<p>ব্যাকরণসিদ্ধ না হলেও ‘মানুষ’ শব্দের একটি বিশেষ ব্যাখ্যা করেন অনেকে। বলেন, যার ‘মান’ এবং ‘হুঁশ’ থাকে তিনিই মানুষ। অর্থাৎ যার সম্মান বোধ আছে এবং যিনি তাঁর মনুষ্যত্বের ব্যাপারে সতর্ক বিবেকবান তিনিই প্রকৃত অর্থে মানুষ। এই অর্থে যে নির্লজ্জের মতো আচরণ করে, অন্যায় দুর্নীতিতে জড়ায়, অন্যের মঙ্গলচিন্তা করে না তার মধ্যে সম্মান বোধ থাকে না এবং চলায়-ফেরায় মানুষের মতো হলেও যার মধ্যে মানবিকতা নেই তাকে মানুষ বলা যায় না। মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন দেশে অবাধে অস্ত্র হাতে থাকার সুবাদে অনেক তরুণ উচ্ছন্নে গিয়েছিল। তারা অনেকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং নানা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। এই বাস্তবতার আলোকে একটি মেধাবী বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। নাম ‘আবার তোরা মুনাষ হ’। এখন বোধ হয় আবার কোনো বিবেককে বলতে হবে ‘আবার তোরা মুনাষ হ’। বর্তমান সময়ে মনুষ্যত্ব বিকিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বেড়েছে বিবেকহীন মানুষের সংখ্যাও। এ কারণেই মনে হয় আমরা যারা অমানুষ তাদের মানুষ হওয়া জরুরি।</p> <p>প্রথম বিবেকহীন মূর্খ মানুষ নামধারী এক শ্রেণির বাঙালির কথা বলি। এই যে করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান উপায় স্বাস্থ্যবিধি মান্য করা। অর্থাৎ মাস্ক পরে থাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং হাত-মুখ পরিচ্ছন্ন রাখা। এতে নিজে যেমন রক্ষা পাবেন, চারপাশের মানুষকেও রক্ষা করবেন। শতভাগ টিকা নিশ্চিত না করতে পারা সময়ে এর চেয়ে উপযুক্ত প্রতিষেধক আর কী হতে পারে! কিন্তু বাস্তবে আমাদের মধ্যে কয়জন সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন করছি? গ্রামগঞ্জে-শহরে, হাটে-বাজারে সর্বত্র এই ঘোরতর দুর্যোগেও মাস্কবিহীন ‘বীর বাঙালির’ পদচারণই বেশি। সরকারিভাবে, গণমাধ্যমে এত যে প্রচারণা চলছে, বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা করোনার ভয়াবহতার কথা ব্যাখ্যা করে পরামর্শ দিচ্ছেন; কিন্তু ‘হুঁশ’ নেই বলে তাঁরা তা আমলে আনছেন না। কারো যদি আত্মহত্যা করার ইচ্ছা হয়, তবে তাকে কে ঠেকাবে! কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি না মানায় নিজের সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ও সমাজের মানুষদের যে করোনার ভয়াবহতায় ঠেলে দিচ্ছে সে অধিকার কি তার আছে? অর্থাৎ বিবেক ও মানবিকতা এদের মধ্যে কাজ করে না। তাহলে মনুষ্য পদবাচ্যে তাদের ফেলা যায় কেমন করে? এই তথাকথিত বিবেকহীন মানুষের মিছিলে কে নেই! অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত মানুষ, সার্টিফিকেটে শিক্ষিত মানুষ, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টগবগে তরুণ ছাত্র, দোকানের কর্মচারী অনেকের মধ্যেই মাস্ক পরায় অনীহা। পরলেও অনেকের নাকে-মুখে, নয়তো গলায় ঝুলছে মাস্ক।</p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2021/July/24-07-2021/kalerkantho-6-2021-07-24-01a.jpg" style="float:left; height:262px; width:320px" />ডেল্টা ভেরিয়েন্ট প্রাণঘাতী হয়ে প্রবেশের আগ পর্যন্ত যুক্তি ও বিবেকহীন অনেকেই বলতেন, গরিবের করোনা হয় না অথবা গ্রামে করোনা নেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ জানিয়ে দিল এসব ভুল কথা। আগে গ্রামের খোলামেলা আবহাওয়ায় করোনা তেমন ছড়াতে পারেনি। খেটে খাওয়া পরিশ্রমী মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি থাকায় হয়তো এই শ্রেণির আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু নাক-মুখ দিয়ে যদি ভাইরাস ঢোকার পথ করে দিই, তাহলে কতক্ষণ যুদ্ধ করবে শরীর! এক শ্রেণির মানুষ ধর্মের শিক্ষাটিও ভালোভাবে বুঝতে অপারগ। তাই কোনো রকম প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিয়ে পুরোটাই আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা ছুটছে লাগামহীনভাবে।</p> <p>গত ঈদ যাত্রায় ‘শহরের করোনা’ বিবেকহীন ‘মানুষ’ গ্রামে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন-পরিজনদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে আঘাত হেনেছে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট। এখন তো করোনা কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। গ্রামে ছড়িয়ে যাচ্ছে ভয়ংকরভাবে। নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ আক্রান্ত হয়ে ভিড় জমাচ্ছে হাসপাতালগুলোতে। প্রাণ হারাচ্ছে অনেকে। এসব অভিজ্ঞতার পরও কি আমরা মানুষ হতে পেরেছি? সংক্রমণ ও মৃত্যুহার যখন প্রচণ্ডভাবে ঊর্ধ্বগতিতে তার পরও ঈদ সামনে রেখে বিবেকহীন ‘মানুষ’ আবারও ছুটছে গ্রামে। গতবারের অভিজ্ঞতায় সরকার এবার ফেরিতে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মানুষ পারাপার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। নানা বাহিনীর নজরদারির মুখেও বিচিত্র বাহনে দুরন্ত ও বিবেকবর্জিত মানুষ ভিড় জমাচ্ছে ফেরিঘাটে। হরেক অজুহাত দেখিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি তুলছে ফেরিতে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর ব্যর্থতা ও অপারগতায় ফেরিগুলোও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা কঠোরতা ও বল প্রয়োগের কথা বলে আসছি বারবার। মনুষের জীবন রক্ষা ও সংক্রমণ ঠেকানোর চেয়ে বড় কিছু এখন আর নেই। এমন সংকটে মানুষ পরিচয়ধারী আমরা যদি মানুষ হতে না পারি, তবে সেখানে মানবিকতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। যদি ফেরিঘাটে প্রকৃত কঠোরতা আরোপের খবর ছড়িয়ে পড়ত, তাহলে মোটরসাইকেল বা নানা উপায়ে শহর থেকে ফেরিঘাটে আসার উৎসাহ হারিয়ে ফেলত বিবেকহীন মানুষ। বৃহত্তর মানুষের কল্যাণে ক্ষুদ্রসংখ্যক অমানুষের প্রতি বল প্রয়োগকে আমি অন্যায় হিসেবে দেখি না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে গ্রামমুখী বিবেকহীন সাধারণ মানুষ যেমন মনে করে সবাই মরে মরুক, আমি না মরলেই হলো, তেমনি সরকারি নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, মানুষ মরে মরুক ‘অর্থনীতি গতিশীল রাখতেই হবে।’ সরকারের নানা বিধায়ক ও জনপ্রতিনিধি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাই শ্রমিকের ভাগ্য যেখানেই থাকুক করোনা দেখিয়ে করোনার প্রণোদনার অর্থ নিজেরা বণ্টন করে নিচ্ছেন। প্রতিবেশী অনেক দেশে যখন পোশাক কারখানা বন্ধ, সেখানে পণ্য আদেশের সুবিধা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের পোশাক কারখানা খুলে রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার সঙ্গে তা যতটা সাংঘর্ষিক হোক না কেন, তাতে কোনো পরোয়া নেই। অর্থাৎ এসব ক্ষমতাবান মানুষের ‘হুঁশ’টুকু আছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।</p> <p>অমানুষের সংখ্যা তো দিন দিন বাড়ছে। লকডাউনকে পুঁজি করে চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্য প্রতিদিন বাড়ছে। সরকার এরই মধ্যে ব্যবসায়ী-মন্ত্রী-এমপিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে। ফলে জনদুর্ভোগ কমানোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো পদক্ষেপ আমরা কখনো দেখি না। এসব বিধায়ক, ব্যবসায়ী যদি মানুষ না হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের মুক্তি কোথায়!</p> <p>অমানুষের সংখ্যা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। পুলিশ বিভাগের মধ্যে পচন ধরা তো পুরনো বিষয়। প্রতিদিনই মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটছে। অতি সম্প্রতি করোনায় মুমূর্ষু বাবার জন্য অক্সিজেন নিয়ে ফেরার পথে ছেলেকে দাবিমতো এক হাজার টাকা না দিতে পারায় আটকে রাখলেন এসআই। আর ওদিকে অক্সিজেন না পেয়ে ছটফট করে মারা গেলেন বাবা। এমন ঘটনায় কেউ বলবেন না এখানে সভ্যসমাজ বিরাজ করছে। এই একটিমাত্র ঘটনায় যে তোলপাড় হওয়ার কথা ছিল তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? এসব অপরাধীকে আমরা কতটা বিবেকসম্পন্ন মানুষ বলতে পারি?</p> <p>মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য কষ্ট হয় আমার। এই দেশপ্রেমিক মানুষটি সাধারণ মানুষ ও দেশকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অহর্নিশি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন; কিন্তু নষ্ট রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে পড়ে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত চারপাশের মানুষ ও আমলাতন্ত্রের দুর্বৃত্তপনায় শেষ সূর্যটি দেখতে পাচ্ছেন না। কতটা অমানুষে ছেয়ে গেছে যে বিশ্ববাসীকে তাক লাগানো জনকল্যাণকামী একটি প্রকল্পকেও অসাধুতা গ্রাস করেছে। আমি মুজিববর্ষে হাজার হাজার গৃহহীন মানুষকে বাড়ি উপহার প্রদানের কথা বলছি। আমরা অবাক হই খোদ প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের এমন মহৎ প্রকল্পও অবলীলায় দুর্নীতি গ্রাস করল। নির্মাণের দুই-চার মাসের মাথায়ই ভেঙে যেতে লাগল ঘরবাড়ি। পত্রিকার এক রিপোর্টে দেখলাম একটি ঘর নির্মাণেই ২৪ থেকে ২৫ হাজার টাকা চুরি হয়েছে। তাহলে হাজার হাজার ঘর থেকে কত শ কোটি টাকার তছরুপ তা সহজেই অনুমেয়। খোঁজ নিলে হয়তো জানা যাবে নির্মাণের কাজ পেয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের ডান হাত-বাঁ হাতেরা। আর বখরাভাগ হয়তো গিয়েছে ফাইল যত জায়গায় ওঠা-নামা করেছে সব জায়গায়। তাহলে এত অমানুষের মেলায় দেশ এগিয়ে যাবে কেমন করে! আর সাধারণের কল্যাণই বা হবে কেমন করে!</p> <p>কোথায় স্বস্তি আছে! সাধারণ মানুষের জীবন তো এখন তেলাপোকার মতো। দেখলেই পিষে মারতে ইচ্ছা করে। এই দিনচারেক আগে নারায়ণঞ্জের ভুলতায় একটি জুস কম্পানির বহুতল কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল। বেঘোরে প্রাণ দিলেন ৫২ জন হতভাগ্য শ্রমিক। এঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। নিকট-অতীতে রাজধানীতে অনেক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। জীবন গিয়েছে শত শত মানুষের। আমাদের কর্তৃপক্ষের যেন অভিজ্ঞতা অর্জন এখনো শেষ হয়নি। সর্বত্র একই কারণ—কেমিক্যাল, দাহ্যবস্তু, শ্রমিক নির্গমনের গেট বন্ধ, অপর্যাপ্ত বহির্গমনের সিঁড়ি। ভুলতায়ও তো একই অভিযোগ। তাহলে এত সব দুঃসহ অভিজ্ঞতার পর এর নিবারণের চিন্তা নেই কেন!</p> <p>মালিক অমানুষ। গরিব শ্রমিকের কলজেতে পা রেখে লভ্যাংশ তুলে নিতে চান। তাই দরজায় তালা আটকিয়ে ক্রীতদাসদের কাছ থেকে যেন কাজ আদায় করে নেন। খাদ্যবস্তুর কারখানাকে কোন যুক্তিতে দাহ্যবস্তুর সংরক্ষণাগার করা হয়েছিল? অগ্নিনির্বাপণের নিজস্ব ব্যবস্থাপনার কথাও জানা গেল না। কিন্তু এসব দেখভাল করার জন্যও তো সরকারি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। দীর্ঘদিন থেকেই তো এমন অব্যবস্থাপনা চলছে। তাহলে তা নজরদারির বাইরে থাকে কেমন করে? অনেক সমস্যা তো এই ফ্যাক্টরিতে দেখা গেল—১. এখানে অবাধে শিশুশ্রম চলছিল, ২. জুস-চানাচুর-লাচ্ছা সেমাই কারখানার নিচে-ওপরে কিভাবে কেমিক্যালসহ নানা দাহ্যবস্তু থাকতে পারল? ৩. অতীতে নানা অঘটনের অভিজ্ঞতার পরও প্রয়োজনীয় নির্গমনব্যবস্থা থাকল না কেন? ৪. একইভাবে সিঁড়ির মুখ তালাবদ্ধ থাকে কেমন করে? দায়িত্বপ্রাপ্ত অমানুষরা কি কখনো জবাবদিহির আওতায় আসে?</p> <p>এভাবে সব ক্ষেত্রে অমানুষে ছেয়ে গেছে দেশটি। এখন বিবেকের তাড়নায় জাগিয়ে তুলে অন্যায়কারীদের উচ্ছেদ করে এবং শক্তভাবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দেশকে সুস্থতার দিকে ফেরাতে হবে। উজ্জ্বল ঐতিহ্যের এই দেশকে যদি আমরা স্বমহিমায় ভাস্বর দেখতে চাই, তবে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের বিবেক জাগ্রত করা—প্রকৃত মানুষ হওয়া।</p> <p>লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>shahnawaz7b@gmail.com</p>