বাতিল ও স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে; এমনকি করোনার সংক্রমণ রোধে সফল দেশগুলোর তালিকার ওপরের দিকে থাকা নিউজিল্যান্ডে এ বছরের আগস্টে আবারও দিতে হয়েছে লকডাউন। জার্মানি, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও সম্প্রতি বেড়ে গেছে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা।</p> <p>হাম, ধনুষ্টঙ্কার, ডিপথেরিয়াসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগের ক্ষেত্রে টিকা দীর্ঘ সময়, এমনকি জীবনভর কার্যকর হলেও করোনার টিকা কেন সম্পূর্ণ সুরক্ষা প্রদান করে না এটা নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে। এ ক্ষেত্রে বুঝতে হবে, টিকা আসলে কিভাবে কাজ করে। টিকা দেওয়া মানে হচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে শরীরে অ্যান্টিবডি বা প্রতিরোধ গড়ে তুলে দেহের নিজস্ব সুরক্ষাব্যবস্থা এমন পর্যায়ে নেওয়া, যাতে সেই ভাইরাস আবার আক্রমণ করলেও টিকাগ্রহীতা সেই রোগে আক্রান্ত না হয় অথবা হলেও সংক্রমণ মৃদু হয়। তবে এ ক্ষেত্রে টিকা যাতে কোনো গুরুতর অসুস্থতা বা মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি না করে সে ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়। আবার টিকা দেওয়ার পর কত দ্রুত এবং কী পরিমাণ অ্যান্টিবডি শরীরে তৈরি হচ্ছে, সেই অ্যান্টিবডি কত দিন শরীরে টিকে থাকছে; যে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ঠেকাতে টিকাটি তৈরি হয়েছে, সেটি ক্রমাগত রূপ বদলাচ্ছে কি না এবং দেহের কোন জায়গায় সেটি সংক্রমণ ঘটাচ্ছে—এসব বিষয় টিকার কার্যকারিতার মাত্রা নির্ধারণ করে। করোনাভাইরাসের জন্য মূলত দেশে যে চার ধরনের টিকা দেওয়া হচ্ছে এর মধ্যে ফাইজার ও মডার্না দাবি করছে, তাদের করোনা টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর; অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা বলছে, তাদের টিকা ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর; আর চীনের সিনোফার্ম এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক বিবৃতিতে বলেছে, এর টিকা ৭২.৫ শতাংশ কার্যকর। তবে এসব টিকাই করোনাজনিত কারণে গুরুতর অসুস্থ হওয়া, আইসিইউর প্রয়োজন হওয়া কিংবা মৃত্যু প্রতিরোধে প্রায় শতভাগ সফল। অর্থাৎ এসব টিকা একটা পর্যায় পর্যন্ত সুরক্ষা প্রদান করতে সক্ষম। মূলত করোনাভাইরাসের ক্রমাগত রূপ বদল বা মিউটেশন এর টিকা তৈরিকে জটিল করে তুলেছে। এ জন্য একবার সম্পূর্ণ ডোজ টিকা দেওয়ার পরও পরবর্তী সময়ে বুস্টার ডোজ নেওয়ার কথা বলছেন অনেকে।</p> <p>তাই টিকা গ্রহণের পাশাপাশি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর সফলতা পেতে সম্ভাব্য সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সঙ্গে মাস্ক পরার কোনো বিকল্প নেই। দ্য গার্ডিয়ানের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুসারে, বৈশ্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, কভিড মোকাবেলায় অন্যতম কার্যকর উপায় হচ্ছে মাস্ক পরিধান, যা ৫৩ শতাংশ পর্যন্ত সংক্রমণ কমিয়ে আনতে সক্ষম।</p> <p>তবে বাজারে এখন এন-৯৫ সার্জিক্যাল মাস্ক ছাড়াও কাপড়ের বিভিন্ন ধরনের মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে। মাস্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সেটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব নির্দেশনা মেনে তৈরি হয়েছে কি না এবং কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সক্ষম কি না তা-ও খেয়াল করতে হবে। কারণ মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই এর সুযোগ নিয়ে কোনো প্রকার নির্দেশিকা না মেনে সাধারণ কাপড়ের মাস্ক বিক্রি করতে পারে। সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কভিডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে যেসব নির্দেশিকা প্রদান করেছে, নিজের ও প্রিয়জনের জীবন রক্ষায় সেসব মেনে চলার দায়িত্ব এখন সবার। এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আবশ্যক।  </p> <p>প্রায় ২০ মাস পর গত ১৯ নভেম্বর কভিডে মৃত্যুহীন দিন পার করেছে বাংলাদেশ, আক্রান্তের সংখ্যাও নেমে এসেছে দুই শর নিচে। এ পরিস্থিতি ধরে রাখতে এবং আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যের কোটায় নামাতে সবাইকে অবশ্যই টিকা গ্রহণ করতে হবে। তবে সম্পূর্ণ সুরক্ষা পেতে টিকা গ্রহণের পাশাপাশি বাইরে গেলে নিয়মিত মাস্ক পরতে হবে এবং করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।</p> <p> লেখক : অধ্যাপক এবং বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ইমপাল্স হাসপাতাল</p>